মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধ: একটি সমসমাজ দৃষ্টি ভঙ্গি

-অপু সারোয়ার

বিশ্ব যুদ্ধের গুজব ও দামামা ইউরোপে আবার শোরগোল বেঁধেছে। পরমাণু ওয়ারহেড যুক্ত মিসাইল গুলি ভবিষ্যত লক্ষ্যের দিকে তাক করানোর নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধের উভয় পক্ষই কামান -বোমারু বিমানে গোলা ও বোমা ভর্তি কাজ পুরোদমে । ইউক্রেনের উপর সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার আক্রমণ একটি অন্যায় যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া দেশের উপর একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন। আমেরিকা ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নাই। ন্যাটো ভুক্ত দেশ গুলির সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভবনা এই মুহূর্তে অস্পষ্ট বা নেই বললেই চলে । যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক উপস্থিতি বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ন্যাটোর বিশেষ বাহিনী বা ড্রোন অনুপস্থিত।তবে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের মিত্ররা [ সাম্রাজ্যবাদ- আমেরিকা , কানাডা , জাপান, ফ্রান্স, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া ] রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে যে এটি একটি আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। ইউক্রেনীয় সরকার পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাছে সরাসরি সামরিক সাহায্যের অনুরোধ করছিল। এবং এই অনুরোধ এখনও অব্যাহত রয়েছে । মজার ব্যাপার হল, দুর্বল ইউক্রেনীয় সরকারের গণনা – প্রত্যাশা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে। কারণ ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরাসরি সামরিক ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নাই। তবে সামরিক সরঞ্জাম ও অর্থ দিয়ে ইউক্রেনের সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলি।

সাম্প্রতিক বছর গুলিতে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ বেসামরিক জনগণের উপর বোমা হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। স্থল সৈন্যদের কথা চিন্তা করার আগে সাম্রাজ্যবাদীরা সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। ইউক্রেনের বর্তমান আগ্রাসন সেই হিসেবে ব্যতিক্রম। বিপুল সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব থাকা সত্ত্বেও, ইউক্রেনকে দখলে আনতে রাশিয়ার বেগ পেতে হচ্ছে। রাশিয়ার এই ধীরগতির কারণ ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ নয়। বরং সাধারণ জনগণের প্রতিরোধ, যা দিন ছড়িয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধত্তোর কালে কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে টিকে থাকতে সক্ষম হয় নাই। অন্য দেশ দখলের প্রচেষ্টা ব্যাপক অর্থনৈতিক ও লোকবল ক্ষয় ক্ষতি বিষয়টি সাধারণ ভাবে প্রমাণিত। ভিয়েতনামে আমেরিকার পরাজয় , আফগানিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পরাজয়, বিশ্বের শাসকদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় উল্লেখযোগ্য হতাহতের শিকার না হয়ে শহরগুলিতে সেনা মোতায়েন করা কার্যত অসম্ভব।

যুদ্ধ সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার কারণ। যুদ্ধবিরোধী মানুষের জন্য যুদ্ধের পক্ষ নির্ধারণ বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন। শান্তিবাদী হিসেবে পরিচিতরা সবসময়ে শান্তির শ্লোগান তোলেন। শান্তির বিকল্প নেই। তবে এই শান্তি কিসের বিনিময়ে? সাম্রাজ্যবাদী দেশে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন প্রবল। কিন্তু এই সব যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন নিজ দেশের শাসক গোষ্ঠীর যুদ্ধের মদত ও বাজার দখলের বিরোধিতা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে । বাংলাদেশের মত নয়া উপনিবেশিক দেশ গুলিতে যুদ্ধ বিরোধিতা জনমত প্রবল। এই বিরোধিতা অনেক সময় এক রৈখিক। বিরোধিতার প্রধান স্রোত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। প্রায়শঃই যুদ্ধে অন্য সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা অনালোচিত থেকে যায়। বাংলাদেশের মত দেশ গুলি গুলির সরকার পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অংশ নেয় ” শান্তি রক্ষী বাহিনী ” পাঠিয়ে । নয়া উপনিবেশিক দেশ গুলিতে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের যুদ্ধ বিরোধিতার সুস্পষ্ট মতামত থাকা প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বিরোধিতার স্পষ্ট দিক নির্দেশনার অভাবে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশ নেওয়ার বিষয় গুলির বিরোধিতা বামপন্থীদের মধ্যে অতি ক্ষীণ বা নাই বলেই চলে।

যুদ্ধ সম্পর্কে বামপন্থীদের নীরবতা ও নির্লিপ্ততা এই অঞ্চলের দেশ গুলিতে বামপন্থীদের নিজ দেশের শাসক গোষ্ঠীর পিছু নিতে সহায়তা করে। এই পিছু নেওয়ার রাজনৈতিক ফলাফল বামপন্থী চিন্তা চেতনার পরিপন্থী। এই অঞ্চলে ভারত -পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অবস্থা প্রায় সব সময় বিরাজ করছে। এই যুদ্ধের অন্যতম কারণ কাশ্মীর। কাশ্মীরের স্বাধীনতার সংগ্রাম। উভয় দেশের বামপন্থীরা যুদ্ধকালীন সময়ে নিজ দেশের শাসক গোষ্ঠীর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে। এই নিরেপেক্ষতার নিচে চাপা পড়ে কাশ্মীরের আত্ম -নিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম।

ইউক্রেন অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ। একটি নয়া উপনিবেশিক দেশ। ১৯৯১ সালের শেষার্ধে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্রের কলঙ্কজনক পতন ঘটে। এই পতনের পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠা পূর্ব ইউরোপের বিকৃত শ্রমিক রাষ্ট্রের পতন ঘটে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর থেকেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিচরণ ক্ষেত্র ইউক্রেন। গত তিন দশকে রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অবস্থা কাটিয়ে উঠে নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ার উত্থান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী এই হুমকি মোকাবেলায় ইউক্রেনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এই জড়িয়ে পড়ার সর্বশেষ অবস্থান হচ্ছে রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অবরোধ। এই ভাবেই একটি নয়া উপনিবেশিক দেশে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের আগ্রাসন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে পড়েছে। বিপ্লবী সমসমাজবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কোন পক্ষকেই সমর্থন করতে পারে না। এই যুদ্ধে বামপন্থী শক্তির প্রধান শ্লোগান হওয়া উচিত উভয় পক্ষের বৈপ্লবিক পরাজয়। রুখো রুশ ,হটাও ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদ।

বামপন্থীরা স্বাধীন ইউক্রেনের সংগ্রামকে সমর্থন করবে । রাশিয়ার আগ্রাসনকে প্রতিরোধে ইউক্রেনের জনগনের স্বতন্ত্র উদ্দ্যোগ সব সময়ের জন্যই একমাত্র পথ। ইউক্রেনের জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। কারণ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে ভাল নয়। এটি অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো বা ইইউ দ্বারা আধিপত্য ইউক্রেনীয় জনগণকে বিদেশী শাসনের অধীনে রাখবে । এবং এটি অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে কারণ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে সত্যিকারের বিজয় হতে পারে না।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বামপন্থীদের প্রধান শ্লোগান হতে হবে ” নিজ দেশের শাসক গোষ্ঠী প্রধান শত্রু। ” নিজ দেশের শাসকদের দিকে বন্দুক ঘুরিয়ে দাও। ” ১৯১৪-১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার বলশেভিকরা এই শ্লোগান দিয়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বিশ্বব্যাপী বামপন্থী শক্তি অতি দুর্বল। সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতার অজুহাতে সঠিক যুদ্ধ বিরোধী নীতি থেকে দূরে থাকার অর্থ হবে আত্মধ্বংসী।

অপু সারোয়ার : ফ্রিল্যান্স লেখক