মতামত

আজ আমাদের সত্তর

– বিজন সাহা

১৯৮০ বা ৮১ সাল। আমি মানিকগঞ্জ দেবেদ্র কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। একদিন ইন্টারভ্যালে বন্ধুদের সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি, কে যেন এসে খবর দিল তপন দা যতীন ঘোষের দোকানে অপেক্ষা করছে, আমি যেন যাই। সামনেই কলেজের মাঠ, তারপর খাল। খালের উপর তখনও বাঁশের পুল। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম। দেখি তপন দা সেখানে বসে কাদের সাথে যেন চা খাচ্ছে। কাছে গেলে বলল
– এ আমার বন্ধু আজহার, আজহারুল ইসলাম আরজু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচয়। তোর সাথে কথা বলতে চায়। তোরা কথা বল। আমি যাচ্ছি।
– বলুন।
– সামনে কলেজের সংসদ নির্বাচন। আমরা চাই তুমি ছাত্র ইউনিয়ন প্যানেল থেকে এজিএস পদে ইলেকশন কর।
– দেখুন, আমি আপনাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না, তাছাড়া রাজনীতি করতে তেমন আগ্রহীও নই। এমতাবস্থায় নির্বাচন করার প্রশ্ন আসে না।
– এখনও সময় আছে। তপন তোমাকে ছাত্র ইউনিয়ন সম্পর্কে বলবে বা পড়তে দেবে।
– ঠিক আছে।
আমি চলে এলাম কলেজে। আসলে রাজনীতি নিয়ে আমার কখনই তেমন আগ্রহ ছিল না যদিও রাজনীতির খোঁজ খবর রাখতাম, পড়াশুনা করতাম নিয়মিত। আজহার ভাই তখন সিপিবির সার্বক্ষণিক ক্যাডার। বুলগেরিয়া থেকে পার্টি ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। স্মার্ট। কর্মঠ। উদ্যোগী। এবং নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক কর্মী।

বাম রাজনীতির প্রতি বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচুর। আসলে যত না সোভিয়েত ইউনিয়ন তার চেয়ে বেশি রাশিয়া আমাকে টানত। মনে আছে বাবা কল্যাণ দাকে একটা গ্লোব কিনে দেন। সেখানে ছিল হলুদ চীন, লাল আমেরিকা আর সবুজ রাশিয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা ও চীনের ভূমিকা আমাকে ওদিকে হেলায়নি, অন্যদিকে সোভিয়েত ভূমিকা ছিল আমাদের পক্ষে। সে সময় স্বপন দা নকশালের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল আর মা এজন্যে চীনের মুন্ডুপাত করতেন। স্কুলে যখন এক এক করে দস্তইয়েফস্কি (দস্তয়েভস্কি), তালস্তই (তলস্তয়) আর চেখভের লেখার সাথে পরিচিত হই কখন যে রাশিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেই বলতে পারব না। হয়তো এর আগে প্রগতি ও রাদুগা থেকে প্রকাশিত রুশদেশের উপকথা ও বাচ্চাদের অন্যান্য বই এতে প্রভাব ফেলেছিল। এসবের পরেও আমি ছিলাম একান্তই পড়ুয়া ছেলে, যে পড়তে ভালবাসে আর একা একা সময় কাটাতে ভালবাসে। তবে ইন্ট্রোভারট যাকে বলে আমি ঠিক তা নই। মনে পড়ে সেই সময় একদিন দেবেশ যে ছাত্রলীগ থেকে এজিএস পদে ইলেকশন করেছিল বলেছিল “বিজন যেদিন রাজনীতি করতে সূর্য সেদিন পশ্চিম দিকে উঠবে।”

কয়েকদিন পরে বিকেলে ফুটবল খেলেছি গ্রামের মাঠে, দেখি মানিকগঞ্জ থেকে একদল ছেলে এলো আমার সাথে দেখা করতে। পরেশ রায়, আবুবকর সিদ্দীকি তুলু, লতিফ সিদ্দীকি, দুলাল মিত্র আর মুজিবুর রহমান আলো। এরা সবাই মানিকগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কমিটির নেতা। অনেকক্ষণ কথা হল। অনেক কথা কাটাকাটি, বাকবিতণ্ডা। আমি তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলাম ওদের। উত্তর দিতে পারেনি। সেদিন আমি অনড়। তবে কথা হল মানিজগঞ্জ গেলে ওদের অফিসে যাব গল্প করতে। এভাবে কাটল বেশ কিছুদিন। দেখলাম আর যাই হোক ছেলেগুলো খারাপ নয়। সবাই পড়াশুনা করতে পছন্দ করে, গরীবদের কথা ভাবে। ঠিক হল আমি আপাতত ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হব না, তবে ওদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করব।

নির্বাচনের প্রচারণা চলল। সব দল থেকে মিছিল করে ক্লাসে ক্লাসে যায় আর আমি ক্লাসে বসে পড়াশুনা করি। মোজাম্মেল স্যার যিনি এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন একদিন তো ক্লাস থেকে বের করেই দিলেন নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে যাবার জন্য। এরপর একদিন বসে আছি রমজান আর আলীমের সাথে হোস্টেলে রমজানের ঘরে, সেখানে এলো সাদিক হোসেন খোকা। আমাদের এক বছরের সিনিয়র, বিএনপি থেকে এজিএস পদপ্রার্থী এবং আক্টিং এজিএস। একটা রিভলবার আমার সামনে রেখে বলল
– তুমি আবার নির্বাচন করতে নামলে কোন দুঃখে?
আসলে এতটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম যে কোন উত্তরই দিতে পারিনি। তাই এরপর থেকে ক্যাম্পেইনে আর যাওয়া হয়নি। নির্বাচন হল। খোকা এজিএস হল। আমার পজিশন কি ছিল সেটা জানার ইচ্ছে কখনই ছিল না। তবে ইতিমধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। একদিন নিজের তাগিদেই সদস্য হলাম। ২০১৬ সালে দেশে গেলে দেখা হল দীপক ঘোষের সাথে। তিনি এক সময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। সেটা আমি কলেজে আসার আগে। পরে ছাত্র লীগে যোগ দেন। তিনি বললেন
– তোমার কারণেই ছাত্র লীগের দেবেশ নির্বাচনে হেরে গেছে। তুমি আমাদের অনেক ভোট কেটেছ।
যা হোক, নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী ও জাসদ ছাত্র লীগের মারামারিতে কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। আমার ছাত্র ইউনিয়নের কাজ এখানেই শেষ। এরপর মূলত খেলাঘরের সাথে আমার জড়িয়ে পড়া, তবে পার্টির সাথে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। ১৯৮৩ সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে এলে এসবের সমাপ্তি ঘটে। যদিও আমি ইলেকশন ক্যাম্পেইন করিনি তার পরেও বেশ কিছু ভোট পাওয়ার কারণ হয়তো আমার পড়ুয়া ইমেজ। তবে তখন সিপিবি থেকে একটা ভুল মেসেজ দেওয়া হয়। নির্বাচনের আগে ওরা কলেজে একটা নোটিশ দেয় যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাল ছাত্রছাত্রীদের কয়েকটা স্কলারশিপ দেওয়া হবে। এতে অনেকের বদ্ধমুল ধারণা হয় যে আমি বৃত্তির লোভেই ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। পরবর্তীতে আমি সিপিবির স্কলারশিপ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি। তবে এটা ঠিক যে এর সাথে ছাত্র ইউনিয়ন করা না করার কোন সম্পর্ক ছিল না। অনেক সময় বিভিন্ন সংগঠন অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের কর্মীদের লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এই নোটিশ তার একটা। শুধু তাই নয়, আমার নির্বাচনী প্রচারপত্রে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস না করেই লিখেছিল যে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলাম যা ছিল ডাহা মিথ্যা। জানি না, কেউ এটা খেয়াল করেছিল কিনা তবে আমি সব সময়ই এ নিয়ে লজ্জিত বোধ করি। মস্কো আসার আগে যে ক’ দিন বুয়েটে পড়েছিলাম তখন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আহসানউল্লাহ হলের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ ছিল। ক্লাস করেছি মাত্র ১ দিন, তবে প্রায়ই বাড়ি থেকেই যেতাম যদিও হোস্টেলে সীট ছিল। এখানে আসার আগে হোস্টেলে সীট রাখবো কি রাখবো না এটা নিশ্চিত করার জন্য লেনিন ভাইয়ের কথায় ফারুক ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তখন ছাত্র আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সেখানে আরও ছিলেন তাহের ভাই, আনোয়ার ভাই, আকাশ ভাই। পরে বুঝলাম ঐ সময়ে এ ধরণের অনুরোধ নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি, যদিও যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল যে আমরা তো ছাত্র ইউনিয়ন পরিবার – লজ্জা কিসের। কলেজের শেষের দিকে যখন ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং মিছিলে খুব জড়িয়ে পড়ি আজাহার ভাই আবার ডেকে বলেন পড়াশুনা করে ভাল রেজাল্ট করতে। ভাল পড়াশুনা, ভাল রেজাল্ট করা এগুলোও ছাত্র ইউনিয়নের কাজের মধ্যেই পড়ে। সে সময় বাবাও একটু বিচলিত হয়ে পড়েন আমাকে সংগঠন নিয়ে মেতে থাকতে দেখে। একদিন বলেন
– দেশে থাকা তোমার ঠিক হবে না, তাহলে পড়াশুনার ক্ষতি হবে। চাইলে ইন্ডিয়া যেতে পার অথবা আমেরিকা। আমি চেষ্টা করব সাহায্য করতে। নাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন – তোমরা যে আদর্শে বিশ্বাস কর সেই আদর্শের দেশ।
আমি সোভিয়েত ইউনিয়নই বেঁছে নিই। যখন পার্টি অফিসে নুরুল ইসলাম ভাই বিদায় জানান, বলেন
– বিজন, আপনি কিন্তু পড়াশুনা করতে যাচ্ছেন। ওখানে ওটাই আপনার একমাত্র কাজ হবে, ধরে নিন এটা পার্টি থেকে আপনার প্রতি দায়িত্ব।

মস্কোয় আসার পর আমাদের সংগঠন ছিল, কিন্তু তাতে রাজনীতি ছিল না। বলা যায় ছিল অপরাজনীতি। কাজ না থাকলে মানুষ অকাজ করে, মানে পরনিন্দা পরচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার কেন যেন মনে হয় বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার আমাদের যে অভূতপূর্ব সুযোগ ছিল সেটা আমরা কাজে লাগাইনি, নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়েই সময় কাটিয়েছি। তবে এর মাঝেও ছিল ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা। কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিলাম যে পৃথিবী যখন আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে ছিল, সেটাকে ঠিক ভাবে দেখা বা তার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হওয়া হয়নি। যদিও আমাদের ছাত্র জীবনে সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রথম সারির নেতা কর্মীরা এখানে এসেছেন, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মত বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে, দেশের কথা, পার্টির কথা জেনেছি অনেক – তারপরেও সেসব ঠিক দেশে রাজনীতি করার মত নয়। এখানে এমনকি পার্টির শাখাও ছিল – তবে সেই অর্থে রাজনীতি ছিল না, ছিল খবরদারি। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, এক সময়ের পার্টির লোকজন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যেমনটা হয়েছিল দেশে। পড়াশুনা শেষ করে আমি নিজেও চলে যাই মস্কো থেকে ১২০ কিমি দূরে দুবনা নামে এক শহরে। জীবন তখন শুধুই গবেষণা আর পরিবার কেন্দ্রিক।

১৯৯৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আমার মস্কো আসা হত কালে ভদ্রে। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে মস্কো থেকে পরিবার দুবনা শিফট করার পরে। ২০০৯ থেকে আবার যাতায়াত শুরু পরিবার মস্কো ফিরে গেলে। তখনই আবার ডাক আসে মস্কোয় কিছু করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখার। সেটা আমরা করি আবার ছাত্র ইউনিয়নকে কেন্দ্র  করেই। ২০১০ সালে পালন করি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আবার গড়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবার। জন্ম নেয় বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া। যদিও এটা সামাজিক সংগঠন তার পরেও একে গড়ে তুলতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তনীদের অবদান অনস্বীকার্য। ২০১২ সালে আমরা ঘটা করে পালন করি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ৬০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এরপরে এক্স-বিএসইউ ব্যানারে কমরেড মনি সিংহ, কমরেড ফরহাদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালন করলেও এক সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। মস্কো থেকে এক এক করে অনেকেই চলে যায় বিভিন্ন দেশে। তারপরেও ২৬ এপ্রিল যখন আসে নিজেকে আবার মনে হয় বিশাল ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের একজন ক্ষুদ্র সদস্য। কয়েক বছর আগেও আমরা চেষ্টা করেছি ছাত্র ইউনিয়ন বা পার্টির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধ্য মত সক্রিয় অংশগ্রহণ করার। এখন সেটাও আর হয়ে ওঠেনা। অন্তত মস্কো বা রাশিয়ায় সমষ্টিগত ভাবে তো না-ই। যেটুকু অংশগ্রহণ সেটা এই লেখালেখির মাধ্যমে। বলা চলে ফেসবুকে বিপ্লব করি।
ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের সবার জন্য রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন।

দুবনা, ২৬ এপ্রিল ২০২২
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো