শিল্প সাহিত্য

শ্রদ্ধায় – স্মরণে বেগম মুশতারী শফি

– অধ্যাপক লতিফা কবির

শহীদ জায়া ও ভগ্নি এবং একাত্তরের শব্দ সৈনিক নামে পরিচিত বেগম মুশতারী শফির অসুস্থতার খবরটি ফেইসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। শুনেছিলাম তাঁর শারীরিক অবস্থা সংকটজনক। তাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। কিডনি ও রক্তে সংক্রমণসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, বেশ কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেন। সংবাদটি ছিল খুবই আনন্দের। কিন্তু কয়েকদিন পরই আপার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার মতো সকলেই আশা করেছিলেন সুস্থ হয়ে তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁর আর ফেরা হলো না। ২০ ডিসেম্বর সোমবার ২০২১ সাল বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে লাইফ সার্পোট থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু সংবাদ প্রথম শুনি আমার ননদের কাছ থেকে। মুশতারী আপার পরিবার এবং আমার ননদের পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো।
এই মহীয়সী নারী বেগম মুশতারী শফি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল ডলি। পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুর জেলার গেরদা নামক গ্রামে। বেগম মুশতারী শফি ১৯৩৮ সাল ১৫ জানুয়ারি ভারতের মালদাহ জেলার কালিয়াচক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খন্দকার নাজমুল হক আনসারী অবিভক্ত ভারতবর্ষের পুলিশের ডিএমপি ছিলেন। মাতার নাম ছিল আরেফা খাতুন। পিতামহ খন্দকার হেলাল উদ্দিন আনসারি সাব-রেজিষ্টার পদে চাকুরি করতেন। মাতামহ খান বাহাদুর কাজী আাজিজুল হক অবিভক্ত ভারতবর্ষের এস.পি এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পিতার চাকরি সূত্রে তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। মাত্র তিন মাস বয়সে মাতৃহারা এবং ১০ বছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। পিতৃ-মাতৃহারা মুশ্তারী শফির একাডেমিক শিক্ষা বেশিদূর পর্যন্ত এগোতে পারেনি। পিতৃ বিয়োগের পর ছিন্নমূল জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৫৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ডেন্টাল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ শফির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এনায়েতবাজার এলাকায় শফি লজ – এ সংসার জীবন শুরু করেন। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। বিয়ের সতের বছরের মধ্যেই তিনি সাত সন্তানের জননী হলেন। সাত সন্তানের মধ্যে ৩ জন ছেলে ও ৪ জন মেয়ে। বাস্তব জীবনে এরা সকলেই মোটামুটিভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সংসার ধর্ম পালনের পাশাপাশি ১৯৬০ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে সমমনা বেশ কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে ”বান্ধবী সংঘ” নামে মেয়েদের জন্য একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। সেখানে নারীদের হস্তশিল্প যেমন- সেলাই , উলের মেশিনে উলের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তাছাড়া সংগীত ও যন্ত্র সংগীতের উপরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো । ১৯৬৪ সালে নারীদের লেখালেখি নিয়ে ’বান্ধবী” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজেই। ফলে ছোটকালের লালিত স্বপ্ন সম্পাদক ও প্রকাশক হবার ইচ্ছেটা পূরণ হলো বিয়ের পর স্বামীর গৃহে আসার পর। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে প্রায় এগার বছর বান্ধবী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। শুধু তাই নয় কয়েকজন নারীকে নিয়ে ছাপাখানার কাজ শিখিয়ে ”মেয়েদের প্রেস” নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকেই তাঁর নিজের পত্রিকা ’বান্ধবী’ প্রকাশিত হতো। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি তিনি নিজেও লেখালেখি করতেন। ছোটবেলায় শিশু সওগাত পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে লেখক হবার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তিনি অল্প বয়স থেকেই গল্প, কবিতা লেখালেখি শুরু করেন। উচ্চ শিক্ষা কিংবা ব্যাপক অধ্যয়ন ছাড়াই তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন। তিনি মোট ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্য থেকে ৪টি বই মুশতারী আপা নিজ হাতে আমাকে দিয়েছিলেন মহিলা পরিষদের পাঠাগারে রাখার জন্য।
বই ৪টির নাম ছিল ১) আমি সুদূরের পিয়াসি ২) মুক্তিযুদ্ধের গল্প ৩) একুশের গল্প ও ৪) আমার প্রতিশোধের আগুন। বই ৪টি পেয়ে আমি অপার আনন্দ অনুভব করেছিলাম।
১৯৬৯ সাল গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার বিরোধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুশতারী শফি নারীদের উদ্বুদ্ধ করে সংগঠিত করেন। ১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রথম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পরিকল্পনা হয় তাঁর বাসভবন চট্টগ্রাম ’মুশতারি লজ’-এ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক বেগম মুশতারি শফি এতো কিছু করতে পারার পিছনে অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল স্বামী ডাঃ মোহাম্মদ শফি সাহেবের। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এই মানুষটি নারী প্রগতি, নারী শিক্ষা ও দারিদ্র বিমোচনের বিষয়টি নিয়ে সবসময় ভাবতেন। স্বামীর সহযোগিতা ছিল বিধায় তৎকালীন যুগে শত বাধা বিপত্তি থাকা সত্বেও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে কোনো বাধাই বেগম মুশতারি শফিকে দমিয়ে রাখতে পারে নাই।
বাম রাজনীতির সমর্থক বেগম মুশতারি শফি সমাজতন্ত্রে বিস্বাসী ছিলেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর গোলাবারুদ ’মুশতারি লজ’-এ সংরক্ষণ করা হতো। বিষয়টি দেখে ফেলে প্রতিবেশী অবাঙ্গালি ও পাকিস্তানি সেনারা। ৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী ’মুশতারি লজ’-এ হানা দিয়ে স্বামী ডাঃ মোহাম্মদ শফি ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাই খন্দকার এহসালুন হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যান।

সাহস ও মনোবল না হারিয়ে অসীম সাহসী নারী বেগম মুশতারি শফি সাত শিশু সন্তানকে নিয়ে শরণার্থী মিছিলে যোগ দিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। সেখানে ফাস্ট – এইড ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানসহ শরণার্থী শিবিরে দুঃস্থদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। যুদ্ধ শেষে বিজয়ের গর্ব বুকে নিয়ে ২০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের নিজ বাড়ি ’মুশতারি লজ’- এ ফিরেন। দেশে ফিরে স্বামী এবং ভাইকে ফিরে পাবার আশা ত্যাগ করে নারী মুক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে যান।

চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক বেগম মুশতারি শফি ২০০৯ সাল থেকে উপদেষ্টা হিসেবে মহিলা পরিষদের পাশে থেকে এই সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্ঠা করেন। যে কোনো সমস্যায় আপার সান্নিধ্যে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছি। মহিলা পরিষদের যে কোনো অনুষ্ঠানে মুশতারি আপাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ দেওয়া হলে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই তা গ্রহণ করতেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর দুই পুত্র বধু মমতাজ শফি ও ফৌজিয়া শফি দুইজনেই মহিলা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
বেগম মুশতারি শফি অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন ও ধারণ করে আমুত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা মাথাচড়া দিয়ে উঠলে বিভিন্ন শ্রেণী পেশা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সংঘবদ্ধভাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূলে আন্দোলন কমিটি গঠন করেন। চট্টগ্রামে এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বেগম মুশতারী শফি। কেন্দ্রে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁর মৃত্যুর পর আন্দোলন স্তিমিত হলে উক্ত কমিটির কেন্দ্রের আহ্বায়ক হন বেগম মুশতারি শফি। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন পুনরায় গতি পায়।
তিনি মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার আজীবন উপদেষ্টা, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর ও উদীচীর চট্টগ্রাম এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালে সদস্য হিসেবে যুক্ত থেকে আজীবন মানব সেবায় আত্ম নিবেদন করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত হলি ফ্যামিলি টিউটোরিয়াল স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০১৬ সালে সম্মাননা স্বরূপ তাঁকে ’ফেলোশিপ’ প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালে মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। নারী জাগরণের জন্য ’বেগম রোকেয়া’ পদক পুরষ্কার পেয়েছেন ২০২০ সালে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন ২০১১ সালে। বীরকন্যা প্রীতিলতা পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন ২০০৬ সালে।
’সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক – মানবতা মুক্তিপাক
প্রতিবাদে প্রতিরোধে পথে এবার নামো সাথী’
এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ৬ নভেম্বর ২০২১ সালে চট্টগ্রাম ডি সি হিলে গণসমাবেশ ও মিছিল হয়েছিল। এই গণসমাবেশে মুশতারি শফি আপা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ইহাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমাবেশ। এই গণসমাবেশেই মুশতারি আপার সাথে আমার শেষ দেখা এবং কথা হয়। এর কিছুদিন পরেই আপা অসুস্থ হয়ে পড়লে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে আশঙ্খাজনক অবস্থায় ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সবাইকে হতাশ করে চিকিৎসতারত অবস্থায় ৮৪ বছর বয়সে স্বাধীনতার সূর্যকন্যা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বিজয়ের মাসেই প্রয়াত হলেন। মুত্যুর পূর্বে মেজ ছেলের বউ ফৌজিয়া শফি ২৬জুন ২০১৭ সালে ও বড় ছেলে এরাদ ইয়াসিন শফি ২২ আগষ্ট ২০১৭ সালে মারা যান। মৃত্যুকালে চার কন্যা সন্তান ও দুই পুত্র সন্তানসহ অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন নারী ও সাংস্কৃতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়। মানুষ মরণশীল, কর্মের মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি দেখে যেতে চেয়েছিলেন জামায়েত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপন হোক।  স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান প্রজন্ম উদ্যোগী হবে এটাই প্রত্যাশা।

এই মহীয়সী নারীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে বলতে চাই –
”তুমি রবে নিরবে, হৃদয়ে মম…………………………..”

 

লেখক, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।