চলমান সংবাদ

চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নিয়ে গণশুনানি, ৫৬ জনের সাক্ষ্য গহণ

– হামলার ভয়াবহতা-বর্বরতা উঠে এসেছে বক্তব্যে

চট্টগ্রামে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদি সন্ত্রাস নিয়ে তদন্ত ও গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রবিবার (১৪ নভেম্বর) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’-এর এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে এই গণকমিশন গঠিত হয়। চট্টগ্রাম গণকমিশনের গণশুনানিতে ১৩ জন সাক্ষী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে চট্টগ্রামে উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নারকীয় তান্ডব এবং পূজামন্ডপে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার মৌখিক সাক্ষ্য দেন। লিখিতভাবে সাক্ষ্য প্রদান করেন ৪২ জন। তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী হামলা এবং পূজামন্ডপে হামলার বিস্তারিত বিবরণ দেন। গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই হামলার সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাফিলতির অভিযোগ করেন। সাম্প্রদায়িখ হামলা ঘটনাসমূহ পুর্বপরিকল্পিত এবং হামলাকারীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে কৌশল অবলম্বন করেছিল বলে গনশুনানিতে উঠে এসেছে। গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক’র নেতৃত্বে চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সন্ত্রাস সম্পর্কে তদন্ত ও গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাস-এর আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, প্রাক্তন আইজিপি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ নুরুল আনোয়ার, গণকমিশন’র সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, গণকমিশন’র সচিবালয়ের সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সচিবালয়ের সদস্য শওকত বাঙালিসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। এছাড়া তদন্ত ও গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. মো. আলাউদ্দিন, নির্মূল কমিটি চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি দিপঙ্কর চৌধুরী কাজল, যুগ্মসম্পাদক আবু সাদাত মো. সায়েম প্রমুখ। চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য ও সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন নগরীর জেএম সেন হল পূজামন্ডপে হামলার বিস্তারিত বিবরণ দেন। গণশুনানি শেষে তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণশুনানিতে যারা বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের কথায় মনে হয়েছে এখানে (চট্টগ্রামে) সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে এবং সংঘবদ্ধভাবে। পুলিশ প্রশাসনের শিথিলতার কথা এসেছে। এই অভিযোগ আমরা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পেয়েছি। এটা কেন, কী কারণে সেটা আমরা এখনও উদঘাটন করতে পারিনি। হামলার শিকার মানুষের মধ্যে এখনও আতঙ্ক আছে। অনেকে সরাসরি সাক্ষ্য না দিয়ে লিখিতভাবে দিয়েছেন। আমরা সারাদেশে তদন্ত শেষ করে দ্রুত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আজ দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ধূলিস্যাৎ হতে বসেছে। তবে এতে আমাদের হতাশ হলে চলবে না। তদন্তের মধ্য দিয়ে পাওয়া সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রকৃত চিত্র যদি আমরা তুলে ধরতে পারি, তাহলে সমাজে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সচেতন হবেন এবং প্রতিবাদে এগিয়ে আসবেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়তে চাই।’ তিনি বলেন, দুষ্কৃতিকারী যারা অপরাধ করেছে তাদের অনেকেই জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছে। জয় বাংলা স্লোগান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এই স্লোগানকে বিতর্কিত করার একটা অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। আমরা মনে করি, জামায়াত-বিএনপি থেকে দলছুট হয়ে যারা অন্যদলে এসেছে, তারাই জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক আঘাতগুলো করেছে।’ সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ঃ গণশুনানিতে অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা-শাহমীরপুর সনাতন পাড়া দুর্গাপূজা কমিটির সভাপতি সজল দাশ জানান, অষ্টমীর রাতে তাদের পূজামন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় তিনি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর থেকে হামলাকারী ও তাদের প্রতিবেশী গ্রামবাসী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে মামলা তুলে ফেলার জন্য হুমকি দিতে থাকে। ঘটনার সাথে যারা জড়িত না তাদের গ্রেপ্তার করা হয় অথচ প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। সজল রাজি না হলে তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রাণনাশের আশঙ্কায় সজল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছেন। গ্রামে তার একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান আছে। সেটি গত একমাস ধরে বন্ধ অবস্থায় আছে। চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অমিত হোড় শুনানিতে বলেন, ‘১১ অক্টোবর রাতে তাদের মন্ডপে প্রতিমা নেওয়ার সময় স্থানীয় ফলের আড়ত থেকে ফল ছুঁড়ে প্রতিমার হাত ভেঙে দেওয়া হয়। শিববাড়ি মন্দির যিনি ভাঙ্গেন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় রয়েছেন। তার নাম আবুল কাশেম ও তার ছেলে নাছির উদ্দীন বাহাদুর। তাদের নেতৃত্বে অতীতেও একবার মন্দির ভাঙচুর হয়। এই বিষয়ে একটি মামলা হলেও এখনও তার সুরাহা হয়নি। ১৯৭৮ সাল থেকে জোর করে আমরা পূজা উদযাপন করছি। পূজা এলেই গন্ডগোল হয়, এবারও হয়েছে। আমরা এর সুরাহা চাই। কর্ণফুলী পূজা উদযাপন পরিষদ-এর সাবেক সদস্য দেবরাজ রতন বলেন, ‘এইবারও প্রতিমা নিয়ে দামুপুমুর পাড় আসরে প্রতিমা উপর হামলা হয়। হামলার সময় কাশেমের ছেলেও ছিল। আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। হঠাৎ ওসি, এসআই এসে আমাদের কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যায়। অথচ যারা হামলা করে তাদেরকে পুলিশ আজও গ্রেপ্তার করেনি।’ নাপুড়া শেখের খীল কালিবাড়ি পূজা উদযাপন পরিষদের রাজিব কান্তি গুহ বলেন, ‘১৩ অক্টোবর ২০২১ রাত ৯টা বিভিন্ন জায়গায় থেকে একত্রিত হয়ে হাজার হাজার লোক স্লোগান দিয়ে আমাদের মন্দিরে হামলা করতে এলে আমরা তাড়াতাড়ি পূজা শেষ করে মন্দিরের ভেতরে অবস্থান নিই। মন্দিরের পাশে বাজার থেকে হামলাকারীদের প্রতিহত করতে গেলে তারা আমাদের উপর ইট, পাটকেল ছুড়তে থাকে। এই ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে লাইভে আমাদের একজন ধারণ করে। পরবর্তীতে আমরা লাইভ ভিডিওতে দেখতে পাই পুলিশ আমাদের মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং দুর্বৃত্তরা মন্দিরের গেট ভাঙছে। আমাদের লোকেরা আহত হচ্ছে, অথচ পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।’

# ১৫.১১.২০২১ চট্টগ্রাম #