বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৮)

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত কয়েক সপ্তাহে দেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বিষয়ে আর ফিরে আসব না, তবে মনে হয় আরও কিছু কথা এ নিয়ে বলা দরকার।

এর মধ্যে বেশ কিছু লোক, যারা এই সন্ত্রাসের পেছনে ছিল, ধরা পড়েছে। আশা করি এদের বিচার হবে, তবে আজকের কথা অন্য বিষয়ে। আসামীরা ধরা পড়ার সাথে সাথে উদ্ধার করা হয়েছে অনেক লুটের মাল। আর কথা এ নিয়েই, বিশেষ করে মন্দির থেকে উদ্ধারকৃত প্রচুর সোনাদানা আর টাকা পয়সা নিয়ে।

যদি ধর্মের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি দেখব একসময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সাধারণ বুদ্ধিতে দিয়ে বুঝতে না পেরে তারা ভেবেছে এসবই কোন অলৌকিক শক্তির কাজ। এভাবেই তারা সেই শক্তিকে ভক্তি করতে শুরু করেছে। তৈরি হয়েছে উপাসনালয়, ধর্ম, ধর্মীয় রীতিনীতি। সেদিক থেকে বিচার করলে উপাসনালয় একসময় ছিল বর্তমানের সমবায়ের মত। আর তাদের কাজ ছিল একসাথে বিপদ মোকাবিলা করা, একে অন্যকে সাহায্য করা। আর পূজা অর্চনা ছিল ঈশ্বরের কোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রচেষ্টা ঠিক যেমন করে আজকাল মানুষ নেতাদের সন্তুষ্ট করতে চায় বিভিন্ন উপঢৌকনের মাধ্যমে।

২০১৬ সালে যখন দেশে গেলাম পাশের বাড়ির এক লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। গ্রামের এক ফ্যাক্টরিতে ও আর ওর স্ত্রী কাজ করত, এভাবেই চলত সংসার। তাই হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানে পারিবারিক বিপর্যয়। গ্রামের অনেকেই এগিয়ে আসে ওর সাহায্যে।

একদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে আছি, পশ্চিম পাড়া থেকে একজন এল দেখা করতে। ও আমার পরিচিত, এক সময় আমার হাত ধরেই ওরা খেলাঘরে যোগ দেয়। তখন থেকেই ভাল সম্পর্ক। এখনও দেশে গেলে দেখা করে।

– কাকা, আমরা একটা নাটমন্দির করছি, যদি কিছু সাহায্য করেন?
– তুমি তো জানই এসব কাজে আমি উৎসাহী নই।
– আপনি বাইরে থাকেন, সবাই আপনার সহযোগিতা আশা করে।
– আচ্ছা, বল তো নাটমন্দির  দিয়ে কী হবে? এমনিতেই তো ওখানে অষ্ট প্রহর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভাল ভাবেই হয়ে আসছিল।
– তা ঠিক। তবে আমাদেরও তো ইচ্ছে করে একটু ভাল ভাবে ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করার।
– তোমাদের কি এ ব্যাপারে কোন ফান্ড আছে?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা, এই যে পাশের বাড়ির লোকটা, যে তোমাদের কমিউনিটির একজন, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। তোমরা কি তার জন্য কিছু করেছ?
– আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওর চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়েছি।
– ব্যক্তিগত। যেটা তুমি দিতে পারতে আবার নাও দিতে পারতে। এটা অনেকটা মালিকের দয়ার মত। কিন্তু নাটমন্দিরের পাশাপাশি তোমরা যদি এসব দুঃস্থ মানুষের জন্য একটা ফান্ড তৈরি করতে তাহলে ওকে কিন্তু কারও মুখাপেক্ষী হতে হত না। ও বা ওর পরিবার জানত বিপদে পড়লে একটা আশ্রয়স্থল আছে যেখানে নিঃসংকোচে সাহায্যের জন্য আবেদন করা যাবে। আমাদের কমিউনিটিতে কিন্তু এরকম লোকের অভাব নেই। অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে টাকাপয়সার অভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে না, অনেকের বিয়ে আটকে যায়। মানুষের বিপদেই যদি তোমরা এগিয়ে আসতে না পার দেবতার পূজা করে কী হবে? ধর্মেই তো আছে জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তোমরা পূজা পার্বণ কর তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু সেই সাথে যদি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারতে তাহলে মন থেকে তোমাদের সাহায্য করতে পারতাম।  আমার কথাগুলো ভেবে দেখ। যদি সাড়া পাই, আমি অবশ্যই সাধ্যমত তোমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করব।

আমাদের সেই আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। আমরা এখনও মানুষের বিপদে এগিয়ে আসার চেয়ে দেবতাদের খুশি করতেই বেশি পছন্দ করি।

মন্দিরের ঐ ধনসম্পদ দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, এই যে টাকাপয়সা, এই যে স্বর্ণালঙ্কার এটা কার কোন কাজে লাগবে? অথচ ধর্মের ইতিহাস বলে এর উৎপত্তিই হয়েছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। শুনেছি বিদ্যানন্দ সহ বিভিন্ন সংগঠন অর্থ সংগ্রহ করছে এবারের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সাহায্য করার জন্য। বিদেশেও অর্থ সংগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু কোন মন্দিরের কথা শুনিনি যারা নিজদের সঞ্চয়ের কিছুটা হলেও এ কাজে ব্যয় করেছে। ২০১৪ সালের সন্ত্রাসের পর অনেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেসব মেয়েরা ঢাকায় কাজ করে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। যত দূর জানি সরকার থেকেও প্রতি বছর পূজা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুদান দেওয়া হয়। এর একটা অংশ কি বিভিন্ন জনহিতকর কাজে ব্যবহার করা যায় না? কত ছেলেমেয়ে আছে যারা অর্থের অভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে না। শুরুতে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু বৃত্তির কথা ভাবা যেতে পারে। আরও ভাল হয় যদি এসব সাহায্য শুধু নিজেদের কমিউনিটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। তাহলে সেটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করেছে, তাই আমার এই প্রস্তাব নতুন কিছু নয়, তাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করা।

যখনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হয় তখন এরা সরকারের কাছে আবেদন করে প্রতিকারের জন্য। কিন্তু আপনার ঘরে আগুন লাগলে পাড়াপড়শির কাছে সাহায্য চাইবার সাথে সাথে নিজেকেও তো বালতি হাতে নামতে হবে, নাকি শুধু অন্যদের ডাকলেই সমস্যার সমাধান হবে। তাই সময় এসেছে নিজেদের মধ্যেও পরিবর্তন আনার, নতুন বাস্তবতার সাথে নিজেদের বদলানোর। আজও জাতপাত সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন হিন্দু সমাজকে শুধু দ্বিধাবিভক্তই করছে না, একে পশ্চাৎপদ করে রেখেছে। ফলে শুধু কমিউনিটিই নয় সারা দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যদি ধরেই নেই বাংলাদেশে বর্তমানে হিন্দুদের সংখ্যা দেড় কোটি তাহলে মেয়েদের সংখ্যা কম করে হলেও পঁচাত্তর লাখ। এই বিরাট জনগোষ্ঠী বলতে গেলে অধিকারবিহীন। তাদের না আছে বাবার সম্পদে অধিকার, না আছে স্বামীর সম্পদে অধিকার। মনে হয় এখনই সময় সম্পত্তির উপর হিন্দু নারীর অধিকারের ব্যাপারে ভাবা। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু হিন্দু কমিউনিটিই নয়, দেশও লাভবান হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক অবিচার কিছুটা হলেও কমবে। একই ভাবে দরকার বিয়েকে শুধু ধর্মীয় নিয়মেই নয় দেশের আইনের মাধ্যমেও আইনসংগত রূপ দেওয়া। কারণ হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম না থাকায় অনেক নারী ভীষণ ভাবে অবহেলিত হয়, অনেকেই বছরের পর বছর বাবার বাড়িতে দিন কাটায়। হিন্দু সমাজ যদি নিজেদের ভেতরের অমানবিক রীতিনীতি বর্জন করে মানবিক হয়ে উঠতে পারে তাতে তারা শুধু যে সামাজিক ভাবেই উপকৃত হবে তা নয়, অন্যান্য কমিউনিটির উদার মানুষদের সমর্থনও পাবে। জাতপাত সহ বিভিন্ন মধ্যযুগীয় আইনের উপস্থিতি মানবিক কারণেই অনেককে তাদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধাগ্রস্থ করে। যদিও অনেক রীতিনীতিই সময়ের সাথে বদলে গেছে সেসব হচ্ছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সময় এসেছে এসব স্বতঃস্ফুর্ত পরিবর্তনকে সামাজিক ভাবে গ্রহণ করার।

তাই এক দিকে যেমন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে অন্যদিকে নিজেদের সমাজেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার যদি শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়ও তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্যার শুধু আংশিক সমাধান হবে। সমস্যার সার্বিক সমাধানের জন্য পাশাপাশি দরকার নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্কের আমুল পরিবর্তন, কেননা এ ছাড়া কমিউনিটির প্রতিটি সদস্যের  মানবিক অধিকার রক্ষা করা অসম্ভব। তবে এই সামাজিক সংস্কার শুধু হিন্দু নয়, দেশের সব কমিউনিটির মধ্যেই আনা দরকার। আমরা যদি এক দেশ, এক জাতির কথা বলি তাহলে শুধু আন্তসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই নয় সম্প্রদায়ের ভেতরেও সম্প্রীতি দরকার। আর এক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা একান্ত ভাবে প্রয়োজন। তাদের যেমন এক দিকে ওয়াজসহ যেসব কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায় সেসব কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে একই ভাবে জাতপাত ইত্যাদি যা মানুষের নাগরিক অধিকার খর্ব করে সেসব থেকেও সমাজকে মুক্ত করতে হবে। বেশ কিছুদিন আগে পাপ পুণ্য নামে লিখেছিলাম যেখানে বলেছিলাম আমাদের ধর্মীয় পাপ পুণ্য, সামাজিক ন্যায় অন্যায় আর রাষ্ট্রীয় আইনি বেআইনি অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পর বিরোধী। যেহেতু রাষ্ট্রে আইনই শেষ কথা তাই এদিকটা  খেয়াল করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং কোন ক্ষেত্রে এসব ধারণা পরস্পর বিরোধী হলেও কোন মতেই যাতে রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। আর সেজন্যে আইন প্রণয়ন ও সঠিক প্রয়োগের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও পরিবর্তন আনতে হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো