মতামত

ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ও সরকারের অদূরদর্শীতার কারনে ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে

-ডাঃ আরিফ বাচ্চু

৭ ই মে ২০২২ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত নতুন দাম অনুযায়ী প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা ও বোতলজাত প্রতি লিটার ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা ও পাম তেল ৪২ টাকা বেড়ে ১৭২ টাকা করা হয়েছে।

সরকার, ভোজ্য তেলের মূল্য বাড়িয়েছে নিম্ন লিখিত অযুহাতেঃ
১) ডলারের মূল্য পতন,
২) আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি,
৩) বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের অস্থিরতা থাকায় গত দুই মাস ধরে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলর আমদানি কমিয়ে দেওয়া।
৪) করনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা।
৫) রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারনে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ কম হওয়া।
৬) সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশ প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় খরা।
৭) সম্প্রতি পাম উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করা।

কিন্তু বাস্তব চিত্র হল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের মূল্য ১৯৯৭ মার্কিন ডলার থেকে কমে ১৮৫৮ মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে।

এই সব অযুহাতে যদি বাংলাদেশে বর্তমানে ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়, তবে ভারতে ভোজ্য তেলের মূল্য ২০২২ এর মে মাসে বৃদ্ধি পায়নি কেন?

মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্য কমে গেলেও বাংলাদেশে বেড়েছে, ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ও সরকারের অদূরদর্শীতার কারনে।

দেখা যাচ্ছে, এই মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ২ কোটি ২৯ লাখ লিটার সয়াবিন তেল এসেছে, এবং প্রায় ৩ কোটি লিটার পাম তেল আসছে। সরকারি ভাবে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারনে শুধুমাত্র এই দুই চালানে ব্যবসায়ীদের হঠাৎ মুনাফা বা আচমকা মুনাফা হবে ২ কোটি ২৯ লাখ লিটার সয়াবিন এ প্রায় ৮৭ কোটি টাকা। আর ৩ কোটি লিটার পাম তেলে ১২৬ কোটি টাকা।

ঈদের পর দাম বাড়িয়ে ভোজ্য তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করবে সরকার, বাজারে এমন ধারণা দেয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ইতমধ্যেই ভোজ্য তেল মজুত করেছেন, তাই ঈদের আগে থেকে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারনে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকার বাধ্য হয়েছে।

সরকারি ভাবে কিংবা টিসিবি’র মাধ্যমে সরাসরি ভোজ্য তেলের আমদানি করার পরিকল্পনা সরকারের ছিল না, তাই তেলের মূল্য বৃদ্ধি করতে সরকার বাধ্য হয়েছে।

সমূদ্রের আইসবার্গের বাংলা অনুবাদ কি জানিনা, তবে এর চূড়া শুধু দেখা যায়, বাকী বিশাল অংশ পানির নীচে ডুবে থাকে।

তেলের মূল্য বৃদ্ধি নিওলিবারেল অর্থনীতির দৃশ্যত অংশ মাত্র, বাকী বিশাল অংশ এখনো অদৃশ্য।
আর এই ভাবে যদি চলতেই থাকে, তবে এই দেশে অর্থনৈতিক ধস অনিবার্য।

নিওলিবারেলিজমের আছে ডিএলপি (D-L-P) ফর্মূলা।
১) ডিরেগুলেশান অফ ইকোনমি (অনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি)
২) লিবারাইজেশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (ব্যবসা ও শিল্পের মুক্তায়ন বা বিশ্বায়ন)
৩) প্রাইভেটাইজেশন অব স্টেট ওনড্‌ এন্টারপ্রাইজ (সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ)

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক সহ বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো অর্থনৈতিক সংগঠন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, ক্যাটো ইন্সটিটিউট, হেরিটেজ্‌ ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিস, অ্যাডাম স্মিথ ইন্সটিটিউট) এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, পরিকল্পনা নিয়েছে।

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেশি থাকলে কর্পোরেটগুলোর অসুবিধা। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি করা চাই। ধনী দেশগুলোর শীর্ষধনীদের প্রাচুর্যের লেখচিত্র দেখলে এর উদ্দেশ্য কিছুটা বোঝা যায় । নিওলিবারেল অর্থনীতির কারণে ধনী-গরীব ব্যবধান আরো বাড়ে। এর মাধ্যমে বড় ব্যবসায়ী বা ধনীদের কর মওকুফ, আমজনতার সামাজিক সুযোগ-সুবিধা কমানো, সরকারের আকার ছোটো করা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধা দিয়ে বাণিজ্যে আগ্রহী করানো, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য এইসব মৌলিক চাহিদাকে উচ্চমূল্যের পণ্যে পরিণত করা, শ্রমিকদের মধ্যে ইউনিয়ন গড়ে তোলা বন্ধ করা, নিওলিবারেল সমর্থনকারী নানা ধরনের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ঘটে।