বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪১)

– বিজন সাহা   

বাঙালি তার প্রাণের উৎসব নববর্ষ পালন করল। তবে একদিন নয়, দু’দিন। কয়েক বছর আগেও যখন ১৪ এপ্রিল দিদিকে ফোন করে বলতাম

– শুভ নববর্ষ দিদি!

ওদিক থেকে উত্তর আসত
– আজ তো ভাই চৈত্র সংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ আগামীকাল।

আজকাল শুধু বাংলা নববর্ষই দুই বাংলায় দুই দিন পালন করা হয় না, একই ভাবে দুই দিন ব্যাপী পালিত হয় পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, বাইশে শ্রাবণ, অর্থাৎ বাঙালির যা কিছু গর্বের দিন যা কিনা বাংলা তারিখ ধরে পালন করা হয়। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

এই যে দু’ দিন নববর্ষ পালন সেটা ভাল না মন্দ? এ নিয়ে একদিন এক রুশ বন্ধুকে বলায় ও তো অবাক! “তোমরা তো ভাগ্যবান, দু দু’ দিন নববর্ষ পালন করবে, প্রাণ ভরে পান করবে, অথচ কেউ কিছু বলবে না! সমস্যা আর খুঁজে পেলে না?” তবে বাংলাদেশ রাশিয়া নয় আর বাঙালি রুশ নয়। তাই এ নিয়ে ভাবি, ভাবতে হয়।

যদি প্র্যাক্টিক্যাল দিক দেখি, তাহলে বাংলা পঞ্জিকা আমাদের জীবনে তেমন কোন গুরুত্ব রাখে না। অফিস আদালত সব কিছু চলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ধরে। বাংলা পঞ্জিকা মূলত পয়লা বৈশাখ পালনের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায়, যদিও বাঙালির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবনে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তারিখ আমরা বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ীই পালন করি। জাতীয় জীবনে না হলেও সামাজিক জীবনে বাংলা পঞ্জিকার গুরুত্ব অনেক, বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজের জন্য। এদের পূজা পার্বণ থেকে শুরু করে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, হাতে খড়ি ইত্যাদি অনেক কিছুই হয় বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে আর এটা করতে গিয়ে তারা সূর্য, চন্দ্র ও কয়েকটি গ্রহের অবস্থান বিবেচনায় আনে। তাই তারা ব্যবহার করে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ধর্মীয় নিরয়ণ বর্ষপঞ্জী। এই পঞ্জিকা চলে স্বাধীন ভাবে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে কোন রকম পরামর্শ না করে। পুরানো ক্যালেন্ডারে তাই পয়লা বৈশাখ বা অন্যান্য তারিখ ফ্লেক্সিবল। যেহেতু বাংলা পঞ্জিকা হিন্দু ও বৌদ্ধরা ছাড়া বলতে গেলে আর কেউ ব্যবহার করে না, তাই ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ হিসেবে ফিক্সড করে দেওয়ায় দেশের ৯০% মানুষ সেটা খেয়াল করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইসলাম ধর্মের সব কিছু হয় হিজরি ক্যালেন্ডার ধরে, তাই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে মিল অমিল নিয়ে তাদের কোন সমস্যা হয় না। একই ভাবে হিন্দু জনসাধারণ কোলকাতার ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেই সব সমস্যা এড়িয়ে যায়। কিন্তু  সমস্যা দেখা দেয় বাঙালির জীবনে কিছু সেকুলার তারিখ নিয়ে, যা কিনা এই পরিবর্তনের ফলে দুই বাংলায় সাধারণত দুই দিন আসে।

কথা হচ্ছে এরকম ঘটনা কি আমাদের ক্ষেত্রে অনন্য? পৃথিবীতে একাধিক পঞ্জিকা আছে। আর অধিকাংশ পঞ্জিকাই তৈরি হয়েছে স্থানীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যকে মাথায় রেখে। রাশিয়ায় দুটো ক্যালেন্ডার – জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান। আসলে এক সময় জুলিয়ান ক্যালেন্ডারই সমগ্র ইউরোপে প্রচলিত ছিল। ১৫৮২ সালে ভ্যাটিকানের পোপ অষ্টম গ্রেগরি নতুন ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন। তাই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের আগে পর্যন্ত রুশ সাম্রাজ্যে এবং বিভিন্ন দেশে যেখানে অর্থোডক্স খ্রিস্টায়ানিটি মূল ধর্ম, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চলমান ছিল। বিপ্লবের পরে লেনিন অফিসিয়াল কাজ কর্মে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করলেও অর্থোডক্স চার্চ জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মেনেই ধর্মীয় কাজকর্ম করে আর সেটা প্রায় সব অর্থোডক্স চার্চেই, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বুলগেরিয়া সহ কিছু দেশের চার্চ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে চলে গেছে। যদি চীনের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সেখানে নববর্ষের নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। শীতের অয়নকাল বা উইন্টার সলস্টাইসের পরে দ্বিতীয় প্রতিপদ চীনের নববর্ষ। উত্তর গোলার্ধে উইন্টার সলস্টাইস সাধারণত ২২ (অধিবর্ষে ২১) ডিসেম্বর। তাই চীনের নববর্ষ পালিত হয় ১২ জনুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কোন এক দিন। আসলে শুধু নববর্ষ নয় পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন নির্দিষ্ট দিনে হয় না, হয় কোন বিশেষ দিনে, যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশন হয় লিপ ইয়ারের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার। তাই পঞ্জিকার ব্যাপারে জাতিগত ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক পটভূমি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থানীয় পঞ্জিকা অন্তত বর্তমান যুগে বিশেষ অঞ্চলের ধর্মীয় ও লোকজ সংস্কৃতি পালনেই মূলত ব্যবহৃত হয় আর সরকারি কাজকর্ম হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রাচীন মিশরেই চান্দ্র আর সৌর পঞ্জিকার বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্যালেন্ডার সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধির উপর ভিত্তি করে করা হলেও শুধুমাত্র ইসলামিক ক্যালেন্ডার চান্দ্র। কেন? আমার মনে হয় এটা পুরোপুরি আরব দেশের আবহাওয়ার সাথে জড়িত। ধর্মীয় আচার আচরণ পালনের সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল কৃষিকার্যে সাহায্য করা। এক সময় পৃথিবী ছিল কৃষি প্রধান আর রাজকোষের ভালোমন্দ এর সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। কিন্তু মরুভূমির কারণে আরব দেশে চাষাবাদ হত না। আরবেরা ছিল যাযাবর বা ব্যবসায়ী। আর এসবের জন্যে তাদের কাফেলা নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হত। দিনের বেলায় মরুতে প্রচণ্ড গরম বলে রাতই ছিল এসব যাত্রার জন্য উপযোগী সময়, তাই চাঁদই ছিল তাদের আলোর উৎস, পথের দিশারী। হয়তো এ কারণেই আরব দেশে চান্দ্র পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে জানা যায় প্রাক ইসলামী যুগে সেখানেও সৌর পঞ্জিকা ব্যবহৃত হত। যেহেতু ইসলামের অন্যতম প্রধান প্রতীক চাঁদ, হতে পারে এ কারণেই সেখানে চান্দ্র পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয়। তবে ওই যে বললাম, কৃষি প্রধান দেশ না হওয়ায় এটা তাদের জীবনে তেমন কোন প্রভাব ফেলত না।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই কৃষি কাজের সুবিধার জন্য অনেক আগেই সৌর পঞ্জিকা গৃহীত হয়। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে লেখেন যে কলিযুগ শুরুর পর ২৩০০ সালে তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর, সে হিসেবে তাঁর জন্ম ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এর অর্থ সেই সময়েও ভারতবর্ষে নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। বর্তমানে বাংলা পঞ্জিকা নিয়ে যে বিতর্ক সেটা যতটা না সত্যের অন্বেষণ তার চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তক হিসেবে অনেকেই সম্রাট আকবরকেই মনে করেন। তাঁর নির্দেশে ১৫৪৮ সালে টোডর মল মতান্তরে আবুল ফজল মূলত রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে এই পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন। অনেকের ধারণা তারও আগে ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার নবাব আলা-উদ-দীন হুসাইন শাহ্‌ এই বাংলা পঞ্জিকা চালু করেন। ইদানীং অনেকেই দাবি করেন যে ৫৯৪ সালে গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক বাংলা পঞ্জিকা চালু করেন। যেহেতু এই অঞ্চল সব সময়ই কৃষি প্রধান দেশ ছিল তাই ধারণা করা যেতে পারে যে এর আগে থেকেই এই এলাকার মানুষ পঞ্জিকা ব্যবহার করত আর এই রাজা বাদশহদের কেউ এটাকে সরকারি রূপ দেন। তবে যেই করুক না কেন মাস আর বারের নাম প্রমাণ করে যে তারা পঞ্জিকা প্রবর্তন করতে ভারতীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন।  অনেকের মতে প্রথম দিকে আকবর মাসের ও  বারের (দিনের) ফার্সি নাম ব্যবহার করেন, পরে শকাব্দে ব্যবহৃত ভারতীয় নাম গ্রহণ করেন।  বাংলা পঞ্জিকা যে আকবরের অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল তার পক্ষে বলে থাইল্যান্ড, বালি, জাভা, মিয়ানমার প্রভৃতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশে এপ্রিলে নববর্ষ পালনের প্রথা। এক সময় এসব দেশ দক্ষিণ ভারতের চোলা রাজবংশের অধীনে ছিল, তাই সেখান থেকে অনেক কিছুর সাথে ভারতীয় পঞ্জিকা সেখানে চালু হতে পারে বলেই অনেকে মনে করেন। যদিও উইলিয়াম জ্যাকসন সম্পাদিত ভারতবর্ষের ইতিহাস বইয়ে আকবরকে বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তক হিসেবে বলা হয়েছে এ নিয়ে আগে তেমন বিতর্ক ছিল বলে মনে হয় না। বা বলা চলে এ নিয়ে আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। আমার ধারণা বাংলাদেশে ইসলামের সর্বশেষ সৌদি সংস্করণ শক্তিশালী হবার সাথে সাথে স্থানীয় সবকিছু অনৈসলামিক বলে ঘোষণা করার প্রবণতা বেড়েছে আর এর ফলে নববর্ষ তথা বাংলা পঞ্জিকাকে হিন্দু পঞ্জিকা বলে আখ্যা দিয়ে বয়কটের চেষ্টা হচ্ছে। আর সেটাকে বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে প্রতিরোধ না করে একদল লোক সম্রাট আকবর এই পঞ্জিকার প্রবর্তক বলে ঘোষণা করে বাংলা পঞ্জিকার মুসলমানি করতে চাইছে। একই কারণে এসেছে আলা-উদ-দীন হুসাইন শাহের নাম। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীরা শশাঙ্ককে টেনে আনছে। আমার ধারণা এই সমস্যার সমাধান বাঙালিকে করতে হবে তার হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে, কোন মতেই সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে নয়।

১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনে ভারতবর্ষের অফিসিয়াল কাজকর্মে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রভাব পরে। স্বাধীনতার পরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক পঞ্জিকা প্রচলিত থাকায় ভারত সরকার পঞ্জিকা সংস্কারে ব্রতী হয়। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সমগ্র ভারতের জন্য একক পঞ্জিকা প্রস্তুতের। শকাব্দের সাথে ভারতের সংস্কৃতির গভীর যোগাযোগ লক্ষ্য করে তিনি শকাব্দের ভিত্তিতে ভারতীয় পঞ্জিকা করার প্রস্তাব করেন। ভারতীয় পঞ্জিকাগুলোয় কোন কোন মাসের দিনের সংখ্যা ২৯ থেকে ৩২ হতে পারে সেটা মাথায় রেখে সেই কমিশন বৈশাখ থেকে থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনে করার প্রস্তাব দেন, আশ্বিন থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত ছয় মাস হবে ৩০ দিনে আর চৈত্র মাস হবে ৩০ দিনে (অধিবর্ষে ৩১ দিন)। উল্লেখ্য যে ১৯৬৬ সালে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ  কমিশন বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাস ৩১ আর আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত শেষ সাত মাস ৩০ দিনে এবং অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন করার প্রস্তাব দেন। মেঘনাদ সাহা চৈত্র মাসকে বছরের প্রথম মাস করার প্রস্তাব দেন। তাঁর মতে বছরের শুরু হবে বসন্তকালীন বিষুব বা মহাবিষুবের দিন থেকে (২২ মার্চ, অধিবর্ষে ২১ মার্চ)। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইরানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয় ও তুরস্কে (আতা তুর্ক সেটা নিষিদ্ধ করেছিলেন) নওরুজ বা নববর্ষ পালন করা হয় মহাবিষুবের দিন, যদিও এখন কোন কোন দেশে ২১ মার্চকে নববর্ষ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। শকাব্দের সাথে ৭৮ যোগ করে সেটা যদি ৪ দ্বারা বিভাজ্য হয় তবে সেই বছরকে অধিবছর বা লিপ ইয়ার ধরার প্রস্তাব করেন সাহা। এই ৭৮ যোগ করার কারণ ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে স্থানীয় ভাবে শক পঞ্জিকা ব্যবহার করা হয়। সেদিক থেকে বাংলা ও ইংরেজি অধিবর্ষ মিলে যায়। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অবশ্য বৈশাখ মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে রাখেন এবং ১৪ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ হিসেবে স্থায়ী ভাবে গ্রহণের প্রস্তাব দেন। যদি আমরা গ্রেগরিয়ান বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই তাহলে খেয়াল করব যে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর যা কিনা সাত, আট, নয় ও দশ বোঝায় কোন এক সময় আসলে বছরের সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম মাস ছিল। এদিক থেকে দেখলে কোন এক সময় মার্চ মাসেই বছরের শুরু হত। উত্তর গোলার্ধের ঋতুর দিকে খেয়াল করলে দেখব সেখানে মার্চ-এপ্রিল-মে – বসন্ত কাল, জুন-জুলাই-আগস্ট – গ্রীষ্ম কাল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর – শরৎ কাল  এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি – শীত কাল। ফলে দেখছি শীত কাল পুরানো আর নতুন বছরের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘ শীতের পর বসন্তেই নতুন জীবনের শুরু, তাই নতুন বছরের শুরু বসন্তে বা মার্চে হবে সেটাই যুক্তিযুক্ত। আবার যেহেতু ২২ (অধিবর্ষে ২১) মার্চ, ২২ (২১) জুন, ২২ (২১) সেপ্টেম্বর আর ২২ (২১) ডিসেম্বর – অ্যাস্ট্রোনমির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ তাই ২২ (অধিবর্ষে ২১) মার্চকে বছরের শুরু হিসেবে ঘোষণা বৈজ্ঞানিক বটে। মেঘনাদ সাহার মৃত্যুর পর ১৯৫৭ সালে ২২ মার্চ (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার পাশাপাশি সংশোধিত শকাব্দকে ভারতের জাতীয় পঞ্জিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে ধর্মীয় নিরয়ণ বর্ষপঞ্জীর বহুল প্রচলনের ফলে মেঘনাদ সাহা প্রস্তাবিত পঞ্জিকা উপেক্ষিত থেকে গেছে। অন্য দিকে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রণীত বর্ষপঞ্জী গ্রহণ করেছে। আর এর ফলেই দুই বাংলায় দুই পঞ্জিকার প্রচলন হয়েছে।

কিন্তু এখানে কে কবে বাংলা পঞ্জিকা প্রচলন করল তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দুই বাংলায় কি একই পঞ্জিকা থাকা উচিৎ। আগেই বলেছি দু দেশের কোথাও অফিসিয়াল কাজকর্ম বাংলা পঞ্জিকা ধরে হয় না। হিন্দুদের ধর্মীয় এবং বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠান হয় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত নিরয়ণ পঞ্জিকা অনুসারে। অন্য দিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ক্রিস্টমাস ছাড়া খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠান বিভিন্ন বছর বিভিন্ন দিনে হয়। ফলে কোন কোন বছর ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ইস্টার একই দিনে হয়, কোন কোন বছর ভিন্ন ভিন্ন দিনে যেমনটা ক্রিস্টমাস। একই কথা বলা যায় হিন্দু বা বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এসবও বিভিন্ন বছর বিভিন্ন তারিখেই হয়, এমনকি নিরয়ণ পঞ্জিকা অনুসরণ করলেও। মূলত নববর্ষ, রবীন্দ্র ও নজরুল জন্ম জয়ন্তী ও মৃত্যু বার্ষিকী বাদ দিলে অন্য কোন অনুষ্ঠানই সার্বজনীন নয়, ফলে বছরের অন্য দিনগুলো কে কোন পঞ্জিকা মানে এপার নাকি ওপার বাংলার পঞ্জিকা অনুসরণ করল বা আদৌ কোন পঞ্জিকা অনুসরণ করল কিনা এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। যদিও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত কিছু উৎসব যেমন নবান্ন আমাদের ছোটবেলায় হিন্দু মুসলমান সবাই পালন করত, এখন সেটা কতটা সার্বজনীন বলা কষ্ট। তাই অবৈজ্ঞানিক হলেও যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাংলা পঞ্জিকা যদি আগের মতই চলতে থাকে সেটা হবে ঐতিহ্য ধরে রাখার সামিল। আমরা শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে দেশের গুণীজনদের কোন প্রস্তাবই কোন দিন অনুসরণ করিনি। অন্তত ব্যতিক্রম হিসেবে হলেও বাংলাদেশে তাই শহীদুল্লাহ প্রণীত পঞ্জিকা থাকতেই পারে। আমার ধারণা অনেক কিছুর মতই এক সময় আমরা এই দুই পঞ্জিকাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাব বা বলা চলে পর পর দুই দিন নববর্ষ পালনে অভ্যস্ত হয়ে যাব। যদিও রাশিয়ায় শুধু গ্রেগরিয়ান নববর্ষেই সরকারি ছুটি তারপরেও সবাই পুরান নতুন বছরের জন্য অপেক্ষা করে। একটা বাড়তি উৎসব তা যদি ছুটির দিন নাও হয়, কখনই কারও ক্ষতি করেনি। সব কিছুই যে ইউরোপের অনুকরণে করতেই হবে তার কোন মানে নেই। অন্তত পঞ্জিকার ক্ষেত্রে হলেও আসুন আমরা স্বাধীন হই, আমরা আমাদের স্বকীয়তা বজায় রাখি। আমার বন্ধুদের অনেকেই রাশিয়ায় ঈদ পালন করে রাতের ফ্লাইটে দেশে চলে যায় পরের দিন দেশে আবার ঈদ পালন করার জন্য। এ নিয়ে কাউকে কোনদিন অখুশি হতে দেখিনি। হয়তো একদিন আমাদের দেশ থেকে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালন করে অনেকেই রাতের প্লেনে কোলকাতা যাবে ১৫ তারিখে নতুন করে নতুন বর্ষ বরণ করার জন্য।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া