মতামত

প্রবাসে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা

– ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর নারী শ্রমিক প্রবাসে যাচ্ছে রুটি-রুজির প্রত্যাশায় । প্রবাসে কাজ করতে যাওয়া এই সকল নারীরা অত্যন্ত হত দরিদ্র পরিবারের সদস্য। ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে এরা বিদেশে যায়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বি এম ই টি), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা), ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে নারী কর্মীদের পক্ষ হতে প্রচুর শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু অভিযোগকারী তথা ভূক্তভোগিরা খুব বেশী প্রতিকার পায়না -উল্টো হয়রানির শিকার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফলে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েও অনেকে স্বপ্ন ভঙ্গের যাতনা নিয়ে দেশে ফেরত আসেন শূন্য হাতে। শরীরে তাদের নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন দৃশ্যমান থাকে। অনেকে মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ফলে তারা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত তথ্যমতে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যাওয়ার টাকাও তাদের অনেকের কাছে থাকেনা। অনেকের পরিবারেও ঠাঁই হয় না। এমন কি সামাজিকভাবেও তাদের অনেককে হেয় হতে হয়। ফলে দেশে ফিরে এসেও তারা নানাবিধ ঝুঁকিতে থাকেন।  অথচ এরা কেবল নিজের ভাগ্য বদলের জন্য বিদেশে যান না। পরিবারের সকলের সুখ সাচ্ছন্দের কথা বিবেচনা করে তারা প্রত্যেকে বিদেশ বিভূঁইয়ে একদম অচেনা পরিবেশে পাড়ি জমান।

২০১৫ সালে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের মধ্যে নারী গৃহ কর্মি পাঠানো সংক্রান্ত ব্যাপারে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তিতে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের একজন নারী গৃহ শ্রমিকের বিপরীতে ২/৩ জন পুরুষ শ্রমিক নেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ থাকার পর এই ধরনের চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় মানব সম্পদ রপ্তানীর সাথে যুক্ত অনেকেই আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন। অনেকেই সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে মানব সম্পদ রপ্তানীতে সৃষ্ট অচলাবস্থার নিরসনের স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলেন।

বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের চুক্তির পর সৌদি আরবে নারী শ্রমিকের যাতায়াত বৃদ্ধি পেলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। ফেরত আসা প্রত্যেক নারী শ্রমিকই কম বেশী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যারা এখনও ঐ দেশে কর্মরত আছেন তারা কি অবস্থায় আছেন। আদৌ নিরাপদে আছেন কিনা? সে ব্যাপারে সঠিক কোন তথ্য কারো কাছে জানা নেই। এটা আমাদের রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা।

সৌদি আরবে গৃহকর্মি নির্যাতনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ১৫০ জন গৃহকর্মির সাক্ষাৎকারে তাদের উপর বর্বরোচিত ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের’ ঘটনা উঠে আসে। ফলে ঐ সকল দেশ থেকে নারী গৃহকর্মি পাঠানো বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আর কোন বিকল্প না থাকায় সৌদি আরব বাংলাদেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। উক্ত চুক্তির ফলে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মির পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বটে কিন্তু নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের আদৌ কোন প্রস্তুতি ছিল কিনা, সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

কোন নারী শ্রমিককে বিদেশে পাঠানোর সময় তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। তাদেরকে ঐ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে যথাযথ ধারনা দিয়ে অর্থাৎ তাদেরকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েই বিদেশে পাঠানো উচিৎ বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। এমনকি নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিলে ঐ অবস্থায় তাদের করণীয় সম্পর্কেও ধারণা দেয়া গেলে আরও ভাল। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বি এম ই টি)এর অধীনে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী পরিচালনা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন এবং ২০১৬ সালে প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্ম সংস্থান নীতি প্রণয়ন করে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী কর্মিদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। এমনকি অভিবাসী শ্রমিকদের সার্বিক নি্রাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে প্রয়োজনে বিদেশে বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসে শ্রম কল্যাণ উইং গঠণ করার কথাও উল্লেখ আছে।   কিন্তু বাস্তবে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিনা বিধায় আমাদের প্রবাসী নারী শ্রমিকেরা অমানবিকভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

তাই বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ এবং প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্ম সংস্থান নীতি ২০১৬ এর আলোকে বর্তমানে যারা বিদেশে কর্মরত আছেন এবং ভবিষ্যতে যারা বিদেশে কাজ করতে যাবেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দ্রুত সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের অধীনে জরুরীভাবে একটি শ্রম কল্যাণ উইং গঠন করতে হবে। উক্ত শ্রম কল্যাণ উইংএর কাজ হবে বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা এবং তাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে শ্রম কল্যাণ উইংকে সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের মানবাধিকার কর্মি কিংবা অন্য কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যদি থাকে তাদেরকেও সংযুক্ত করা যেতে পারে।

প্রবাসে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা রাষ্ট্রের আইন মেনেই প্রবাসে যাচ্ছেন। তাই তাদের বর্তমান দূরাবস্থার দায় রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারেনা। সুতরাং প্রবাসে কর্মরত নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা  প্রবাস ফেরত সকল দূর্দশাগ্রস্ত নারী শ্রমিকদের পূণর্বাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি