বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩২)

-বিজন সাহা

বেশ কিছুদিন আগে এক বন্ধু একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িক হওয়া সহজ না। তখন থেকেই কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর ভাবছিলাম, এটাকি আদৌ সম্ভব? আর সম্ভব হলে কতটুকু? কেননা পৃথিবীতে সবই তো আপেক্ষিক, চূড়ান্ত বলে কিছু তো নেই? তাছাড়া অসাম্প্রদায়িক এটাতো সম্প্রদায়হীনতা নয়, এটা সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা। এর পর আরেক বন্ধু ফোন করল। বিভিন্ন কথা হল। আমাদের আলাপ হয় মূলতঃ লেখা নিয়ে,  তার কবিতা নিয়ে আর সেই কবিতায় মাঝে মধ্যে আমার টিপ্পনি নিয়ে। আমি বরাবরই বন্ধুদের চিমটি কাটতে ভালোবাসি। সেই বন্ধুর ভাষায় কোন ধর্মের মধ্যে থেকে অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না, কেননা আমরা যারা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করি তারা বলি সব ধর্মই সমান, কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় নিজের ধর্মটা একটু বেশী সমান। কথাগুলো ঘুরতে লাগল মাথায়। আমার মাথায় মনে হয় কথার থেকে ফর্মুলা বেশী তাই চেষ্টা করলাম ওদের কোনো ফর্মুলায় ব্যাখ্যা করা যায় কি না।

আসলে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ কখনই সম্প্রদায়হীন ছিল না, থাকা সম্ভব নয়, যদি না সে রবিনসন ক্রুসোর মত একা এক নির্জন দ্বীপে থাকে। আমরা মানুষেরা সবাই কোন না কোন গোষ্ঠীভুক্ত, তা সে আমরা চাই আর নাই চাই। ধর্ম বা জাতি বা ভাষা – এসব তো আছেই, এছাড়াও দেখবেন অনেকেই ঘুম থেকে উঠেই রাশিফল দেখছে, আর ওটা দেখেই শুরু করছে নিজের দিন। অন্য কোন জীব নিজেদের এমনভাবে ভাগ করে বলে জানা নেই, শুধু মানুষই বিভিন্ন উপায়ে নিজেকে ভাগ করে। শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খলিত করে। সেটা ধর্মেই হোক, বর্ণেই হোক, রাশিতেই হোক, ফুটবল ফ্যানই হোক বা আলফাবেটিক ক্রমানুসারে হোক। এভাবেই মানুষের বুদ্ধিই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মনে হতে পারে, ভালোই তো হত, যদি সবাই একই রকম হতাম। বাস্তব বলে ভিন্ন কথা। মনো এথনিক, মনো রিলিজিয়াস দেশের তো অভাব নেই পৃথিবীতে। তাতে কি তাদের সমস্যার সমাধান হয়েছে? হয় নি? মতের ভিন্নতা আছে বলেই জীবনে বৈচিত্র্য আছে, আছে অনেক কিছুর মধ্য থেকে আপেক্ষিকভাবে যা ভালো তা বেছে নেবার সুযোগ। মনোপলি শুধু কিছু লোককে ভালো রাখে, সবাইকে নয়। ধরুন ঢাকা থেকে চিটাগাং যাবার জন্য আমরা বিশাল এক রেলগাড়ী তৈরী করলাম, একেবারে ঢাকা থেকে চিটাগং পর্যন্ত। টেকনিক্যালি সম্ভব একটা বগির সাথে আরেকটা জোড়া দিয়ে। উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, যাতে সবাই এক সাথে যেতে পারে। এই গাড়িতে সবাইকে উঠানো যাবে, তবে গাড়ি চলবে না। সমাজটাও তাই। সমান সুযোগ মানে সবাই একই কাজ করছে তা নয়, সবাই নিজ নিজ কাজ করছে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। আসল কথা কে করছে তা নয়, কি করছে, কি লক্ষ্যে করছে।

আমার সেই বন্ধুর কথায় মনে হয়েছিল, ধর্মীয় গন্ডীর মধ্যে থেকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নাস্তিক হলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? নাস্তিকতাও কিন্তু ধর্মের সাথেই জড়িত, ধর্মকে অস্বীকার করার মধ্যেই রয়েছে তার জীবনী শক্তি। এই নাস্তিকতারও বিভিন্ন মাত্রা আছে, যেমন বিভিন্ন মাত্রা আছে ধার্মিকের। আর যেহেতু প্রতিটি মানুষই ডিএনএ পর্যায়ে ভিন্ন, তাই সব সময়ই কিছু লোক কিছু লোকের সাথে চলতে পছন্দ করবে, অন্যেরা অন্যদের সাথে। সাম্প্রয়াদিকতা জন্ম নেয় যখন কেউ নিজের পথটাকে শুধু একমাত্র সঠিক পথ বলে মনেই করে না অন্যদেরও সেই পথে চলতে বাধ্য করার চেষ্টা করে বা অন্য পথে যারা চলছে তাদের অন্ধভাবে ঘৃণা করে। এটা শুধুই নতুন বিভাজনের সৃষ্টি করে, সমস্যা সমাধান করে না। অন্য প্রাণীদের কথা জানি না, তবে মানুষ বিভাজনটা ভালো বোঝে, মানুষে মানুষে ভেদ ভালো বোঝে, আর যখনই এই বোধটা আসে যে আমি অন্যের মত নই, তখনই আমি কারো বিরোধিতা না করলেও কেউ না কেউ আমার বিরোধিতা করবেই। না করলে তো আর ভেদ থাকত না। অভিজ্ঞতা বলে, দু’ জন লোক একসাথে গোপনে কোন কথা বললেই উপস্থিত তৃতীয় লোকটা মনে করে এটা নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে, যদিও হতে পারে তারা গোপনে বলছে কারণ তৃতীয় ব্যক্তি এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলে। কাকু বলতেন, পালাবে কোথায়? হ্যাঁ, আমাদের মানুষের মানসিকতাই এমন যে পালানোর কোনো উপায় নেই। গোছালো গৃহিণীর মত আপনাকে ঠিকই নির্দিষ্ট সেলফের নির্ধারিত কোনায় রেখে দেবে আর হাজারটা কারণ বের করবে আপনাকে কেন ঠিক এই কোনটাতেই ঠিক এই নাম নিয়ে পড়ে থাকতে হবে।

তাহলে কি কোনই উপায় নেই? আছে। তবে তা দলত্যাগ করে না, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ত্যাগ করে না, সম্প্রদায়ে থেকেই। এক স্ট্যাটাসে কে যেন লিখেছিলো, “আপনি কোন দেশে থাকেন? কাশ্মীর নিয়ে বলেন না কেন? কোথায় রেমিটেন্স পাঠান?” সমস্যাটা ওখানেই। আমাদের সব কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে হিন্দু-মুসলিম আর ভারত-পাকিস্তান কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ এ ভারত থেকে বেরিয়ে এসেও মানসিক ভাবে আমরা বেরুতে পারি নি, অবচেতন মনে সেই ভারত বিরোধিতাও এই সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিচ্ছে। অনেক পোস্টেই দেখি বিএনপির আমলে এসব হত, কিন্তু এখন কেন হয়? যেন বা হিন্দুর বাড়ী বিএনপির আমলে পুড়ালে ওটা জায়েজ। আর এই কথাটা অনেকে মনে প্রাণে নিয়তি বলে বিশ্বাস করে। আর তা দুই পক্ষ থেকেই। কিন্তু কোন নাগরিকই বিএনপিকে যেমন যমদূত হিসেবে দেখতে চায় না, আওয়ামী লীগকেও তেমনি ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখতে চায় না। তারা চায় আর দশ জন নাগরিকের মতই কে ক্ষমতায় সেটা না ভেবে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে, দেশকে ভালোবাসতে। তাদের কোন বিশেষ সুবিধার দরকার নেই, যে সুবিধা-অসুবিধা অন্যরা পাচ্ছে, সেটুকু নিশ্চিত করলেই হবে। আর দেশের মানুষের কাছে থেকে, বিশেষ করে প্রগতিশীল মহল থেকে যেটা চায় তা দেশে আইনের শাসন কায়েমের আন্দোলন জোরদার করা। তাদের কাছে যেন কি কাজ করা হচ্ছে সেটাই মুখ্য হয়, কে করছে তা নয়। তাহলে তারা অত্যাচারী আর নিপীড়িতের দল, মত, ধর্ম, গোত্র দেখবে না। যেদিন অপরাধী তার দল, মত, ধর্ম, গোত্র নির্বিচারে অপরাধের জন্য শাস্তি পাবে আর উৎপীড়িত তার দল, মত, ধর্ম, গোত্র নির্বিচারে উৎপীড়নের বিচার পাবে তখন আর কাউকেই সাম্প্রদায়িক বা অসাম্প্রদায়িক হতে হবে না।

এক জন মানুষ ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে এটা ভাল, এটা মন্দ – আর সেটা সে পেয়েছে সেই পরিবারের ধর্মীয় পরিমন্ডল থেকেই। শিশুকালে শোনা এসব কথা মনে এমন ভাবে বসে যায় যে ইচ্ছা অনিচ্ছায় সেটা সারা জীবন পাশে পাশেই হাঁটে। এখান থেকেই গড়ে ওঠে খাদ্যাভ্যাস, গড়ে ওঠে আচার ব্যবহার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। ভালবাসা, ঘৃণা – এসবও এখান থেকেই গড়ে ওঠে, কারণ শিশু দেখে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের পারস্পরিক আচরণ। এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক নেই আবার আছেও। যেমন আমাদের দেশে হিন্দু পরিবারগুলোয় জল মুসলমান পরিবারে পানি হয়ে যায়। শব্দ কোন ধর্মীয় প্রতীক বহন করে না, তবে এটা কে কোন সম্প্রদায়ের সেটা বলে দেয়। আমি শাঁখা সিঁদুর ছাড়া মা বৌদিদের কল্পনা করতে পারি না। ওভাবেই তাদের দেখেছি আজীবন। আবার পাশের বাড়ির বন্ধুদের মা বোনেরা শাঁখা সিঁদুর ছাড়া দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। শাঁখা সিঁদুর বা বোরকা যদিও একান্তই পোশাক যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, ধূতি – তারপরের এসবের নিরীহ ব্যবহারও অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা উস্কে না দিলেও মানুষের কটাক্ষ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুনেছি আমাদের বন্ধুদের স্ত্রীরা শাঁখা সিঁদুর পরলে তারা যেমন অনেকের তির্যক দৃষ্টির সম্মুখীন হয়, তেমনি প্রগতিশীল বলে পরিচিত কোন মুসলিম বন্ধুর স্ত্রী বা মেয়ে বোরকা বা হিজাব পরলে তারাও একই রকম সমালোচিত হয়। আর এর বড় কারণ আমার মনে হয় আমরা অতি বেশি রকম অন্যদের ব্যাপারে নাক গলাই। আর এটা ধর্মীয় থেকেও বেশি করে জাতীয়। এটা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ। শহরে বাস করলেও আমরা এখনও পর্যন্ত সেই গ্রামীণ মনমানসিকতা, মানে যেকোনো ব্যাপারে বিচার সালিসের মনোভাব, ত্যাগ করতে পারিনি। স্বকীয়তা বজায় রাখা যেমন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ ও জাতির জন্য। তবে এটাই অন্যের চোখের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা অনেকটা গায়ের রঙের মত, নিজেরা খেয়াল না করলেও অন্যেরা খেয়াল করে, নিজে যেটাকে স্বাভাবিক মনে করি অন্যের চোখে সেটা বেখাপ্পা লাগে।

আজকের সাম্প্রদায়িকতা এক সামাজিক ব্যাধি। সামাজিক অবিচার বা বিচারহীনতা আর সর্বত্র স্বজনপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানের অর্থনৈতিক উন্নতি মানুষকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করছে না, আর এই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ সংখ্যালঘু বা সমাজের দুর্বল অংশের (যেমন নারী) প্রতি আক্রমণ। আর এই আক্রমণকারীরা নিজেরাও অধিকাংশই দুর্বল মানুষ, যারা জীবনে ব্যর্থ, কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে, দলের দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ নামক ঘোড়ার কাঁধে সওয়ার হয়ে পদদলিত করছে এই সংখ্যাগরিষ্ঠের তৈরী আইন-কানুন, সংবিধান। অকারণে গাড়ির চাকায় পিষ্টে মারছে একই পরিবারের অনেকগুলো ভাইবোনকে, অসহায় করছে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে, ভীতির সঞ্চার করছে আরও অনেক বেশি মানুষের মনে। এরা শুধু সংখ্যালঘুদেরই অসহায় করছে না, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ  ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে তাদেরও মান-সম্মান। কিন্তু অর্থ আর ক্ষমতার চোখ ধাঁধানো আলোয় অন্ধ এই মানুষগুলো হয়তো এটা উপলব্ধি করার বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।

হ্যাঁ, অসাম্প্রদায়িক হওয়াটা সত্যিই খুব খু-উ-ব কঠিন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো