চলমান সংবাদ

চট্টগ্রামে বেড়েছে কিশোর অপরাধ, বেপরোয়া অর্ধশত কিশোর গ্যাং

তুচ্ছ ঘটনার জেরে প্রতিনিয়ত কিশোর-তরুণদের সংঘর্ষ-মারামারি চট্টগ্রামে আশংকাজনক হারে বেড়েছে কিশোর অপরাধ। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণ অপরাধীরা। কথিত বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় মহানগরীতে বেপরোয়া অর্ধশত কিশোর গ্যাং। এসব কিশোর অপরাধীরা আধিপত্য বিস্তার, বড় ভাই ছোট ভাই দ্বন্দ্ব এবং তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিল এসব কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। তবে পুলিশের ভাষ্য, সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে তরুণ-কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অভাবের পাশাপাশি মাদকের কালোছায়া, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, ভার্চুয়াল জগতের নেশায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার কারণেই এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে বড় ভাই নামক গ্যাং লিডাররা অনেকটা দায়ী। এসব বড় ভাইয়েরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে কিশোরদের ব্যবহার করছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। উঠতি বয়সের এসব তরুণ হঠাৎ ক্ষমতার সংস্পর্শে এসে অনেকটা বেপোরোয়া হয়ে ওঠে। গত শুক্রবার (২২ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে কিশোর-তরুণদের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে এক কলেজছাত্র নিহত হয়। নগরীর কোতোয়ালী থানার চেরাগি পাহাড় সংলগ্ন রাজাপুর লেইনে কর্ণফুলী ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আসকার বিন তারেক ইভান (১৮) নগরীর বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সে জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ছিল। সংঘাতে জড়িতরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শৈবাল দাশ সুমন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের অনুসারী গ্যাং লিডার শৈবাল দাশ ও নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সাব্বির সাদিকের অনুসারীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দুগ্রুপের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র ইস্যুতে কয়েকদিন আগে ঝামেলা বাধে। এর জের ধরে শুক্রবার ইফতারের আগ থেকেই দুগ্রুপের কর্মীরা চেরাগী পাহাড় ও রহমতগঞ্জে শো-ডাউন দিতে থাকে। সন্ধ্যার পর আন্দকিল্লায় দুগ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে রাজাপুকুর লেইনে সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে ৩জন আহত হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংঘাতে জড়িত এসব কিশোর-তরুণেরা নিয়মিত চেরাগি পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে এবং কাউন্সিলরের বাসার সামনে আড্ডা দেয়। প্রায়ই তারা ঝগড়া-মারামারিতে লিপ্ত হয়। অধিকাংশই বখাটে প্রকৃতির এসব কিশোর-তরুণের অনেকেই মাদক সেবন করে। এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্নসময় কাউন্সিলরের কাছে এসব বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। বরং কাউন্সিলরের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে দেখা যায় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। নগরীতে স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং চট্টগ্রামে সক্রিয় রয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রণহীন কিশোর গ্যাংগুলো খুন-মাদক ব্যবসা-চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের ব্যবহার করার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অধিকাংশ সময় এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। নগরীর অলিগলির সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোতে ধরা পড়ছে একের পর এক কিশোর গ্যাংয়ের ত্রাসের রাজত্ব। কোথাও প্রকাশ্যে মারামারি করছে, কোথাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অংশ নিচ্ছে হানাহানিতে। আবার কোথাও টার্গেট কিলিংয়ে ব্যবহার হচ্ছে তারা। নগরীতে ছিন্নমূল কিশোরদের ২৫টি এবং অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর কিশোরদের আরো অন্তত ১৫টি গ্রুপ নগরীতে আধিপত্য রয়েছে। পুলিশ বলছে, হত্যা-ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্যের বিস্তারের জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়। নগর পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর গ্যাং’র সদস্যরা এলাকার আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। আবার অনেকে ছাত্রলীগের নাম দিয়ে নগরীর পাড়ায়-মহল্লায় কিশোর ও বখাটে গ্যাং বানিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করছে। শুধু নিজেদের মধ্যে হানাহানি নয়, নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর অপরাধীদের উৎপাত বেড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় তুচ্ছ ঘটনায় সদলবলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হয় কিশোর সন্ত্রাসীরা। এদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে খুনের ঘটনাও। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে কিংবা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুচর হিসেবে কাজ করছে অনেক কিশোর। বিভিন্ন মহল্লায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি থেকে শুরু করে ছিনতাই-রাহাজানির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে এরা। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এসব কিশোর গ্যাং’র সদস্যরা মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ-মোবাইল ফোন ছিনতাই, মাদক বেচা-কেনা, মোটরসাইকেল-সাইকেল ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত। নিজ এলাকা ছাড়িয়ে অনেক সময় তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নানা অপরাধ কর্মকান্ড চালায়। এরকম নগরীর ১৬ থানা এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং চক্রের তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে। কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. রহমান নাসের উদ্দিন বলেন, অপরাজনীতির কারণে দেশে মারাত্মক হারে কিশোর গ্যাং বাড়ছে। এখনই এগুলো কঠোর হাতে দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা বাড়বে বলে আমরা শঙ্কিত। তিনি বলেন, সামাজিক অধঃপতন, ন্যায়-নীতি-মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কারণে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। আমাদের বর্তমান সমাজে মা-বাবারা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, সন্তানদের দিকে নজর দেয়ার সময় থাকেনা। এছাড়া সামাজিক, পারিবারিক যে নৈতিক, মুল্যবোধের শিক্ষা সেটাও, এখন সেভাবে নেই। আরেকটা বিষয়, প্রযুক্তি নির্ভরতা। আমাদের সন্তানরা এখন খুব কম বয়সেই মোবাইল বা ইন্টারনেট আসক্ত হয়ে পড়ছে।

# ২৬.০৪.২০২২ চট্টগ্রাম #