চলমান সংবাদ

শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী আর নেই

একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রামের প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের অন্যতম নারীনেত্রী শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী আর নেই। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল চারটায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৩ বছর বয়সী বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। লেখক-সংগঠক বেগম মুশতারী শফীর স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। একাত্তরের ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক-নাগরিক আন্দোলনে সামনের সারির সংগঠক মুশতারী শফী উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন। উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা জানান, শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল চারটার দিকে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। রাতে তাঁর মরদেহ চট্টগ্রামে নেয়া হবে। পরদিন রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের পর পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দাফন করা হবে। বেগম মুশতারী শফীর দুই ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য স্বজন রয়েছেন। সাহিত্যিক, উদ্যোক্তা ও নারী নেত্রী শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলায়। মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর স্বামী মোহাম্মদ শফী এবং ছোট ভাই এহসানকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বামী-ভাই হারিয়েও মুশতারী শফী মনোবল অক্ষুন্ন রেখে একাত্তরে চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোসময় তিনি ওই বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে হিসেবে কাজ করেন। ষাটের দশক থেকে তিনি নারী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৬০ এর দশকে চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ সংগঠন থেকে তিনি ‘বান্ধবী’ নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে তিনি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি তিনি এতে নেতৃত্বও দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রয়াণের পর দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মূল নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। এছাড়া বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একযুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার বেগম মুশতারী শফী দেশে প্রগতিশীল চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য তাকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০১৬ সালে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করা হয়। তিনি গত বছর ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’। বেগম মুশতারী শফীর কর্ম নিয়ে ২০০৪ সালে ‘বিস্তৃত জীবন’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুশতারী শফী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি; জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ভ্রমণ কাহিনী ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিতে অমলিন যারা’, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোটগল্পের সংকলন ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, ‘একুশের গল্প’ প্রভৃতি। বেগম মুশতারী শফীর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে। তাঁর মৃত্যুতে প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, বেগম মুশতারী শফীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। যা কখনোই পূরণ হবার নয়। চট্টগ্রামের সকল প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন শহীদ জায়া মুশতারী শফী। # ২০.১২.২০২১ চট্টগ্রাম #