বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৬)

– বিজন সাহা

গত সপ্তাহে একজনের সাথে কথোপকথন নিয়ে লিখেছিলাম। সেটার সূত্র ধরেই আজকের লেখা। একটা জিনিস আমাকে প্রায়ই ভাবায় – সেটা হল আমরা কেন এমন ক্যাটাগরিক্যাল হয়ে যাচ্ছি। আমার কেন যেন মনে হয় এ জন্যে আমাদের ডিজিটাল সমাজ দায়ী। কেন? ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড দাঁড়িয়ে আছে বাইনারি সিস্টেমের উপর। কি এই সিস্টেম? এখানে শুধু দুটো সংখ্যা ০ আর ১। শূন্য (০) – এটা মিথ্যার প্রতীক আর এক (১) সত্যের। অর্থাৎ এখানে আমরা সত্য আর মিথ্যা এই দুটো ধারণা থেকে একটা বেঁছে নিয়ে সামনে এগোই। আসলে বেঁছে নেই সত্যকেই – তবে সে সত্য অনেক সময় অবজেক্টিভ না হয়ে সাব্জেক্টিভ হতে পারে। মানে সত্য সেটাই যেটা আমার স্বার্থের পরিপন্থী নয়। কম্পিউটার অবশ্য এভাবে দেখে না, আমরা মানুষেরা সত্য মিথ্যা নিজ নিজ পছন্দ মত সাজাতে পারি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ডিজিটাল যুগে আমাদের চিন্তা ভাবনায় হয়তো এমন পরিবর্তন এসেছে যে আমরা শুধু দুটো জিনিস থেকে একটা বেঁছে নেই, মাঝামাঝি পথের কথা ভাবি না। অপশনের এই অভাব বা বলা চলে অন্য কোন অপশন খোঁজার অনীহা আমাদের অনেক সময়ই ভুল পথে, ভুল উপসংহারে নিয়ে আসে। আরও একটা ব্যাপার – সেটা হল যাচাই না করে যেকোনো কিছু তড়িঘড়ি করে গ্রহণ করার মানসিকতা। ফলে এমনকি খোদ হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারী অনায়াসে বলতে পারেন যে তার কাছে যে তথ্য সেটা আসলে সামাজিক মাধ্যম থেকে নেওয়া। আসল কথা সেটা আমাদের নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানো গেলেই হল। এ নিয়ে সেদিন কথা বলছিলাম বন্ধু ভাসিলির সাথে। ও প্রোগ্রামিং-এ এক্সপার্ট যদিও পড়াশুনা নিউক্লয়ার ফিজিক্সের উপরে। আমাদের কথাবার্তায় যেটা বেরিয়ে এলো সেটা এরকম। নব্বুইয়ের দশকেও আমরা যখন পেপার লিখতাম ছবি আঁকতাম বিভিন্ন প্রোগ্রাম ব্যবহার করে। সেসব ফিগারে অনেক সময় সেখানে গ্রীক সিম্বল ব্যবহার করতে হত, কিন্তু প্রোগ্রামে সেগুলো পেতাম না। ফলে পোস্ট স্ক্রিপ্ট ফাইলে ঢুকে সেটা খুঁজে বের করে হাতে লিখতাম। এরকম অনেক কিছুই। অথবা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকতাম কোন পেপারের জন্য। এখন অফিসে বা বাসায় বসে অন লাইনেই সেসব করি। টেকনোলজি যত জটিল হচ্ছে জীবন তত সহজ হয়ে আসছে। আসলে আগে যদি টেকনোলজি ব্যবহার করত বা করতে পারত এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন, এখন সব এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন এমনকি প্রায় অশিক্ষিত মানুষও সেটা ব্যবহার করতে পারে। এখানে একটা উদাহরণ দিই। আমি যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র অমল দা, মানে ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর ডঃ অমল কৃষ্ণ হালদার তখন পিএইচডি শেষ করলেন। তখনও আমার কম্পিউটার ঠিক কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। একদিন কি একটা কথায় বললাম, “অমল দা আপনাদের সমস্যা তো কম্পিউটার সামাধান করে, আমাদের তো এখনও হাতেই করতে হয়।” অমল দা হেসে বললেন, “কিছুদিন পরে যখন নিজেকেই এসব করতে হবে তখন দেখবে আমাদের কাজ তত সহজ নয়।”  হ্যাঁ, পরে বুঝেছি কম্পিউটারে সঠিক ভাবে সমস্যা উপস্থাপন করার জন্য অনেক খড়কুটা পুড়াতে হয়। এখনও জটিল সমস্যা সমাধানে সেসবই রয়ে গেছে, মানে শুধুমাত্র খুব ভাল করে কম্পিউটারের ভাষা জানলে আর কম্পিউটারকে সেটা ঠিক মত বোঝাতে পারলেই তার কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যায়। তবে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কম্পিউটার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। জীবনটা সেদিক থেকে খুবই সহজ হয়ে গেছে যদিও সেই সুযোগ ভোগ করার জন্য দরকার টাকা, অনেক টাকা – যা উপার্জন করা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই আমরা সবাই ভোগবাদী সমাজের অংশ হয়ে গেছি। আর ভোগ মানেই আরাম আয়েশ। যদি প্রশ্ন করা হয় ত্যাগের সাথে জড়িত তবে ভোগ হল প্রশ্ন না করা, মেনে নেওয়া। নিজেদের সমাজের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। যদি ক্ষমতাধরদের প্রশ্ন না করে তাদের কথায় সায় দেন, তাদের সবকিছু মেনে নেন, দেখবেন সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটা আপনার কপালেও জুটেছে। আর প্রশ্ন করলেই যত বিড়ম্বনা। আসলে যখনই কেউ প্রশ্ন করে সে সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে তাকে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়। যে ভোগে অভ্যস্ত সে প্রশ্ন করে না, কারণ তাতে তার ভোগে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে এখন মানুষ সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করে সে যে কাজটি করতে যাচ্ছে তাতে সে নিজে কতটা লাভবান হবে বা তাতে তার ব্যক্তিগত আরাম আয়েশ কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আর এই লাভলোকসানের হিসেব করলে মেইন স্ট্রীমে থাকা একান্তই গুরুত্বপূর্ণ – সেটা ভোটের জন্যই হোক আর ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই হোক।  যার ফলে যে লোক পুতিনকে খুনি বলতে দ্বিধা করে না সে ভেবে দেখে না যে সিনেটর বাইডেন বেলগ্রাড বোম্বিংয়ের পেছনে সক্রিয় ছিলেন, তার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা কালেই ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তিনিই নিজের ছেলের জন্য ইউক্রেনের রাজনীতিকে আরও বেশি করে দুর্নীতিগ্রস্থ করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই লোকই দু’ বছর আগেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। প্রশ্ন এই নয় যে ট্রাম্প, বাইডেন, পুতিন – এদের মধ্যে কে ভাল বা মন্দ, তার কাছে এটা নিজের আরাম আয়েশের প্রশ্ন, মেইন স্ট্রীমে থাকার প্রশ্ন। আসলে পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে শুধু রাশিয়ার সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প – এসবই নয়, রাশিয়া নামক দেশ ও রুশ জাতি (রাশিয়ার অধিবাসী – এথনিক্যালি রুশ কি না সেটা বড় কথা নয় অথবা পিটার দ্য গ্রেটের সংজ্ঞা অনুযায়ী – যে রাশিয়াকে ভালবাসে সেই রুশ) – এ সবই বাতিল করার জন্য বদ্ধপরিকর সেখানে ইকনমি, বানিজ্য – এটা তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। তবে এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার জনপ্রিয় শিল্পী স্নুরভ ভুব ভাল বলেছে – “চাইলেই কি আর খারাপ আবহাওয়া বাতিল করা যায়? দেখুক না চেষ্টা করে। মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিকে কি বলবে – শুধুই পর্যায় সারণি? বলুক।” আসলে যারা অন্ধভাবে পশ্চিমা ন্যারেটিভ অনুসরণ করছে তারা নিজেদেরই বঞ্চিত করছে। তারা নিজেদের জানালা দরজা বন্ধ করে ঘরে দুর্গন্ধ আগমন বন্ধ করার সাথে সাথে আলো বাতাসের পথও রহিত করছে।

কিন্তু এই অন্ধত্ব যে শুধু রাজনৈতিক মঞ্চেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক ভাবে বিদ্যমান তার প্রচুর উদাহরণ ফেসবুকেই পাওয়া যায়। এখানে দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। একটা অবশ্য আগে কোন লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। সেটা হল একজন শিক্ষক বিশাল সাদা ক্যানভাসে একটা কালো বিন্দু আঁকা ছবি দেখিয়ে ছাত্রদের বললেন ছবিটা সম্পর্কে তাদের মতামত লিখতে। সবাই কালো বিন্দুকেই নিয়ে লিখল। এ দেখে শিক্ষক বললেন, আসলে সবাই খারাপটাই দেখে। চারিদিকে এত সাদার উপস্থিতি কেউ খেয়ালই করল না, সবাই ভালোটা এড়িয়ে শুধু খারাপটাই দেখল। সেখানে প্রচুর লাইক, প্রচুর সম্মতিসূচক কমেন্ট। আমি তখন লিখলাম ব্যাপারটা কনট্রাস্টে। যদি শিক্ষক বিশাল কালো ক্যানভাসে সাদা বিন্দুর ছবি দেখাতেন, তাহলে সবাই ঐ সাদা বিন্দুকে নিয়েই লিখত। অন্য উদাহরণটা বছর দুয়েক আগের। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একজন একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করলেন যাতে লেখা ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ টি শনিবার। এমন ঘটনা ঘটবে মানে আবার ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ শনিবার হবে ১৫০ বছর পরে। যিনি শেয়ার করেছেন তাকে আমি চিনি। পিএইচডি হোল্ডার। একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে কোন রকম যাচাই না করে তিনি এটা শেয়ার করলেন কেন। কারণ একটু চিন্তা করলেই সেটা যে ভুল তা প্রমাণ করা যায়। বছরে ৩৬৫ দিন, মানে ঠিক ৫২ সপ্তাহ প্লাস ১ দিন। এর মানে বছরের শুরু আর শেষ হয় একই বারে, মানে রবিবার দিয়ে বছর শুরু হলে রবিবারেই শেষ হবে। সেটা যেকোনো তারিখের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শুধু লিপ ইয়ারে যখন বছরে দিনের সংখ্যা ৩৬৬, রবিবারে বছর শুরু হলে শেষ হবে সোমবারে। যেহেতু কথা হচ্ছে ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাই আমরা ফেব্রুয়ারি মাসটাই দেখব। অন্যান্য বছর ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে, তাই সে মাসে রবি, সোম, মঙ্গল ইত্যাদি সব বারই আছে ৪ টে করে। আর লিপ ইয়ারে যে বারে ফেব্রুয়ারি মাস শুরু ২৯ তারিখ সেই বার মানে লিপ ইয়ারে যদি ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ শনিবার হয়, সে মাসে ৫ টি শনিবার থাকবে – ১, ৮, ১৫, ২২, ২৯ এই তারিখগুলো। আগের হিসাব থেকে দেখছি ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শনিবার হলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হবে প্লাস দুই দিন, মানে সোমবার, ২০২২ – মঙ্গলবার, ২০২৩ – বুধবার আর ২০২৪ বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ পাশাপাশি দুই লিপ ইয়ার ২০২০ ও ২০২৪ এর ১ লা ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার হতে রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ – এই চারটা বার অতিক্রম করতে হয়েছে। এভাবে গুনতে থাকলে আমরা দেখব প্রতি সাত লিপ ইয়ার অতিক্রম করে আমরা আগের জায়গায় পৌঁছুব, মানে ২৮ বছর পর ২০৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ টি শনিবার হবে। এথেকে আমরা এটাও দেখব প্রতি ২৮ বছর পর পর ক্যালেন্ডারের পুনরাবৃত্তি ঘটে, মানে ১৯৯২  আর ২০২০ সালের ক্যালেন্ডার এক, যেমন এক ১৯৯৩ ও ২০২১ সালের, ১৯৯৪ ও ২০২২ সালের। তাই ওরকম স্ট্যাটাস শেয়ার করার অর্থ কোন কিছু যাচাই না করে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা। আর এটা হরহামেশাই ঘটছে। ফলে এরা যে যেকোনো খবর যাচাই না করে  সেটা সত্য বা মিথ্যা বলে নেবে তাতে অবাক হবার কী আছে? একই ভাবে আমরা দেখব কিভাবে ফেইক নিউজগুলো ছড়িয়ে পড়ছে নেটে। কথায় আছে একটা মিথ্যা যদি বার বার বলা হয় তাহলে সেটাও এক সময় সত্য বলে পরিগনিত হয়। কেন? কারণ অনেক বার বলার পরে কেউ আর উৎস খুঁজে পায় না। উৎস না পেলে মিথ্যা প্রমাণ করা খুবই জটিল। একই ভাবে করোনা কালে দেখা গেছে কত শিক্ষিত মানুষ করোনার বিভিন্ন দাওয়াই বিলিয়ে গেছে নেটে। বুঝি, এরা করেছে সৎ ভাবনা থেকেই। কিন্তু যাচাই না করে কোন কিছু ছড়ানো অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে। এ নিয়ে পরের পর্বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া