মতামত

সীমানা পেরিয়ে   কর্নেল তাহের যখন রাজনৈতিক পণ্য এবং এসইউ সিআই – জাসদ – বাসদ রাজনীতি

-অপু সারোয়ার

শুরুর কথা

মিথ্যা ও মিথ -কল্প কাহিনী দুইটি পরিপূরক বিষয়। ঘাটশিলা- পশ্চিম বাংলা SUCI কংগ্রেসে নভেম্বর ২০১৯ সালে মুবিনুল হায়দার মিথ্যা ভাবে নিজেকে কর্নেল তাহের মামলার সাথে যুক্ত দাবি করে বলেন ” কর্নেল তাহেরের মামলায় আমার নামও যুক্ত হয়ে যায়।” গণদাবী ৭১ বর্ষ ২০ সংখ্যা । গণদাবী  এসইউসিআই এর মুখপত্র।  এসইউসিআই এর পুস্তিকা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মরণে, পৃষ্টা ৬০ একই বক্তব্য মুদ্রিত হয়েছে। প্রকাশ কাল , সেপ্টম্বর ২০২১।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্নেল তাহের – জাসদ আলোচিত বিষয়। জাসদ ভেঙে বাসদের সৃষ্টি ১৯৮০ সালে। মুবিনুল  হায়দার বহুধা বিভক্ত বাসদ – মার্ক্সবাদী নামের দলের প্রধান ছিলেন। এই লেখায় মুবিনুল হায়দারের বক্তব্য ও জাসদ – বাসদের রাজনীতির বিচারমূলক পর্যালোচনায় করা হয়েছে। মুবিনুল হায়দারের রাজনৈতিক ভাবনাকে জানা বোঝার জন্য তেমন কোন বই পুস্তক নেই। মুবিনুল হায়দার চৌধুরী তেমন বেশি কিছু লিখে যান নাই। তাঁর প্রকাশিত কোন রচনা গ্রন্থ নেই। এই আলোচনার প্রধান তথ্য সূত্র হিসেবে

মুবিনুল  হায়দার চৌধরীর সাক্ষাৎকার – সাপ্তাহিক ঈদুল ফিতর সংখ্যা ,৩০মে ২০১৯ এবং কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মরণে এসইউসিআই পুস্তিকা, প্রকাশ কাল : সেপ্টেম্বর ২০২১ ব্যবহার করা হয়েছে।

ঢাকাকলিকাতার সম্পর্ক

কলিকাতার -পশ্চিম বাংলার সাথে ঢাকা – পূর্ব বঙ্গের সম্পর্ক নানান রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। কলিকাতার সাথে ঢাকা – পূর্ব বাংলার  অধীনতা কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগ করেছিল। বাংলা ভাগের রাজনৈতিক আবেগ ইতিহাস বহুল আলোচিত ও পঠিত। এই ঘোষণার পিছনে উপনিবেশিক প্রশাসন ও দমন পীড়ন সংহত করার অপ্রকাশিত পরিকল্পনা উড়িয়ে দেওয়ার কোন কারণ নেই। তবে পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠন ছিল অর্থিনীতি ও শিক্ষা- দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা পূর্ব বাংলা ও আসামে  অবকাঠামো গত উন্নয়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ।  বাঙালী মধ্যবিত্তের বিকাশে শংকিত কলিকাতা কেন্দ্রিক প্রধানতঃ মধ্যবিত্ত নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা গঠনের বিরোধিতায় নামেন। এই বিরোধিতার মূলে কলিকাতার অর্থনীতিতে  পূর্ববাংলার অবদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনার শংকা । নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা গঠিত হওয়ার সাথে সাথে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে জায়গা – সম্পত্তির দাম কমে আসার কথা।

 

অর্থনৈতিক কারণে   নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা গঠনের বিরোধীয় নামে বাঙালী মধ্যবিত্ত। ঘটনা ক্রমে এই মধ্যবিত্তের প্রায় পুরো অংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আসা।  আর নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা গঠনের সুবিধা বঞ্চিতদের বড় অংশ ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী আর তফসিলী হিন্দু সম্প্রদায় । পেশায় কৃষিজীবী। বাংলাভাগের উপনিবেশিক ষড়যন্ত্র যে পরিমান প্রতিক্রিশীল ছিল ঠিক ততোধিক প্রতিক্রিশীল ছিল পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের  অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিরোধিতা। ১৯০৫ সালের  বাংলাভাগের বিরোধিতা এই অঞ্চলের হিন্দু – মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে প্রচন্ড ভাবে উস্কে দিয়েছিল। যা পরবর্তী তিন চার দশক নানা চড়াই – উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাগ এবং  ভারত- পাকিস্থান রাষ্ট্র সৃষ্টির  প্রভাবকের কাজ করেছিল।

বাংলাদেশে শিল্প সাহিত্যে কলিকাতার প্রভাব অতীতেও ছিল এখন আছে। সীমান্তের উভয় পাড়ের সাম্প্রদায়িক শক্তি নানা অজুহাতে বিভক্তি রেখা টানতে চেষ্টা করেছে। সম্ভবতঃ একটি মাত্র জায়গায় বিভেদকারীরা তেমন সুবিধা করে উঠতে পারে নাই।

১৯৪৭ সালে ভারত – পাকিস্তান সৃষ্টির পরে পূর্ববাংলার স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠার শুরু। ধীরে ধীরে শিল্প সাহিত্য ও বুদ্ধিবিত্তিক চর্চার বাংলদেশ ধারা বিকশিত হয়। এই বিকশিত ধারার সীমাবদ্ধতা পৃথক আলোচনার দাবী রাখে।

মার্ক্সবাদী সাহিত্য আসার প্রধান দুইটি পথ ছিল । একটি ছিল মস্কো থেকে প্রকাশিত বাংলা বই। এই বই গুলি অপাঠ্য ছিল। বিকল্প না থাকায় মস্কো থেকে দৃষ্টি নন্দন দামী কাগজে প্রকাশিত বই গুলি ছিল মার্ক্সবাদী হিসেবে গড়ে উঠার প্রধান অবলম্বন। । এই বই গুলির অনুবাদ ছিল অনেক অংশে সাম্প্রদায়িক। বাংলা অনুবাদের সময় বিভিন্ন জনের নামের সাথে শ্রী জুড়ে দেওয়ার নজির ভুরিভুরি। আর ছিল পিকিং – চীন থেকে প্রকাশিত প্রধানতঃ মাও সেতুং এর বই। পিকিং – চীন থেকে প্রকাশিত বই গুলির অনুবাদ ভাল ছিল। এই দুই ধারার বাইরে ছিল কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মার্ক্সবাদী বাংলা বই । ভাল অনুবাদ ও সহজ পাঠ্য ছিল এই বই গুলি। বাংলাদেশে মার্ক্সবাদ প্রচারে কলিকাতা কেন্দ্রিক প্রকাশনার ভূমিকা অনেক।

জাসদবাসদ

 স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত প্রথম রাজনৈতিক দল। ৩১ সালে ১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছিল জাসদ । জাসদের রাজনৈতিক ধারার শুরু ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ধারার মধ্যে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের শেখ মুজিবের শাসনের বিরুদ্ধে জন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জাসদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ী ঘেরাও, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা বিদ্রোহের ঘটনার সাথে জাসদের নাম জড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক সংগ্রামে জাসদের হাজার হাজার কর্মী নির্যাতন ও কারাভোগের শিকার হয়েছিল। জাসদের বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী প্রতিপক্ষ ও সরকারী বাহিনীর হাতে খুনের শিকার হয়েছেন। কত জন কর্মী খুন হয়েছেন এর সঠিক কোন পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত তালিকা নেই। জাসদ শুরু থেকে জাতীয় সরকার এর দাবী তুলেছিল। এই দাবীকে ঘিরেই বিভিন্ন সময়ে জাসদের বড় ভাঙ্গন হয়েছিল। ১৯৮০ সালের জাতীয় সরকারের বিতর্কে জাসদ ভেঙে বাসদ তৈরি হয়। এর পরে গত চল্লিশ বছরে জাসদের ভাঙ্গন হয়েছে বেশ কয়েক বার।

বাসদ উদ্যোক্তরা বিভিন্ন  বিষয়ে জাসদের সমালোচনা করে দলের শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে বাসদের প্রথম ভাঙ্গন হয়। ভাঙ্গনের পর বাসদের উভয় অংশই ১৫ দলীয় জোটের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। উভয় বাসদ ও জাসদের একাংশ মিলে বাম ফ্রন্ট গঠন করে ১৯৯৬ সালে। বামফ্রন্ট ‘ বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীলতার ‘ পক্ষে সাফাই গেছেন।  এর পর বাসদের উভয় অংশ বেশ কয়েক বার ভাঙ্গনের মধ্যে দিয়ে গেছে। এমনি এক ভাঙ্গনের ফলশ্রুতিতে মুবিনুল হায়দার বাসদ – মার্ক্সবাদীর প্রধান নেতা হন।

এসইউসিআই

 শিবদাস ঘোষ: ভারতের সোসালিষ্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া -SUCI এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৮ সালে এপ্রিল মাসে এসইউসিআই এর প্রতিষ্টা। এসইউসিআই গঠনের পূর্বে শিবদাস ঘোষ ভারতের বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল -আরএসপি এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন অনুশীলন সমিতির মধ্যে ১৯২০-১৯৪০ এর মধ্যবর্তী সময়ের মতবাদিক সংগ্রামের ফলশ্রতিতে আরএসপি গঠিত হয়েছিল। অনুশীলন সমিতি ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আদর্শে গঠিত একটি সশস্ত্র ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠন। মূলতঃ ঢাকা ও কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে এই দলটি বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সংগঠিত হয়। … অনুশীলন দলের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ।

আরএসপি গঠন ছিল সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকরণ ও মার্ক্সবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়া। আরসিপি স্তালিনের নেতৃত্বধীন সোভিয়েত রাষ্ট্র ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ন্যায্য সমালোচক ছিল। তবে আরএসপি ট্রটস্কী বাদী চতুর্থ আন্তর্জাতিকের অনুসারী ছিল না। এসইউসিআই ছিল আরএসপির প্রথম ভাঙ্গন। আরএসপির স্তালিনবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে স্তালিন পন্থা গ্রহণ করে এসইউসিআই । তবে রণনীতি রণকৌশল হিসাবে আরএসপির অনেক কিছুই বহাল রাখে।

বিশেষ করে স্তালিন বাদী দ্বিস্তর বিপ্লবের তত্ব। আরএসপি স্থায়ী / নিরন্তন বিপ্লবের তত্ব গ্রহণ করেছিল । তবে আরএসপির স্থায়ী / নিরন্তন বিপ্লবের ব্যাখ্যা লিওন ট্রটস্কির ব্যাখ্যা বা ধারাবিবরণী থেকে পৃথক ছিল। চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সাথে নিজেদের পার্থক্য স্পষ্ট করতে আরএসপি শুরুতে সক্রিয় ছিল। আরএসপি-র ভাষায় ” স্তালিনবাদ পরিত্যাগ অর্থ ট্রটস্কীবাদ  গ্রহণ নয়।”. (Origins of the Revolutionary Socialist Party by Buddhadeva Bhattacharya ) এসইউসিআই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ব আরএসপি -র অবদান। স্তালিনবাদীরা স্থায়ী/নিরন্তন বিপ্লবকে এক ধাপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত আক্রমণ করে থাকে। যার কারণে জাসদ -বাসদকে ‘ বনেদি ‘ কম্যুনিস্টরা কখনো-কখনো ট্রটস্কীবাদী হিসেবে অপবাদ দিয়ে আসছে। প্রকৃত অর্থে জাসদ -বাসদ স্তালিনবাদী দল।

 জাসদএসইউসিআই সংযোগের পারিপার্শ্বিকতা

বাংলাদেশের বামপন্থী দলের সাথে ভারতীয় বামপন্থী দলের সম্পর্ক ও নির্ভরতা ছিল বা আছে। এই নির্ভরতা ঐতিহাসিক। কোলকাতার কাছে বাংলার অন্য অংশের অধীনতার সাথে জড়িয়ে আছে এই সম্পর্ক -অধীনতা । পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশ অঞ্চলে ব্যাপক হারে পড়েছিল। সিপিবি এর সাথে সিপিআই , সিপিএম এর সাথে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি ( ওয়ার্কার্স পার্টির পূর্বসূরী ) , সিপিআই ( এম -এল ) নকশাল এর সাথে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল ) ও পূর্ব পাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টি (এম -এল ), আরএসপির সাথে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল এর সম্পর্ক ছিল। দুই দেশের পার্টির মধ্যে এই সম্পর্ক গুলি কোন গোপন বিষয় ছিল না।

এর বাইরে মোটামুটি সাংগঠনিক অবয়ব নিয়ে SUCI ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি অবস্থান ছিল। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন সৌরেন্দ্র নাথ ঠাকুর। পারিবারিক ভাবে সৌরেন্দ্র নাথ ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথের ভাইয়ের ছেলে। সৌরেন্দ্র নাথ ঠাকুর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ভারতীয় প্রতিনিধি। ১৯২৭ সালে স্তালিনবাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি – আরসিপিআই গঠন করেছিলেন । আরসিপিআই তুলনা মূলক ভাবে ছোট ছিল। স্তালিনবাদের সাথে ছেদ ঘটানোর জন্য আরসিপিআই ও সৌরেন্দ্র নাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ‘ প্রতিবিপ্লবী ‘ ট্রটস্কিবাদী ইত্যাদি কুৎসা তকমা দিয়ে প্রচারণা ছিল স্তালিন পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও এর গণ সংগঠন গুলি থেকে। । আরসিপিআই ও সৌরেন্দ্র নাথ ঠাকুর চতুর্থ আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন না। তবে ট্রটস্কির উপর অবিচার -নির্যাতনের সরব বিরোধী ছিলেন।

জাসদ উদ্যোক্তাদের সাথে যুদ্ধ পূর্বকালে অপরাপর বামপন্থীদের রাজনৈতিক সম্পর্ক নাজুক ছিল। আরএসপি – সমাজবাদী দলের লোক জন ভাগিয়ে নিয়ে যুদ্ধ পূর্ব কালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠিত হয়েছিল। সমাজবাদী দল নেতা সাংবাদিক নির্মল সেন আমার জবানী বইতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধপূর্বকালে বিএলএফ – ছাত্র লীগ (বৈ: স ) চটকল শ্রমিক ফেডারেশন থেকে নেতা ভাঙিয়ে নিয়ে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন। জাসদ তাত্বিক সিরাজুল আলম খান ‘ আমি সিরাজুল আলম খান বলছি বইয়ে নির্মল সেনের অভিযোগকে স্বীকার করে নিয়েছেন। সিরাজুল আলম খান অন্য দল থেকে ভাগিয়ে নেয়া -ভাঙিয়ে নেয়ার জন্য ‘ নোয়াখালী ‘ আঞ্চলিকতা কাজে লাগানোর কথা উল্ল্যেখ করছেন। তবে সিরাজুল আলম খান আঞ্চলিকতা কাজে লাগিয়ে যাদের দলে ভিড়ালেন সেই দল ছিল আরএসপি – পাটকল শ্রমিক ফেডারেশনের ।

১৯৭০ সালে পাবনায় নকশাল পন্থীদের হাতে আওয়ামীলীগ এমপি আহমেদ রফিক খুনের ঘটনা চীনপন্থীদের সাথে জাসদ গঠনের আগে ও পরে ঐক্যের সম্ভবনাকে বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের দিন গুলোতে ভারত প্রবাসে ও দেশের মধ্যে বামপন্থীদের আক্রমণের কথা বহুল আলোচিত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধত্তোর বাংবংলাদেশে সিপিবি আওয়ামীলীগের রাজনীতির সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। কোন স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বক্তব্য না থাকায় তৎকালীন সময়ে সংগঠিত শক্তি হওয়ার পরেও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক জমিন হারায়।

জাসদের জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সাল। তবে ছাত্রলীগ (বৈ :স ) ধারার রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুরানো। এই ধারার উথান ও বিকাশ পর্বে সকল বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির সাথে রাজনৈতিক বিরোধ থেকে মারামারির বিরোধ জড়িয়ে আছে। যুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক সম্পর্কের কারনেই জাসদের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও ধারণা সম্পর্কে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য কাছের কোন মিত্র ছিল না। আবার জাসদ গঠনের পর মস্কো- চীন পন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে প্রচন্ড নেতিবাচক প্রচার ছিল। জাসদের কাছে রাজনৈতিক জমিন হারানের কারণেই এই প্রচারণা তুঙ্গে ছিল। জাসদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলি লিখিত ভাবে বিস্তারিত প্রামানিক আলোচনা করতে অসমর্থতার পরিচয় দিয়েছে প্রতিপক্ষ ।

জাসদ গঠনের পর তত্বের প্রয়োজনে জাসদের দশ দিগন্তের ছোটাছুটির অংশ হিসেবে জাসদের সাথে SUCI এর সংযোগ ঘটে যায়। গতনাগতিক ধারায় বামপন্থী রাজনীতি করতে SUCI ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে জাসদের সাহায্য পাওয়ার কোন সম্ভবনা ছিল না। বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট থেকে দশ দিগন্তে ছোটাছুটি দুইয়ের মিলন ঘটায় ।

মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী জাসদ

মুবিনুল হায়দার চৌধুরী জাসদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন কিনাএই প্রশ্ন নানা সময়ে নানা ভাবে এসেছে। মুবিনুল হায়দার সব সময়ে জাসদ রাজনীতির সাথে নিজের সম্পৃক্ততা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টার কারণ হতে পারে কেউ ব্যর্থতার দায়ভার নিতে চায় না। ঘটনার সাথে যুক্ত থাকলে ঘটনার মূল্যায়ন ও সমালোচনার অনেক অংশ নিজের ঘাড়েও চাপে। প্রধানতঃ এই দুইটি কারণে অনেকের মত মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী জাসদের সাথে নিজের নাম জড়াতে চান না। মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী সাপ্তাহিক ঈদুল ফিতর সংখ্যা ৩০ মে ২০১ সাথে সাক্ষাৎকারে প্রথম পর্যায়ে জাসদের সাথে যুক্ত না থাকার বিষয় স্পষ্ট করে বলেছেন। যদিও সাক্ষাৎকারের অপর অংশে ‘জাসদ থেকে বেড়িয়ে এসে বাসদ ‘শুরু করার কথা বলেছেন। একই সাক্ষৎকারে স্ববিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। নিচে সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ তুলে দেওয়া হল।

সাংবাদিক আনিস রায়হান : আপনি কি জাসদের সদস্য হয়েছিলেন ?

মুবিনুল  হায়দার : না আমি জাসদ করিনি কখনো।

মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা তা নির্ণয়ের জন্য জাসদের সাংগঠনিক কাঠামে ও জাসদের সাথে যুক্ত সংগঠন গুলি সম্পর্কে জানা দরকার। জাসদ ছিল মূল দল। ছাত্রলীগ (বৈ :স ), শ্রমিক জোট , কৃষক লীগ ছিল প্রকাশ্য সহযোগী ” স্বাধীন” সংগঠন। এর বাইরে জাসদ উদ্যোক্তাদের এক অংশ গণকণ্ঠ প্রকাশের সাথে যুক্ত ছিল জাসদ রাজনীতির অংশ হিসেবে। গণকণ্ঠের সাথে যুক্ত ছাত্র বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ জাসদ বা সহযোগী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন না।

এর বাইরে ছিলেন সিরাজুল আলম খান কেন্দ্রিক কিছু মানুষ। প্রসঙ্গতঃ ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান জাসদের প্রকাশ্য সংগঠন গুলির সদস্য ছিলেন না। ১৯৮০ সালের জাসদের সম্মেলনে সিরাজুল আলম খান জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছিল। পরে সিরাজুল আলম খান জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন । কাগজে কলমে ১৯৭২-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত  সিরাজুল আলম খান যেহেতু জাসদের কোন কমিটির বা প্রাথমিক সদস্য ছিলেন না সেহেতু প্রশ্ন উঠতে পারে সিরাজুল আলম খান কি জাসদ করতেন ?

জাসদের ভিতরে বিভিন্ন সময়ে লাল ইশতেহার গ্রুপ , , কেন্দ্রীয় ফোরাম , কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি নামে বিভিন্ন সংগঠন ছিল। এই সংগঠন গুলিকে কৌশল গত কারনে জাসদ বাইরে প্রচারে নিয়ে আসে নাই। তবে নেতৃত্বের পর্যায়ে এই সংগঠন সুমুহের কথা জানা ছিল। ১৯৮০ সালে জাসদ ভেঙে বাসদ এর যাত্রা শুরু। জাসদ রাজনীতির নানা বিষয়ে বাসদ উদ্যোক্তারা সমালোচনা ছিলেন। বাসদ গঠনের তাত্বিক ভিত্তি তৈরিতে জাসদের ইশতেহার গ্রুপ , কেন্দ্রীয় ফোরাম , কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি এই সংগঠন গুলির ব্যর্থতাকে সামনে নিয়ে আসে বাসদ উদ্যোক্তারা।

দল গঠনা প্রসঙ্গে বাসদের বুনিয়াদি ও এক মাত্র পুস্তিকা হচ্ছে  সর্বহারা শ্রেণীর দল গঠনের সমস্যা প্রসঙ্গে  । এই পুস্তিকাটির বেশ কিছু অংশ নকল এবং পুরো বই বক্তব্যের অস্পষ্টতায় ভরা। বাসদের প্রথম প্রকাশনায় জাসদ ও এর সহযোগী সংগঠন সম্পর্কে লিখছে ” ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতণ্ত্র প্রঠিস্টার ঘোষণা কর , জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল , জাতীয় শ্রমিক লীগ ( বর্তমানে জাতীয় শ্রমিক জোট ) জাতীয় কৃষক লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ -এই চারটি গণ সংগঠন সুমুহের কোনটাই সর্বহারা শ্রেণীর মূল সংগঠন অর্থাৎ বিপ্লবী পার্টি হিসেবে গড়ে উঠবে না। এই চারটি গণ সংগঠনের বাইরে সর্বহারা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু তখনকার নেতৃত্ব সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গী মার্ক্সসীয় বিচার বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি আয়ত্ব করতে না পাড়ার ফলে লাল ইস্তেহার গ্রুপ, কেন্দ্রীয় ফোরাম , কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি ইত্যাদি গঠন করলার সেগুলি বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ” ( সর্বহারা শ্রেণীর দল গঠনের সমস্যা প্রসঙ্গে -পৃষ্ঠা ৭ ) ।

বাসদের মূল নথি থেকে জানা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি (সিওসি ) জাসদের অংশ ছিল।

জাসদের ভিতরের সংগঠন সম্পর্কে খায়ের এজাজ মাসউদ লিখছেন ” ১৯৭৪ সালের জুন মাস , তারিখ মনে নেই। জাসদ, ছাত্রলীগ , কৃষক লীগ , শ্রমিক লীগ ও অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্য হতে বিপ্লববাদের মানদন্ডে বাছাই করা স্বল্প সংখ্যক ব্যাক্তিগণকে নিয়ে গোপন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ব্যক্তিগণ সাম্যবাদী বিপ্লবী নামে অভিহিত হন। ……………………..সাম্যবাদী বিপ্লবীদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি, সংক্ষেপে, সিওসি-র কর্মকান্ড অপ্রকাশ্য ছিল। এর কাঠামো , গঠন ও কর্মকান্ড ব্যাপক গোপনীয়তার আবরণে ঢেকে রাখা হয়। সিওসি-ছিল ২১ (একুশ ) সদস্য বিশিষ্ট। এর প্রধান (সমন্বয়কারী ) ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ……………… মুবিনুল  হায়দার এবং কর্নেল তাহের সিওসি -র অবজারভার মেম্বার ছিলেন। তাঁরা সিওসি-র বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন। ” ( কমরেড আব্দুল্লাহ সরকারকে চেনার পথে -খায়ের এজাজ মাসউদ – আব্দুল্লাহ সরকার স্মরাক গ্রন্থ , পৃষ্ঠা ৯৪-৯৫, প্রকাশ কাল ২০১৪ ) । উল্লেখ্য খায়ের এজাজ মাসউদ সিওসি -র সদস্য ছিলেন। ১৯৮০ সালে জাসদ -বাসদ ভাঙ্গনের সময় তিনি এই দুই অংশের বাইরে ছিলেন।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ভোট দেওয়ার অধিকার নাই এমন সদস্যদের অবজার্ভার মেম্বার বলা হয়। অবজার্ভার মেম্বার সকল আলোচনা ও বিতর্কে অংশ নিতে পারে । সিওসি-র বাংলা নাম ছিল সাম্যবাদী বিপ্লবীদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি। ইংরেজীতে সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি অফ দি কমিউনিস্ট রেভুলুশনারীজ। সংক্ষেপে সিওসি। সিওসি এর ২১ জন সদস্যের তিন জন ১৯৮০ সালে বাসদের সাথে যুক্ত হন। এই তিন জন ছিলেন আব্দুল্লাহ সরকার, আ ফ ম মাহবুবুল হক , মাহমুদুর রহমান মান্না।

সাংবাদিক আনিস রায়হানের প্রশ্ন ছিল আপনি কি জাসদের সদস্য হয়েছিলেন ? আর মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল ” না আমি জাসদ করিনি কখনো।” এখন প্রশ্ন উঠছে সিওসি কি জাসদের সংগঠন ছিল ? সিরাজুল আলম খান, আ ফ ম মাহবুবুল হক , কর্নেল তাহেরের কি জাসদ রাজনীতি করতেন ?

খায়ের এজাজ মাসউদ এর বক্তব্য কর্নেল তাহের মেম্বার ও মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর সরাসরি সাক্ষাতের বিষিয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার তৈরী হচ্ছে। সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী বলছেন ” কর্নেল তাহেরকে ২৬ নভেম্বর [ ১৯৭৫ ] গ্রেপ্তার করল। তার সাথে একবার সাক্ষাতের বিষয় সব করা ছিল। পরে বাতিল হয়ে যায়.বৈঠকটি । ফলে আমার সঙ্গে তার কখনোই দেখা হলো না। ” এক অদ্ভুত বিষয় ! একই কমিটির সদস্য ছিলেন তার পরেও না সাক্ষাতের দাবী !

কর্নেল তাহের মামলা

মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী এসইউসিআই এর কংগ্রেসে বলছেন এক সময়ে বাংলাদেশে আমি গভীর সংকটে পড়েছিলাম। সেই সময় কর্নেল তাহের মামলায় আমার নামও যুক্ত হয়ে যায়। ( ৬০ পৃষ্ঠা ) পুরোপুরি মিথ্যা তথ্য। মুবিনুল  হায়দারের নামে কোন কালেই কোন মামলা হয় নাই। কারণ তিনি সব সময় ঘরের ভিতর থেকেছেন। কোন মিছিল মিটিং এর সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না তাই কেন মামলা হবার সম্ভবনা ছিল না। ১৯৭৫/১৯৭৬ কিংবা ১৯৮০ সালে জাসদের উপরের পর্যায়ের নেতা ছাড়া কেউই মুবিনুল  হায়দারের সাথে পরিচিত ছিল না। কর্নেল তাহের মামলা নিয়ে অন্তত পক্ষে ২০টি বই বের হয়েছে। এই বই গুলির বেশ কিছু বইতে মামলার আসামিদের নাম ও সাজার বিবরণ রয়েছে। এই সমস্ত বইয়ে এই মামলার আসামিদের নামের তালিকায় মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর নাম নেই। রবিউল আলম এই মামলার সাজা প্রাপ্ত আসামী ছিলেন । রবিউল আলম এর জবানিতে আসামিদের নাম ও সাজার বিবরণ –

” আদালত কর্নেল তাহেরে ফাঁসি সহ মোট ১৭জনের শাস্তি ১৬ জনকে খালাস প্রদান করে। মেজর এম এ জলিল ও আবু ইউসুফ খানকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদকে ১২ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দশ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয় আ স ম আব্দুর রব , হাসানুল হক ইনু ও ডঃ আনোয়ার হোসেনকে। সাত বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয় সিরাজুল আলম খান , কর্পোরাল আলতাফ হোসেন ও কর্পোরাল শামসুল হককে। নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ জালালউদ্দিন, হাবিলদার এম এ বারেক , রবিউল আলম , সালেহা বেগম ও নায়েক সিদ্দিকুর রহমানকে দেওয়া হয় ৫ বছর কারাদন্ড। হাবিলদার আব্দুল হাই মজুমদার ও কর্পোরাল এ মজিদকে এক বছর কারাদন্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাস সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।

খালাস প্রাপ্ত ১৬ জন  হলেন।: ড.আখলাকুর রহমান , আনোয়ার সিদ্দিক , মহিউদ্দিন , নায়েক সুবেদার বজলুর রহমান , মাহমুদুর রহমান মান্না, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল , মোহাম্মদ শাজাহান , কে ,বি এম মাহমুদ , শরীফ নুরুল আম্বিয়া , হাবিলদার সুলতান আহম্মদ, নায়েক এ বারী , সার্জেন্ট কাজী এ কাদের , কাজী রোকনউদ্দিন , নায়েক সুবেদার এ লতিফ আখন্দ, নায়েক শামসুদ্দিন , সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। ( পৃষ্টা ৪৮৪৮ ,লড়াই, ৩১ অক্টোবর ২০২১, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলজাসদ )

সংকটকালে মুবিনুল হায়দারের ভারত যাত্রা

 মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী সাপ্তাহিকের সাথে সাক্ষাৎকারে বলছেন ১৯৭৬ সালের দিকে চট্টগ্রামে বাড়িতে চলে যাই। পরে আমার সাথে জাসদের বিভিন্ন নেতা যোগাযোগ করতে লাগল। সময় আম্বিয়া ইনুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ভারতে চলে গেলাম। তখন বিপদের কথা ভেবে দিনাজপুর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার হেটে যেতে হয়েছিল। কারণ তখন ধরা পড়লেই ফাঁসি হয়ে যেতে পারে।এই সাক্ষাৎকার অতিকথন ও দুমড়ানো সত্যের আরেক উদাহরণ।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদের ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী ধরা পড়লে ফাঁসিতে হতে পারত মন আশঙ্কার কথা বলেছেন সাপ্তাহিক , ঈদুল ফিতর সংখ্যা ৩০মে ২০১৯ সাথে সাক্ষাৎকারের । জাসদের সকল প্রধান নেতার সেই সময় কর্নেল তাহের মামলার আসামী অথবা অন্য মামলা বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ সামরিক আইনে কারাগারে। এর মধ্যে ছিলেন , মির্জা সুলতান রাজা, মেজবাউদ্দিন আহমেদ, এম এ আউয়াল , ছাত্রলীগ (বৈ :স) সভাপতি আ ফ ম মাহবুবুল হক প্রমুখ। এই তালিকা অনেক বড়। এর বাইরে জাসদের জেলা পর্যায়ের গুরুত্ব পূর্ন নেতারা কারারুদ্ধ ছিলেন। সেই সময়ের জাসদ রাজনীতির বিচার মূলক পর্যালোচার দাবীকে কখনোই পাশ কাটানো যাবে না। জাসদের তৎকালীন নেতাদের পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা স্রোতের কারণে অতীতের ভূমিকা অস্বীকার করা ইতিহাসকে নতুন মোড়ক দেওয়ার সামিল। তবে সেই সময়ে এই নেতারাই ছিলেন জাসদের চালিকা শক্তি। এই নেতাদের কারো ফাঁসি হয় নাই কিংবা ফাঁসি হতে পারত এমন আশংকার কথা এযাবৎ কাল পর্যন্ত কেউ বলেন নাই। ব্যাতিক্রম শুধু মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর ২০১৯ সালের দাবী !

মুবিনুল হায়দারের সাপ্তাহিকের সাথে সাক্ষাৎকার রাজনৈতিক সততা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন জন্ম  দিয়েছে।

(১) একই মামলার দুই বার বিচার হতে পারে না। ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সালের মামলার রায় হবার পরে মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর নাম যুক্ত হওয়ার সম্ভবনা ছিল না । কর্নেল তাহের মামলার রায় ১৭ জুলাই ১৯৭৬ ও ফাঁসি ২১ জুলাই ১৯৭৬। মামলার রায়ের পর মামলার করা আসামি ছিলেন তা জানা যায়। মামলার রায় অর্থ সেই মামলায় সমাপ্তি। যে সময় খালাস প্রাপ্তরা ছাড়া পাওয়ার কথা সেই সময় নিরাপত্তার অজুহাতে এই মামলার কল্পিত আসামী মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী ভারতে পাড়ি জমালেন মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী । ধরা যাক , মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী ভুল ক্রমে মনে করে ছিলেন তাকে কর্নেল তাহের মামলার আসামী। মামলার বিচার সমাপ্ত হবার পর কোন সে ভুল ভাঙলো না !

(২) হাসানুল হোক ইনুর সাথে সেপ্টম্বর ১৯৭৬ সালে আলোচনা কি ভাবে সম্ভব হলো ? ১৯৭৬ সালের সেপ্টম্বরে হাসানুল হক কর্নেল তাহের মামলায় দণ্ড প্রাপ্ত হয়ে করার অন্তরালে ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ‘ নিরাপত্তার’ জন্য সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনুদের রাতের অন্ধকারে কারাগার থেকে কারাগারে স্থানান্তর ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। প্রসঙ্গতঃ ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহের মামলার রায় হয়েছিল। ২১জুলাই ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাসানুল হক ইনুর আলাপ হওয়া কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। মুবিনুল  হায়দার চৌধরী এখানে অসত্য বলেছেন।

(৩) চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর হয়ে ভারত একটি অজিজ্ঞাসিত প্রশ্ন : চট্টগ্রামে অবস্থানরত মুবিনুল  হায়দার চৌধুরী কেন দিনাজপুর দিয়ে ভারত গেলেন ? চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণে আর দিনাজপুর বাংলাদেশের উত্তরে। এই দুই শহরের সড়ক পথে দুরুত্ব প্রায় ৩৭৫ মাইল। রেল যোগাযোগে এই দুরুত্ব প্রায় ৫০০ মাইলের কাছাকাছি। সেই সময় ঢাকা দিনাজপুরের কোন সরাসরি ট্রেন লাইন ছিল না। যমুনার অপর পাড় থেকে নানা ঘুরা পথে দিনাজপুর যেতে হত। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসন, সামরিক শাসন কারণে রাজনৈতিক কর্মীদের অনেকেই দমন-পীড়নেই সময়ে কিভাবে কাজ করতে হয় সে ব্যাপারে স্বশিক্ষিত। আত্মগোপন কালীন সময়ের অন্যতম ও প্রধান শিক্ষা ও কৌশল হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ পরিহার করা। চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর হয়ে ভারত এই পথ -রুটকে সাধারণ মানুষ অপ্রয়োজনীয় পথ -রুট হিসেবে গণ্য করবেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে ভারত গমনের বেশ কয়েকটি পথ – রুট রয়েছে । মুবিনুল  হায়দার কেন এই পথ – রুট গুলি ব্যাবহার করলেন না তা প্রশ্ন বোধক ও অজানা থেকে যাবে। তিনি কি করে অনুমান করলেন দিনাজপুরের পথ – রুট অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সেই প্রশ্ন তেমন অমূলক নয়।

(৪) জনাব হায়দারের বক্তব্য ” আমি নিরাপত্তাজনিত কারণে সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খুব ঝুঁকি নিয়ে কোনও রকমে আমি উত্তরবঙ্গে ঢুকলাম। ” । বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বৃহত্তর খুলনা , যশোর , কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর – পুরোনো রাজশাহী বিভাগে জাসদ সহ চীনপন্থী বামরা সক্রিয় ছিল। চট্টগ্রামের তুলনায় উপরেল্লিখিত অঞ্চল গুলি ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ ও অনিরাপদ ছিল। সারা দেশ ঘুরে ঝুঁকি পূর্ন উত্তরবঙ্গে ঢুকে পড়ার যৌক্তিক কারণ কম। চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর দিয়ে ভারত যাওয়ার কারণ কি ? বৃহত্তর নোয়াখালী , বৃহত্তর কুমিল্লা দিয়ে কি ভারত যাওয়ার সুযোগ ছিল না ?

১৯৭৬ সালে পাবনা -সিরাজগঞ্জ , বগুড়া , গাইবান্ধা , রংপুরে জাসদের অনেকেই গ্রেফতার হন। এই ঘটনা গুলিকে কাকতলীয় ধরে নিব। ১৯৭৫-৭৬ সালে উত্তর বঙ্গে ব্যাপক দমন পীড়ন চলছিল। বৃহত্তর পাবনা জেলায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মতিন – আলাউদ্দিন – টিপু বিশ্বাস সহ ৪০/৫০ জন জেলে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম -এল ) সম্পাদক মনিরুজ্জামান তার খুন হন ১৯৭৫ সালের মে মাসে। পাবনার জাসদ নেতা আহমেদ করিম, সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম সহ বেশ কয়েক জন গ্রেফতার হন ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি। বগুড়ার সাম্যবাদী দল নেতা সালেহা বেগমদের নির্যাতনের কাহিনী এই অঞ্চলে অজানা নয়। এই সব অত্যাচার নির্যাতনের পরেও উত্তর বঙ্গ মুবিনুল  হায়দারের জন্য নিরাপদ ছিল ?

” ১৯৭৬ সালের নিরাপদ রংপুর ‘ – রংপুরে কর্নেল তাহেরে সহ জাসদ মুক্তির দাবিতে ১৯৭৬ -এর ৩১ মার্চ মিছিল করার অপরাধে আব্দুল জব্বার ও আব্দুল কুদ্দুস কে “বন্দুক যুদ্ধে ” হত্যা করে। আলতাফ পারভেজের বই ” মুজিব বাহিনী থেকে গণ বাহিনী ” পৃষ্ঠা ৫১৮। শুধু ১৯৭৬ সালেই ৫ জন জাসদ কর্মী খুনের ঘটনা উল্ল্যেখ আছে । এছাড়া ১৯৭৬ সালে গাইবান্ধায় ৬ জন জাসাদ কর্মী খুন হওয়ার কথা উল্ল্যেখ আছে।

চট্টগ্রামে অবস্থানরাত কেউ দিনাজপুর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার যুক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। তবে  অকাট্য  যুক্তির মাধ্যমে মুবিনুল হায়দারের বিরুদ্ধে কিছু প্রমান সম্ভব নয়। প্রধান বিষয় একটাই দেশত্যাগের সময় তাঁর মামলা বা ফাঁসীর ভয় ছিল না।

(৫) মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর তাহের মামলার সাথে যুক্ত থাকার বিষয়ে ঘাটশিলা -ভারতে ও বাংলাদেশে দুই রকমের তথ্য দিয়েছেন। ভারতে বলেছেন কর্নেল তাহেরের মামলায় আমার নামও যুক্ত হয়ে যায়।  আর বাংলাদেশে সাপ্তাহিক এ সাক্ষৎকারে জনাব হায়দার বলছেন ” তাদের [ জাসদ ] তুলনায় আমি নিরাপদ ছিলাম। ঢাকায় কয়েকটি মামলায় তাদের সঙ্গে আমার নাম যুক্ত করে দেয়। ” কেন এই লুকোচুরি ! সাপ্তাহিকের জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আনিস রায়হান। বাংলাদেশে তাহের মামলার আসামী হিসেবে দাবী করলে সহজেই অসত্য বচন ধরা চোখে পড়ার সম্ভবনা থেকেই জনাব হায়দার নাম গোত্র হীন ” কয়েক টি মামলায় নাম যুক্ত ” হওয়ার দাবী জানিয়েছেন। মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঢাকায় জাসদ নেতাদের সাথে কোন মামলা ছিল না। প্রধান কারণ তিনি কোন পরিচিত মুখ ছিলেন না। জাসদের মধ্যে জনাব হায়দারের যোগাযোগের পরিধি ছিল হাতে গোনা কয়েক জনের সাথে। মুবিনুল  হায়দারের ভাষায় ” কিছুদিন পরে তিনি [ সিরাজুল আলম খান ] গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। ফলে আমার সাথে সব ধরণের যোগাগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাদের [ জাসদ ] তুলনায় আমি তখন নিরাপদ ছিলাম। [ সাপ্তাহিক ৩০মে ২০১৯ ঈদুল ফিতর সংখ্যা ] । সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তারের সাথে সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে জনাব হায়দারের জাসদের মধ্যে পরিধি বুঝা যায়। হাতে গোনা কয়েক জনের সাথে যোগাযোগের কারণে জনাব হায়দারের বিরুদ্ধে কোন কালেই কোন মামলা হয় নাই। মামলা হওয়ার কোন সম্ভবনা ছিল না ধরা যাক , মামলা বিষয়ক মুবিনুল  হায়দার চৌধুরীর বক্তব্য সত্য।

সিরাজুল আলম খান প্রসঙ্গে মুবিনুল হায়দার

মুবিনুল হায়দার শুধু কর্নেল তাহেরকে মামলাযা তাঁর নাম যুক্ত হওয়ার মিথ্যা দাবী করেই ক্ষান্ত হন নাই।  সময় সুযোগ পেলেই বিভিন্ন তথ্যকে নিজের মত করে ব্যবহারে সক্রিয় ছিলেন। এমন একটি ঘটান হচ্ছে ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ সালে সিরাজুল আলম খানের ভারত অবস্থান নিয়ে।  মুবিনুল হায়দার সাপ্তাহিক , ঈদুল ফিতর সংখ্যা , ৩০ মে ২০১৯ সাল  – পথের খোঁজে পথে পথে শিরোনামে আত্মজীবনী মূলক সাক্ষাৎকার দেন। নিচে সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ তুলে দেওয়া হলো।

আনিস রায়হান : ১৫অগাস্ট ঘটনা পর্বে আপনি কোথায় ?

মুবিনুল হায়দার : ১৫ অগাস্ট শেখ মুজিব যে মারা গিয়েছিল, তখন আমি কলকাতায় ছিলাম। সিরাজুল আলম খানও কলকাতায় ছিলেন। এরকম একটা ঘটনা যে এভাবে ঘটবে তা তিনিও জানতেন না। সিরাজুল আলম খান তখন মাঝে মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন।  সে জন্যই তখন ভারতে গিয়েছিলেন।

সিরাজুল আলম খানের নিজ জবানীতে মুজিব ভাইয়ের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক আগে। সে সাক্ষাতে তিনি আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে বলেছিলেন। ……………..শেষ সাক্ষাতে তিনি আমাকে ভারতে চলে চলে যেতে বললেন। তখন বাকশাল কায়েম হয়েছে। …………..১৯৭৫এর আগস্টের এক বা দুই তারিখে আমি ভারতে গেলাম। “ ( পৃষ্ঠা ১৬৮, আমি সিরাজুল আলম খান বলছি : একটি রাজনৈতিক জীবন লেখা। প্রকাশ কাল ফেব্রুয়ারী ২০১৯ )

এখানে যে কেউ একজন সত্য বলছেন না। আমরা দেখছি দুইটি গুরুত্ব পূর্ন বিষয়ে মুবিনুল হায়দার সত্য বলেন নাই। প্রথমটি  হচ্ছে  কর্নেল তাহের মামলায় নিজের নাম যুক্ত দাবী। অন্যটি হচ্ছে সেপ্টম্বর ১৯৭৬ সালে হাসানুল হক ইনুর সাথে আলোচনার দাবী। হাসানুল হক ইনু সেই সময় সামরিক আদালতের দণ্ডাদেশে কারারুদ্ধ। মুবিনুল হায়দার দাবী করেছেন সিরাজুল আলম খান শিবদাস ঘোষের সাথে দেখা করতে কলিকাতায় গিয়েছিলেন। পারিপার্শিকতা মুবিনুল হায়দারের  দাবীকে নাকচ করে দেয়।

জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ  ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ এ সিরাজুল  আলম খানের অবস্থান সম্পর্কে লিখছেন ” শেখ মুজিব যখন নিহত হন , সিরাজুল আলম খান তখন কলকাতার ভবানীপুরে রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডে চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে ঘুমিয়ে। ” – ( পৃষ্ঠা ১৭৯ ) । বাংলাদেশের রাজনীতিতে  ভবানীপুরে রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডে ও  চিত্তরঞ্জন সুতার  কোন অপরিচিত নাম নয়।  চিত্তরঞ্জন সুতার মহিমানিত্ব ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোক ছিলেন।  বাংলদেশের যুদ্ধের ইতিহাসে ভবানীপুরে রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডে ও  চিত্তরঞ্জন সুতারের নাম বহু বই পুস্তকে এসেছে।  চিত্তরঞ্জন সুতার ও তাঁর ভূমিকা নিয়ে কোন বিতর্ক বাংলাদেশে নেই।  দৈনিক ইত্তেফাক -৪ জুন ২০১৩ এর প্রতিবেদন

” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে ভারতের রাজনীতিবিদ, দিল্লী ও কলিকাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগের বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় কলিকাতার ভবানীপুরের সানি ভিলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা ছিল এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদদের মূল আড্ডা বসত এখানে। দেশ মুক্ত হওয়ার পর ৭৩ সালের প্রথম দিকে চিত্ত সুতার দেশে ফিরে আসেন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি—বানারীপাড়া সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি যখন প্রার্থী হন সে সময় বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় তার কোন নাম ছিল না। এ কারণে নির্বাচন কমিশন প্রণীত সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রে প্রার্থী ভোটার কিনা তার কলামটি রাখা হয়নি বলে কথিত আছে। সমসাময়িক রাজনীতিতে তিনি এতটা প্রভাবশালী ও অনিবার্য (!) ছিলেন যে, কোনদিন আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও এ দলের প্রার্থী হন । সেই চিত্ত রঞ্জন সুতার ৭৫ সালের ১১ আগস্ট ভারতে যান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রাক্কালে । ”

চিত্ত রঞ্জন সুতারের  সহকর্মী  ডা: কালিদাস বৈদ্যে  ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’  বইয়ে তাদের কর্মকান্ডের খতিয়ান তুলে ধরেছেন।   চিত্ত রঞ্জন সুতার ও  ডা: কালিদাস বৈদ্যে এর সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক এই বইটিতে উঠে এসেছে। বইটি ২০০৫ সাল থেকে বাজারে পোয়া যায়। মুবিনুল হায়দারের দাবী সিরাজুল আলম খান কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন।  একজন বিদেশী রাজনৈতিক প্রতিনিধি -সিরাজুল আলম খান এসইউসিআই দলের প্রধান শিবদাস ঘোষের সাথে দেখা করতে এসেছেন। অথচ সিরাজুল আলম খান  কোথায় থাকছেন সে সম্পর্কে কোন কিছু খোঁজ খবর না নিয়েই শিবদাস ঘোষের সাথে সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করা কোন দায়িত্বশীল বামপন্থী আচরণের মধ্যে পরে না।

মুবিনুল হায়দারের বক্তব্যের পিছনে ……..

মুবিনুল হায়দারের  অসত্য প্রচরণা নিছক ভুল নয়। শিবদাস ঘোষ কাল্ট – ব্যক্তি পূজা অনুরাগী দল তৈরী ও এসইউসিআই  এর সংকট নিরসনে সাফল্য ইতিহাস সামনে আনার প্রবণতা থেকেই মবিনুল হায়দার চৌধুরী  এবং SUCI ও বাসদ মার্ক্সবাদীর এই উদ্দ্যোগ। বিশ্বব্যাপী মার্ক্সবাদী আন্দোলন প্রায়োগিক ও দার্শনিক সংকটের মুখোমুখি। অন্য বামপন্থী দল গুলির মত SUCI এর জন্য  সাধারণ সংকট। অপর সংকট গুলির মধ্যে নির্বাচনী ব্যার্থতা। নির্বাচনে এক সময়ে আঁতাত আবার একলা চলার নীতি ।  এর পরে রয়েছে দলের ভাঙ্গন। শংকর সিংহ এর মত প্রবীণ নেতাদের দল থেকে বের করে দেওয়া।  মনি গুহের্  যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে দল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা , বিধান চ্যাটার্জির  আত্ম হত্যা ও দলের প্রতি খোলা চিঠি দলের সংকটের ধূমায়িত অসন্তোষের একাংশ।  বাংলাদেশও বাসদ – মার্ক্সবাদী ২০১৮ এর শেষের দিকে ভাঙ্গনের কাছাকাছি অবস্থান করছিল। এই ভাঙ্গনের মূল কারণ ছিল মবিনুল হায়দার চৌধুরীর পরিবার ও পছন্দের লোকদের দলের নেতৃত্বে বসান।  বাসদ – মার্ক্সবাদী রাজনীতির চমক ফিকে হয়ে আসছিল। এই সব কিছুকে সামাল দিতেই মুবিনুল হায়দারের কথা মালার নাগরদোলা।

অপু সারোয়ার : ফ্রি ল্যান্স লেখক।