চলমান সংবাদ

ভারত-বাংলাদেশ: মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে সমন্বয় না হওয়ায় বাংলাদেশের জেলেদের বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা জেলেদের

মাছ ধরার বন্ধ থাকায় নৌকা সাগর থেকে তুলে ফেলা হয়েছে।
মাছ ধরার বন্ধ থাকায় নৌকা সাগর থেকে তুলে ফেলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সাগরে মাছ ধরার উপর আজ শুক্রবার থেকে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার কারণে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছেন উপকূলের জেলেরা।

তবে তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ সীমানায় মাছ ধরা দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকলেও ভারতীয় অংশে মাছ ধরা মধ্য জুনের পরেই শুরু হবে।

নিষেধাজ্ঞার সময়ে এই সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক ভারতীয় জেলে নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক সময়ই বাংলাদেশে চলে আসে। ফলে নিষেধাজ্ঞা শেষে সমুদ্রে কাঙ্ক্ষিত মাছ পান না বাংলাদেশের জেলেরা।

কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা রত্নসেন জলদাস। সাগরে মাছ ধরে জীবিকা চলে তার। সরকারি নির্দেশে আজ থেকে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হওয়ার কারণে নৌকা ডাঙায় তুলছেন তিনি।

তিনি জানান, ৬৫ দিনের যে নিষেধাজ্ঞা থাকবে সেই সময়টায় জাল আর নৌকা মেরামত, সাথে নতুন জাল বুনে সময়টা পার করবেন, যাতে জুলাইতে যখন মাছ ধরা শুরু হবে, তখন সবকিছু যাতে তৈরি থাকে হাতের কাছে।

মি. জলদাসের অভিযোগ, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরা শুরু করবে সাগরে। আর এ কারণেই নিষেধাজ্ঞার পর হয়তো আশানুরূপ মাছ পাবেন না তারা।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় নৌকা ডাঙায় তোলা হচ্ছে।
মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় নৌকা ডাঙায় তোলা হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে এই সময়টাতে নিষেধাজ্ঞা থাকছে এবং মি. জলদাস তার অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথাগুলো বলছিলেন।

তিনি বলেন, “জৈষ্ঠ্য মাসের ২৫ তারিখে বাংলা মাসে নামবে এরা। নামবে ভারতীয়রা। এরা আপনার সুন্দরবন থেকে অনেক নামার দিকে, সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি চলে আসে এরা।”

“এরা এসে ইলিশের যে বড় বড় মাদারগুলো আছে না, সেদিক থেকে মাছগুলা নিয়ে নেয়। ওদিকে তো আর কোস্টগার্ড থাকে না, নেভি থাকে না, নেভি থাকে আমাদের কক্সবাজার চ্যানেলে, কুতুবদিয়া চ্যানেলে,” বলছিলেন তিনি।

রত্নসেন জলদাস ছাড়াও কক্সবাজার আর বাগেরহাটের একাধিক জেলের সাথে কথা হয়।

তাদের অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন যে, বাংলাদেশে মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও ভারতে মাছ ধরা চালু থাকার কারণে নিজেদের সীমান্তে মাছ ধারার পাশাপাশি অনেক সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় চলে আসেন।

ফলে মাছ ধরা কখনোই আসলে পুরোপুরি বন্ধ হয় না। কুতুবদিয়া উপজেলার আজমকলোনি এলাকার মাহবুবুল হক মাঝি- তারও অভিযোগ একই।

মাহবুবুল হক মাঝি বলেন, “আমাদের বন্ধ যখন ভারতের সাথে সমানে সমানে পড়ে না, তহন ভারতের জেলেরা আমাদের বাংলাদেশের সীমানায় আসি একদম কিনারে চলি আসে। একদম কাছে আইস্যা মাছ ধইরা নিয়া চইল্যা যায়। তখন আমাদের সাগরে মাছ বেশি হইতে পারে না আর।”

মাছ ধরা বন্ধের সময়টাতে জাল মেরামতের কাজ করেন জেলেরা।
মাছ ধরা বন্ধের সময়টাতে জাল মেরামতের কাজ করেন জেলেরা।

কক্সবাজার জেলার মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান অবশ্য কক্সবাজার এলাকায় ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরার বিষয়টি নাকোচ করে দিয়েছেন।

তিনি জানান, মিয়ানমারে যেদিন ‘ব্যান পিরিয়ড’ বা নিষেধাজ্ঞার সময় শুরু হয়, সেদিন বাংলাদেশেও সেটা শুরু হয়। বাংলাদেশে পালন করা হয় ৬৫ দিন। আর মিয়ানমার পালন করে আরো ১৫ দিন বেশি অর্র্থাৎ মোট ৯০ দিন। তাই মিয়ানমারের নৌকা বাংলাদেশে আসার কোন সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, “এবার আসি ভারতের কথায়। ভারতের ব্যান শেষ হবে ২০শে জুন। এদিক থেকে ওদেরটা আগে শুরু হওয়ার কারণে আমরা শুনি যে, ওরা সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরতে আসে।”

২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে ২০শে মে থেকে ২৩শে জুলাই পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকে।

বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশেরই বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রজাতি একই ধরনের হওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞাও একই সময়ে হওয়াটাই সমীচিন। এতে মাছের উৎপাদন বেশি হবে এবং দুই দেশই আরো বেশি লাভবান হবে।

২০শে মে থেকে মাছ ধরা বন্ধ।
২০শে মে থেকে মাছ ধরা বন্ধ।

শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের শিক্ষক অন্তরা ঘোষ বলেন, একই সাগরের কিছু অংশ বাংলাদেশ এবং কিছু অংশ ভারতের মধ্যে রয়েছে। মাছের প্রজাতির মধ্যেও কিন্তু খুব বেশি পার্থক্য নেই। একই প্রজাতির মাছ দুই অংশেই আছে।

আর তাই নিষেধাজ্ঞাটা দুই দেশেই একই সময়ে হলেই ভাল হয় বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, “মাছের প্রজননের যে সময়টা সেটা দুইটা দেশের জন্য দুই রকম হওয়ার কোন সুযোগ নেই। দুই দেশের জন্য একই রকমই হবে। যদি এটা দুই দেশ মিলে আলোচনার মাধ্যমে একই সময়ে দিত তাহলে প্রডাকশন আরো ভাল হতে। দুই দেশই এখান থেকে উপকৃত হত।”

এদিকে বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু-ইকোনমি অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ড. মশিউর রহমান বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে দুই দেশের সাগরে মাছের প্রজনন সময়টা এক নয়। যার কারণে একই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, “এরপরেও আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কয়েক মাস আগে ভারতের হাই কমিশনারের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন। সেখানে তারা বলেছে যে, আমরা তাহলে এক্সপার্টদের সাথে নিয়ে আবারো বসবো যে দুই দেশে কেন আমরা (নিষেধাজ্ঞার সময়) আলাদা করলাম।”

মি. রহমান বলেন, ভৌগলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে মাছ কিন্তু ডিম দেবে। “আমার সাগরের উপর না। সব সাগরে এক সাথে ডিম দিবে না। একেক সাগরে একেক সময় দিয়ে থাকে।”

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’-র তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে আশি লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা