মতামত

‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’

– সুভাষ দে

চট্টগ্রামের লোক ঐতিহ্যের স্মারক আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা। শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা বৃহত্তর চট্টগ্রামের সামাজিক বিনোদন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিচায়ক লোক ও কারু শিল্পের নানা পসরা নিয়ে এর আয়োজন শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশ মাতিয়ে রাখে কয়দিন, এমন কি বিশ্ব বাঙালি সমাজেও এই মেলা স্মৃতিকাতরতা জাগায়। রাষ্ট্রীয় ও জনউদ্যোগ থাকলে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে পারতো যেমন হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, লালনগীতি, সিলেটের শীতলপাটি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও দেশের বেশ কিছু প্রত্নরাজির ঐশ্বর্য সম্ভার।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবাসে বেদনাজড়িত আক্ষেপে বলেছিলেন, ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি, অবহেলা করি’-বাঙালির লোকজীবনের, সংস্কৃতির যে উজ্জ্বল ক্যানভাস সমূহ ছড়িয়ে আছে আমাদের চারদিকে, সংস্কৃতির যে রত্নরাজি আমাদের সামনে অনাদরে অলক্ষ্যে ছড়িয়ে আছে তার খোঁজ রাখি কজনে। আমরা বুঝতে পারি না লোকসংস্কৃতির আবেদন আমাদের মর্মে কি তোলপাড় আনে- মেলার নানা অনুষঙ্গ কিংবা একটি লোকগান, মাটির পুতুল, সরা, তালপাতার বাঁশি কিংবা একটি যাত্রাপালা কী হাহাকার তোলে আমাদের নগরজীবনে।
জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার মূল তারিখ ১২ বৈশাখ। বলীখেলা হয় লালদীঘি মাঠে আর লালদীঘির চারিদিকে৩/৪ কিলোমিটার জুড়ে মেলা বসে, ৫দিন, ৭দিন চলে।
বৈশাখী মেলায় লোকজীবনের, লোকসংস্কৃতির আয়োজন ছাড়াও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের নানা সামগ্রী, কারুশিল্পের নানা পণ্য, তৈজসপত্র, খেলনা, মিষ্টিদ্রব্য- বলা যায় এই মেলা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক অসামান্য লোকস্মারক। কেবল চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কারিগর, মৃৎশিল্পী, মৌসুমী হাজার হাজার ব্যবসায়ী মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রাম আসেন। মেলাকে ঘিরে স্থানিক অর্থনীতি চাঙা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। গত ২ বছর করোনার কারণে মেলা স্থগিত থেকেছে, এবারও লালদীঘির উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিয়ে টেরাকোটা শিল্পকর্র্ম স্থাপন- এসব কাজ অসমাপ্ত থাকায় বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা স্থগিতের কথা মেলা কমিটি বলেছিল।
তবে নগরবাসীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জেলা পরিষদ চত্বরে বলী খেলা ও লালদীঘির চারিদিকে মেলা ৩দিন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন। বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ঘিরে চট্টগ্রাম মহানগরী জেলা-উপজেলায় সাড়া পড়ে যায়। মেলায় শহর-গ্রামের মানুষের ঢল নামে। মানুষ তাদের সারা বছরের গৃহস্থালী ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী মেলা থেকে কেনেন। শিশু, নারী, পুুরুষ, প্রবীণ-তরুণের মানুষের ভিড় লেগে থাকে মেলায় শিশু-কিশোর-কিশোরীরা মেলায় আসা প্রতিটি পণ্য বিস্ময় নিয়ে দেখে, নাড়াচাড়া করে। খেলনা, মুখোশ, মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য বেলুন ও মুখোশের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। চট্টগ্রামের প্রবাসী অনেকে মেলার সময় দেশে ফিরে আসেন। মেলা উপলক্ষে নগর ও আশেপাশের এলাকার বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আসেন। প্রবীণ যারা যেতে পারেন না মেলায় তারা অতীত দিনের স্মৃতির ঝাঁপি খোলেন।
জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলার একটি সার্বজনীন আবেদন আছে। বঙ্গভঙ্গ এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী স্ফুরণের কালটিতে বদরপাতির সওদাগর আবদুল জব্বার বলীখেলা প্রচলনের মাধ্যমে তরুণদের মনে সাহস, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের আবেগ সঞ্চার করতে চেয়েছেন। শতবর্ষ আগে এই মেলার প্রচলন সম্প্রীতি সাধনার এক মানবিক উদভাসন। চট্টগ্রামের লোক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যচর্চা, বিনোদন, সামাজিক সম্প্রীতির যে আয়োজন বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে তা সকলের যোগে অব্যাহত থাকুক।
আমাদের দেশের মেলা বাঙালি লোকজীবনের, লোকমানসের প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বিশেষ করে চৈত্র- বৈশাখের মেলা বাঙালি জীবনে যে সঞ্জীবনী রস আনে তার ধারায় নগরগুলিও প্লাবিত হচ্ছে। চৈত্র- বৈশাখে মেলা একদিন থেকে তিন, পাঁচ, সপ্তাহ, পাক্ষিক এমন কি মাসব্যাপীও চলে। আর সব ছাপিয়ে নববর্ষ উদযাপন, নববর্ষের মেলা বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা পুষ্ট করছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-আদিবাসী নির্বিশেষে বর্ষবিদায়, বর্ষবরণ ও মেলা বাঙালি সংস্কৃতির সার্বজনীনতা ও এর অন্তর্নিহিত সবল শক্তিকেই উদ্ভাসিত করে তুলছে। মেলায় মেলে বাদ্যযন্ত্র যেমন সানাই, ঢোল, মাদল, কাঁসর, ডুগডুগি, একতারা, দোতারা, বাঁশি-লোকশিল্প, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, হাঁড়ি পাতিল, সরা, শিক্কা, বাসন-কোসন, লোক শিল্পÑপশু-পাখি, ফল-ফলাদি আঁকা, নকশি কাঁথা, নকশি পাটি, নকশি পাখা, ছাঁচে তৈরি মিষ্টিদ্রব্য-চিড়ার নাড়ু, নারিকেলের নাড়ু, লাবণ, তিলের নাড়ু, মুড়ি মুড়কি, খাজা-গজা, নকুলদানা, জিলাপি, আছে নানা ফলের আচার। এছাড়া মেলার মূল আকর্ষণ নানাধরনের ক্রীড়া যেমন বলীখেলা, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, চোখবান্ধা, আছে অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে নৃত্য আর লোকগানের আসর। মেলায় যাত্রাপালা অন্যতম আকর্ষণ।
বলা যেতে পারে এসব লোক আয়োজন, লোকসংস্কৃতির সমাহার বাঙালির জাতিগত চেতনা, অধিকার চেতনাকে শাণিত করে সারা বাংলায় কী গ্রামে, কী শহরে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল মোচনে বড় হাতিয়ার হিসেবে ওঠে এলো। তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতীয় আন্দোলনের মতোই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিলো এক মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ।
আজ বাংলাদেশের বর্তমান পটভূমিতে লোকসংস্কৃতির আধারগুলি আঁধারে প্রবিষ্ট করাতে জাতীয়তাবিরোধী, বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি নানামুখী অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত। এর মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, লোক সংস্কৃতির আয়োজন নববর্ষ ও মেলা, নানা লোকগান ও লোকনৃত্য, যাত্রাপালার বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত ও এর আয়োজন নস্যাৎ করা-এসব। আমাদের লালনগীতি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে অথচ উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাউল অনুষ্ঠান ও বাউল শিল্পীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে জাতিবিরোধী শক্তি নানা প্রাচীন ও আধুনিক মতবাদের মোড়কে। জাতীয়তাবাদকে নিছক শ্রেণি তত্ত্বের আড়ালে নিষ্ক্রিয় করার খেসারত পূর্ব ইউরোপ ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলির নব গাঠনিক রূপের মধ্যে আমরা দেখেছি। সাম্রাজ্যবাদী ও ধনবাদী রাষ্ট্রগুলি উত্তর আধুনিকতা, উত্তর উপনিবেশ তত্ত্ব, সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নতুন খেলায় মেতে উঠেছে, তারা এসব দেশের জাতীয় সংস্কৃতি ও এর লোক আধারগুলিকে খন্ডিত করে দুর্বল ও বাণিজ্যিক মোড়কে বিন্যাস করতে সচেষ্ট।
লোকসংস্কৃতি কিংবা লোকজীবনের স্মারকগুলির বাধাহীন অগ্রগতি ও বিকাশ প্রয়োজন আমাদের জাতীয় স্বার্থেই। এসব আয়োজনের সংকোচন নয় বরং রাষ্ট্র ও সমাজ আমাদের অবিনশ্বর সাংস্কৃতিক আধারগুলিকে পরিপূর্ণরূপে ও লোকপ্রিয়তায় নিয়ে যেতে পারে। নববর্ষ উদযাপন কিংবা লোক সংস্কৃতির মানবিক উদ্ভাসন বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠুক। এটি যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি তা আমাদের সমাজ ও রাজনীতির অন্যতম পাঠ হওয়া উচিত।
জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হোক। এই বৈশাখী মেলার সার্বজনীনতার যে আবেদন, লোকসংস্কৃতিও লোক জীবনের যে অসামান্য উদ্ভাসন একে ঘিরে পরিস্ফুট হয়, তা আমাদের জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দন।
লেখক : সাংবাদিক