মতামত

আইন মেনেই বলছি– উত্তর পুরুষ

দেখতে দেখতেই বছরটা শেষ হয়ে গেল। বিদায় ২০২১। অনেক স্মৃতি নিয়ে মানুষ আর একটি নতুন বছরে পা দেবে। এই বছর অনেকেই বিয়ে করেছেন, কারো সংসারে জন্ম নিয়েছে সন্তান। অনেকেই কষ্ট করে বিভিন্ন দেশ থেকে বাড়ি ফিরেছেন প্রিয়জনের সাথে মিলনের আশায়। অন্যদিকে অনেকেই হারিয়েছেন মা-বাবা-ভাই-বোন সহ অনেক স্বজন । এই প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার এবং  হারানোর স্মৃতি নিয়ে মানুষ ২০২২ কে বরণ করতে চলেছে।

আবার কেউ কেউ  দেশের ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা ক্ষমতা হারানোর স্মৃতি বয়ে বেড়াবেন। অনেকেই চেষ্টা করেছেন এমন কিছু কাজ করতে যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়া যায় তার জন্য। ক্ষমতার এই লড়াই প্রতিনিয়ত চলছে। ঝড়-প্লাবন-খরা, ভুমিকম্প-মহামারি  কোন কিছুই এই লড়াই বন্ধ করতে পারেনি।

এই দেখেন, ট্রাম্প সাহেবের কথাই একবার ভাবেন। কত বড় দেশের, কত বড় প্রেসিডেন্ট। সোনালী চুলের বাহার দেখিয়ে, মুখ বাঁকা করে আমেরিকান ঢঙে ইংরেজীতে কত বড় বড় কথায় না বলতেন। মেক আমেরিকা গ্রেট বলতে বলতে মুখের ফেনা বের করেছেন। অভিবাসনের উপর কত নিয়ম কানুন করলেন। হোয়াইট সুপ্রিমেসির অনেক  জিকির করলেন।করোনা ভাইরাস নিয়ে কত ঠাট্টা মশকরাই না করলেন। একেকবার একেক কথা। কখোনা এটা চাইনিজ ভাইরাস, কখনো টিকা দিতে হবে না, আমেরিকানদের গড রক্ষা করবে। কথার ফুলঝুরি যেন। এতো কথা আমাদের দেশে রাস্তায় দাঁড়ানো চুলকানির মলম বিক্রেতারাও বলতে পারেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মনে আছে তো আপনাদের কিভাবে তারা ক্যানভাস করতো ? মনে করতে পারলে ভাল, আমি আবার এখানে বলব না। আবার ২০২০ এর নির্বাচনের পর কত চেষ্টাই না করলেন ক্ষমতা ধরে রাখতে । আরে ট্রাম্প ভাই, এতো কিছু করেও পারলেন কি ক্ষমতায় থাকতে? ২০২১ এর জানুয়ারী মাসে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিলেন। একেই বলে কপাল।

আবার দেখেন, এই আমেরিকান সরকার আফগানিস্থান নিয়ে কত কান্ডই না করল। একসময় আফগানিস্থানে  অবস্থানরত  তৎকালীন সোভিয়েত সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রথমে মুজাহিদদের সমর্থন দিল। পরে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তাদের উৎখাতের জন্য সৈন্য পাঠিয়ে দিল। যেন আমেরিকা ছাড়া গনতন্ত্রের কোন ভবিষ্যত নেই। এইভাবে কুড়ি বছর গণতন্ত্রের ধ্বজা ধরে আফগানিস্থান থেকে ২০২১ সালে সৈন্য প্রত্যাহার করল। আরে ভাই করলেন কি  এতগুলো বছর ধরে সেখানে? কোন গণতন্ত্র আনলেন ? বেরিয়ে আসার আগে আবার তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আসলেন। কত নাটকই না টেলিভিশনে।পুরাই আমেরিকান ওয়ার  মুভি। থাক, বিদায় ২১ বলতে গিয়ে আমেরিকার গীবত করলাম। আমার কি দরকার, বলেন ? নিজের জ্বালায় বাঁচি না।

আপনি বলবেন নিজের জ্বালা কি? দেশের মানুষ অনেক শান্তিতে আছে এখন । আমাদের কোন চিন্তা নাই, ভাবনা নাই, সাহিত্য নাই, সংস্কৃতি নাই, সভা নাই, সমাবেশ নাই। এতো নাই নাই করেন কেন? অনেক কিছুই তো আছে। সব চাইতে বড় কথা মানুষের পেটে বেলা শেষে ভাত আছে। তা আছে। উপরের তলার লোক খাওয়ার পর কিছু তো বেচে যায়। তলানী টুকুই নিচের তলার লোকদের বরাদ্দ। তারা ওটা খেয়ে ঢেঁকুর তুলে রোজ। বড় লোক মাংস খেয়ে দাঁত খোঁচায় আর গরীবরা শাক খেয়ে। খোঁচায় তো, নাকি?  

দেশের সাধারণ মানুষের জন্য  আরো একটা জিনিস আছে । সেটা কি ? সেটা হচ্ছে সিনেমা। প্রতি  মাসেই এক একটা নতুন সিনেমা বানানো হয়। তবে এই সিনেমা গুলো হলে গিয়ে দেখতে হয় না। ড্রয়িং রুমে বসে, মফস্বলের বা গ্রামের চায়ের দোকানে বসেই টেলিভিশনেই দেখতে পারেন। সিনেমা গুলো আগের মতই আবেহায়াত, সওদাগর, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, দোস্ত দুশমন এর মতই । তবে নায়ক নায়িকা ভিন্ন। তাদের আর এফ ডি সি তে গিয়ে স্যুটিং করতে হয় না। নিজের ঘরে, গুলশানের কোন বাড়িতে কিংবা কোন ক্লাবেই এর স্যুটিং হয়ে যায়। আর আমরা আরামসে দেখতে থাকি। কোন একটা সিনেমা পরীমনি কে নিয়ে, কোন একটা সম্রাট-ক্যাসিনো নিয়ে আবার কোন একটা মামুনুল হক কে নিয়ে। এখানে সবগুলো সিনেমাই সুপার ডুপার হিট । আপনারা কি বলেন? আমার কথায় কি এসে যায়। জনগণের ভোটই চুড়ান্ত। এখন তো মোবাইলেই ভোট চাওয়া হয় । দিয়ে দেন ভোট।

আবার রাজনীতি বিষয়েও সিনেমা হয় । এই যেমন ধরেন হেফাজত কে নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে সুপার হিট হল একটা সিনেমা। হেফাজতের আমির মওলানা শফীর মৃত্যু ,এই মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক , মঞ্চে বাবুনগরীর আবির্ভাব তাকে আমির করা, আবার তার বিরুদ্ধে শফী হুজুরের ছেলের অবস্থান – সব মিলিয়ে একটা জমজমাট কাহিনী। মানুষ আয়েশ করে পায়েশ খেয়ে এই সিনেমা উপভোগ করলো। এক্কেবারে পূর্ণ -প্রেক্ষাগৃহ সাইনবোর্ড সবখানে। ভাল।

একটা আবার বছরের শেষের দিকে মুক্তি পেলেও সুপার হিট হল। কোন সিনেমার কথা বলছি বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই। ঐ যে সিনেমার হিরো হাসান- আরে দুজনের নামের আগে পিছেই হাসান আছে । কার কথা বলতে গিয়ে কার কথা বলে ফেলি। পরে একটা মাইর ও মাটিতে পড়বে না। সব আমার পিঠে পড়বে। বলছিলাম প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের কথা। একেবারে রগরগে দক্ষিন ভারতের ছবি। মানুষ যারপর নাই খুশিতে দেখলেন। কিভাবে একজন মন্ত্রীর পতন হল। রজনীকান্ত ও এত সুপার হিট ছবি করতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে । আবার এই সিনেমার মধ্যেই নতুন মুক্তি পেল খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা নিয়ে নতুন একটা । ফখ্রুল সাহেব অনেক হুমকি ধামকি দিলেন এরপর আবার চুপচাপ হয়ে গেলেন । মনে হয় শীতে পেয়েছে উনারে। সুপার হিট হতে পারলো না সিনেমাটা ।  বয়স্ক হিরোর সিনেমা এখন দেশের জনগণ পছন্দ করে না। 

এতক্ষণ অনেকগুলা সুপার হিট সিনেমার কথা বললাম। আরো অনেক ছিল সব কি আর বলা যায়? আইনের মধ্যে থেকেই সব কথা বলতে হয়। আইন তৈরী হয় প্রজাদের কন্ট্রোলে রাখার জন্য। রাজাদের শান্তিতে ঘুমানোর জন্য। প্রজাদের বেশি কথা না বলে আয়েশ করে সিনেমা উপভোগ করাই ভাল। 

দেখেন সিনেমার কথা বলতে বলতে আসল কথাই বলা হল না। এতোগুলা লোক নিয়ে  বরগুনা যাওয়ার পথে একটা লঞ্চে আগুন লেগে কত লোক মারা গেল। একটা হিসাবে দেখলাম ৩৯ জনের মৃত্যু ও অর্ধ  শতাধিক লোক আহত। কিন্তু আসলেই কি তাই? কত লোক লঞ্চে চড়েছে তার কি কোন হিসাব আছে ? আমার তো মনে হয় নাই। যারা ঐ লাইনে যাতায়াত করেন কত লোক এক একটা লঞ্চে চড়েন তা জানেন। কয়েকশ লোক তো হবেই। আমদের দেশে একটা জোক চালু আছে পরিসংখ্যান নিয়ে। সেইটা এইরকম- মিথ্যা তিন প্রকার । একটা হচ্ছে গিয়ে মিথ্যা, দ্বিতীয় হল মহা মিথ্যা আর তৃতীয়টা হল পরিসংখ্যান। যাকগে জোক বলার সময় না এইটা। তবে পাঠকদের মধ্যে কেউ পরিসংখ্যানের ছাত্র থাকলে তারা যেন মাইন্ড না করেন। মনে কষ্ট নিয়েন না । অনেক কষ্ট থেকে এই কথা বললাম। মানুষ যে মারা গেছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে , স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে  তার কতটুকু খবরই বা আমারা পাই? এর আগে কত কত লঞ্চ ডুবে মারা গেছে তার জন্য কি কোন ব্যবস্থা কেউ নিয়েছে? ঐ গুলার যদি ঠিকমত বিচার হয়েছে? কিছুই হয় নি। আমরা সবাই সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত।

থাক, দুঃসংবাদ দিয়ে আপনাদের মন খারাপ করতে চাই না। বছর শেষ হচ্ছে। সবাই আনন্দে থাকেন । নতুন বছরে নতুন সিনেমার জন্য প্রস্তুতি নেন। আমি পুরান দিনের লোক, আমি পুরান সিনেমা দেখব আর গান শুনব ওইটা- চুমকি চলেছে একা পথে ……।।

# ডিসেম্বর ২০২১।