চলমান সংবাদ

চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো হালদার কার্প জাতীয় চার প্রজাতির মাছ ও ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর কার্প জাতীয় চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্স) করেছেন চট্টগ্রামের একদল গবেষক। গাঙ্গেয় ডলফিনসহ রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশের জীবনরহস্য উন্মোচন বিশ্বে এটাই প্রথম। এই গবেষণার ফলে হালদা নদীর জীববৈচিত্র রক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এসব জলজ প্রাণীর নানা বৈশিষ্ট্যও জানা যাবে। কার্প জাতীয় এ মাছগুলোর জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলে এগুলোর ‘বিশেষত্বের’ দিকগুলো জানা সম্ভব হবে জানিয়েছেন গবেষকরা। তবে এর আগে ভারতের গঙ্গা নদীর রুই ও কাতলার জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন দেশটির গবেষকরা। আর যুক্তরাষ্ট্র উন্মোচন করেছে আটলান্টিক মহাসাগরের ডলফিনের জীবনরহস্য। বিশ্বের জিনোম সিকোয়েন্স বিষয়ক তথ্যভান্ডার হিসেবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন-এনসিবিআই’র ডেটা ব্যাংকে এ গবেষণার ফল জমা দেওয়ার পর অনুমোদনও পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তা প্রকাশও করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) সকালে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম জুমের মাধ্যেমে হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন ও হ্যাচারি সম্বলিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। কার্প জাতীয় এ মাছগুলোর জীবনরহস্য উন্মোচনের জন্যে প্রায় দুই বছর ধরে চলা এ গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী। এছাড়াও এ গবেষণায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সুমা আক্তার, নাজনীন ইসলাম, সাবিহা মুস্তফা অর্পা, আব্দুল্লাহ আল আশেক এবং আজলিনা কবির। একইসাথে এ গবেষণায় চীনের নর্থ-ওয়েস্ট এএনএফ ইউনিভার্সিটি এবং নিউজিল্যান্ডের টেক্সটজেন ইনফরমেটিকস নামের একটি সংস্থার ল্যাবরেটরির সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে। এ গবেষণায় অর্থায়ন করেছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। গবেষণায় জানা গেছে, দুই বছরে হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও মিঠা পানির ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়। এতে মোট ৮২ হাজার ৭৮৮টি জিন শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে রুই মাছের ১৬ হাজার ৬০৯টি, কাতলা মাছের ১৬ হাজার ৫৯৭টি, মৃগেল মাছের ১৬ হাজার ৬০৭টি, কালবাউস মাছের ১৬ হাজার ৬২০টি ও মিঠা পানির ডলফিনের ১৬ হাজার ৩৬৫টি জিন শনাক্ত করা হয়। অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ডলফিনের প্রজাতি ‘প্লাটানিস্টা গাঞ্জেটিকা’র পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে। হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রজনন ক্ষেত্র। কার্প জাতীয় মাছ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হ্যাচারিতে বড় হওয়া মাছের জেনেটিক পার্থক্য নির্ণয়ে বিভিন্ন তুলনামূলক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এরআগে বন্য পরিবেশে বড় হওয়া রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশের কোনো পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করা হয়নি। তাই, আমাদের এই গবেষণা হ্যাচারি ও বন্য পরিবেশে বড় হওয়া উক্ত প্রজাতিগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনব্রিডিং সমস্যাসহ পরিবেশগত পরিবর্তন, অসুস্থতা, রোগের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ‘জৈবিক প্রক্রিয়া’ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। তিনি আরও বলেন, মিঠা পানির ডলফিন। যেটাকে আমরা শুশুক বলি, সেটি বিপন্ন জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। ভারতের গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এদের বাসস্থান হওয়ার কথা। ভৌগলিকভাবে হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীর অবস্থান অনুযায়ী গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রামের এই নদীগুলোর কোন সংযোগ নেই। এমনকি অতীতেও সংযুক্ত থাকার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীতে এই ডলফিনের আগমন, বিস্তৃতি এবং অবস্থান এতদিন রহস্যাবৃত ছিলো। অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী বলেন, কতকয়েক মাসে হালদা নদীতে বেশ কয়েকটি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আমরা একটির ময়নাতদন্তও সম্পন্ন করেছি। হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও মিঠা পানির ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হওয়ায় এখন এই নদীর ডলফিন কেন মারা যাচ্ছে, এটি তাদের জিনগত সমস্যা কিনা বা কোন ধরনের দূষণে মারা যাচ্ছে তা জানা যাবে। জীবনরহস্য উদঘাটনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে গবেষকরা বলছেন, অত্যাধুনিক ঘএঝ প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার সপ্টওয়্যার (ইরড়রহভড়ৎসধঃরপং) এর ব্যবহারের মাধ্যমে উন্মোচিত তথ্য একটি ড্রাপ্ট জিনোম ডাটাঊেৎ তৈরি করা। যা ভবিষ্যতের গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া এ গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিকিকরণ ও হালদার ব্র্যান্ডিং কার্যক্রমে তথ্যভান্ডার হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে বিবর্তনের উৎস (ঊাড়ষঁঃরড়হধৎু ঙৎরমরহ) হিসেবে হালদার কার্প ও ডলফিনের জিনোমের তথ্যভান্ডার তৈরি করা সম্ভব হবে।

# ১৬.১১.২০২১ চট্টগ্রাম #