চলমান সংবাদ

মাদ্রাসায় অমানবিক-বর্বরোচিত নির্যাতন একের পর এক ঘটছে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা

দেশের মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক-বর্বরোচিত নির্যাতনের অভিযোগ অনেক দিন ধরেই। শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, মাদ্রাসাগুলোয় শিক্ষার্থীর যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনাও নিয়মিত। এসব নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মাদ্রাসা ছাত্রকে খুন করার ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেপ্তারও হয়েছেন। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মাদ্রাসার ভেতর এক ছাত্রের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধারের দুই দিন পর নগরের পাঁচলাইশে মাদ্রাসার ভেতর থেকে মো. আরমান হোসেন নামে ১০ বছর বয়সী আরেক ছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ মৃত্যুর কারণ জানাতে না পারলেও পরিবারের দাবি, যৌন হয়রানির পর আরমানকে হত্যা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকাল ১১টায় নগরীর পিলখানা এলাকার ‘আলী বিন আবী তালিব’ মাদ্রাসার নিচ থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। এর আগে শনিবার (৫ মার্চ) সকালে বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ ইউনিয়নের হযরত শেখ অছিয়র রহমান ফারুকী (রহ.) এতিমখানা ও হেফজখানা থেকে ইফতেখার মালিকুল মাশফিক (৭) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রের গলা কাটা মরদেহ কম্বল মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ জাফর আহমদ, হাফেজ মো. রুস্তম আলী ও শাহাদাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পুলিশের ধারণা, মাদ্রাসার অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের কোনো ঘটনা থেকে এই হত্যাকান্ড হয়েছে। নগরীর পাঁচলাইশে মাদ্রাসার ছাত্র নিহতের ঘটনায় ওই মাদ্রাসা ছাত্ররা বলছে, সোমবার (৭ মার্চ) বিকেলে খেলাধুলা করলেও ৫টার পর থেকে আরমানকে কোথাও পাওয়া যায় নি। পরিবারকে খবর দিলে তারাসহ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অনেক খোঁজাখুজির পর মঙ্গলবার সকালে মাদ্রাসার পাহাড়ের পাশে জঙ্গলে তার মরদেহ দেখতে পায়। পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠায়। নিহত ছাত্র আরমানের বাবা মো. আব্বাস অভিযোগ করে বলেন, সোমবার বিকেল থেকে তার ছেলে নিখোঁজ ছিল। মাদ্রাসার লোকজন খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাকে ফোন দেন। আরমান বাসায় গেছে কি না সেটি জানতে চান। এরপর রাতভর আব্বাস বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় ছেলেকে খোঁজাখুঁজি করেন। পরে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাদ্রাসা থেকে আবারও ফোন করে তাকে যেতে বলা হয়। মাদ্রাসায় গিয়ে দেখি আরমান পড়ে আছে। মো. আব্বাস বলেন, ‘আমরা ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার ছেলের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমার ছেলে গত রোববার বাড়িতে আমার বোনকে বলেছে, এই মাদ্রাসা ভালো না। শিক্ষকরা প্রচুর মারধর করেন। আমাকেও বলেছিল- চকরিয়া হুজুর বেশি অত্যাচার করে, সবসময় মারধর করে। নিহতের ফুফু রেহেনা বেগম অভিযোগ করে সাংবাদিকদের বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আরমানকে করোনার টিকা দিতে নিয়ে গেলে তাকে মাদ্রাসায় যৌন হয়রানি করেছে বলে সে আমাকে জানায়। ওই মাদ্রাসায় আর পড়বে না বলেও জানিয়েছিল। তারপরও তাকে ধমক দিয়ে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। আরমানের চাচা মো. ওসমান গনি বলেন, আরমানকে মাদ্রাসায় দিয়েছি, সে যেন শুদ্ধভাবে কোরআন পড়ে সামনে রোজায় তারাবির নামাজ পড়াতে পারে। কিন্তু ভাতিজা লাশ হয়ে ফিরেছে। তারা আমার ভাতিজাকে মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। আমি আরমান হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হাফেজ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আরমানকে বিকালে না পাওয়া গেলে তার পরিবার এবং আমরা অনেক খুঁজি। পরে মঙ্গলবার সকালে তার লাশ মাদ্রাসার পাশে পাওয়া যায়। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চত হই সে বিকাল ৫ টায় ছাদে ওঠেছে। কিন্তু পরে সে আর নেমে আসেনি।’ পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাদিকুর রহমান বলেন, ‘সকালে খবর পেয়ে পিলখানা এলাকার আলী বিন আলী মাদ্রাসা থেকে এক ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি। ময়নাতদন্তের পর বলা যাবে তার মৃত্যুর কারণ। পাঁচলাইশ থানার ওসি জাহেদুল কবীর বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ছেলেটি মাদ্রাসার ছাদে উঠেছিল। কিন্তু সে আবার নেমে আসার কোনো ফুটেজ আমরা পাইনি। ছেলেটি মাদ্রাসার ছাদ থেকে পড়ে যাবার কিংবা কেউ তাকে ফেলে দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণও ফুটেজে পাইনি। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য বের করতে হবে। শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ ঘটনায় আব্বাস বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি নজরদারি না থাকায় দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের একের পর এক ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাগুলো পরিচালনায় যারা থাকেন, তাদের একক কর্তৃত্বের কারণে মাদ্রাসাগুলোতে তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই। নির্যাতনের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠকরা বলছেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষকদের মাধ্যমে মাদ্রাসার ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের শারিরীক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের নির্যাতন-নিপীড়নের এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হলেও আগে এসব খবর গণমাধ্যমে আসতো না। বিকৃত মানসিকতার এসব মাদ্রাসা শিক্ষকদের কামনার বলি হচ্ছে এসব ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক আগেই বেত-লাঠি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা, ২০১১ নামে একটি নীতিমালা জারি করা হয়েছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি প্রদানের বিষয়টি কমে গেলেও বিভিন্ন মাদ্রাসায় এটা চলমান ছিল। সরকারি নজরদারির অভাবে মাদ্রাসাগুলো স্বেচ্ছাচারি আচরণ করছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত কঠোর তদারকি করা জরুরি। তিনি বলেন, মাদ্রাসাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে মানুষরূপি নরপশুরা অবুঝ শিশুদের যৌন নিপীড়ন করে আসছে। এখন সময় এসেচে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি ও তদারকি বাড়ানো জরুরি।
# ০৮.০৩.২০২২ চট্টগ্রাম #