চলমান সংবাদ

ত্রিকালদর্শী ও প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা কমরেড জসিমউদ্দীন মন্ডল স্মরণেষু

– রবীন গুহ

১৯২২ সালে অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার কালিদাসপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।  বাবার রেলের চাকুরীর ১৩ টাকা বেতনের সংসারে  ঠিকমত অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মেটেনা। অভাব অনটনের সংসারে বাবা-মায়ের খিটির-মিটির লেগেই থাকে। একদিন বাবা ঘরে ফিরে দেখলেন রান্না এখনো শেষ হয়নি। খেকিয়ে উঠলেন, কর কি সারাদিন? এখনো রান্না শেষ হয়নি! মাও সাথে সাথেই জবাব দিলেন, ছেঁড়া কাপড়ে তালি লাগাই। নতুন কাপড় তো কেনার উপায় নাই, কী আর করা!

ছোট্ট জসিম একদিন জানতে চাইলেন, মায়ের কেন নতুন কাপড় নেই? মা বললেন, এমন কপাল শুধু ধনীদেরই হয়, গরীবের জন্য এমন কপাল বানানো হয়না। মায়ের এমন একটা কথাতেই বালকের মনে প্রচন্ড আঘাত লাগে। সে ভাবলো, এ আবার কেমনতরো কপাল! এই কপাল বানানেওয়ালাই বা এমন কেন? কপাল আর কপাল বানানেওয়ালা দুজনকেই তার একদম পছন্দ হলোনা!

শৈশবে নিজের ঘরে দারিদ্র্য দেখেছেন। আর একটু বড় হয়ে কৈশোরে দেখেছেন মানুষের ‘আজাদী’র জন্য লড়াই। এই ‘আজাদী’ কেবল ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তি নয় , দারিদ্র্য থেকেও মুক্তি। বয়স তখন তের কী চৌদ্দ। ভারত ছাড় আন্দোলন  তখন তুঙ্গে। পাঁচিলের উপর বসে কয়েক বন্ধু দেখছিলেন রাস্তা দিয়ে যাওয়া  ব্রিটিশ বিরোধী মিছিল। অনেকটা হঠাৎ করেই উপর থেকে তিন-চারজন লাফিয়ে পড়লেন ঠিক মিছিলের সামনে। কে যেন চেঁচিয়ে বললো, সামনে না, আমাদের পেছন পেছন আসো। সেই শুরু মিছিলে মিছিলে পথচলা। এর কয়েকদিন পরে আবার একদিন পাঁচিল থেকে লাফিয়ে পড়লো তারা মিছিলে। এবার কিশোর জসীমের হাতে তুলে দেয়া হল লাল ঝান্ডা। লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে মনে হলো এক বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিলো সে। এই দায়িত্ব গরীবের ‘কপাল’ বদলের দায়িত্ব। এমন একটা ঘুণেধরা সমাজ তার আর চাইনা। পরিণত বয়সে সেই অনুভুতি প্রকাশ করেই একদিন বলেছিলেন, “এই পঁচা গলা সমাজটাকে ভাঙ্গতেই হবে, সুন্দর করে একটা নতুন সমাজ গড়তেই হবে। ‘

১৯৪০-এ শিয়ালদহে ১৫ টাকা বেতনে রেলের চাকরি শুরু করেন। সে বছরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান। রেলের শ্রমিক আন্দোলনে তিনি জ্যোতি বসুর সহযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে জ্যোতি বসুর হয়ে প্রচারেও  অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর জসিম মণ্ডল পার্বতীপুর বদলি হয়ে আসেন। ১৯৪৯ সালে রেলের রেশনে চাউলের পরিবর্তে খুদ (চালের কুড়া) সরবরাহ করলে রেল শ্রমিক ইউনিয়নের ‘খুদ স্টাইকের’ অপরাধে জসিম উদ্দিন মণ্ডলসহ ছয় নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং রেল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকুরিচ্যুত করে। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি মুক্তি পান। তবে এর পরবর্তীতেও পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়  মেহনতী মানুষের অধিকারের  জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে কারাবরণ করেন। সব মিলিয়ে সতের বছরের দীর্ঘ কারাজীবন তিনি ভোগ করেছিলেন।

কিশোর বয়সেই জসিম মণ্ডল দেখা পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতার। অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজফ্ফর আহ্‌মদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার সৌভাগ্য হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাম্নিধ্যেও এসেছিলেন তিনি। সুকান্ত যেদিন মারা গেলেন প্রিয়জন হারানোর ব্যদনায় অঝোরে কেঁদেছিলেন। এইসব মহৎ মানুষদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে তিনি নিজেই গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

কমরেড জসিম মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাঁধে লেখা ছিল ‘আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)’। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নানাবিধ সাহায্য করেছেন।

জেলের জীবনে বিভিন্ন সময় সত্যেন সেন, নগেন সরকার, শহীদুল্লাহ কায়সারের মত সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের  নমস্য ব্যক্তিদের  সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সত্যেন সেন, নগেন সেনকে জসিম গুরু মানতেন। জেলে থাকা অবস্হায় জসিম  বলতেন ‘দাদা, এ দেশের মানুষ গান খুব পছন্দ করে। মুকুন্দ দাসের মতো একটি গানের দল না বানাতে পারলে এ দেশে বিপ্লব হবে না। ‘ রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনেরা ঠিক করলেন, ‘হ্যাঁ গানের দল হবে’। নানা চিন্তাভাবনা শেষে একদিন ঠিক হলো, নাম হবে উদীচী। অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে যে আলোর উদয় হয়। ঢাকা জেলের ২৬ নম্বর সেলে সত্যেন সেন উদীচীর জন্ম দিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তারা দল তৈরি করেন।

কমরেড জসিম ও তার পরিবার পাকিস্তান নামক রাস্ট্রের অস্তিত্ব  প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেনি।তাই কমরেড জসিম মিছিলে শ্লোগান তুলেছিলেন, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভূখা হে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখেন জসিম মণ্ডল। তাঁর  স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাজাকারদের দেওয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাই যুদ্ধের সময় পুরো ঈশ্বরদীতে কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা না হলেও তার বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জসিমের পুরো পরিবারের মুল কাজ ছিল দেশের ভেতরে যাওয়া ও যুদ্ধের জন্য ছেলেদের সংগঠিত করা। আর যারা সীমান্তের ভেতরে বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আছে, তাদের দেখাশুনা করা। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া। গ্রামগুলোতে তাদের অনেক নিরাপদ ঘাঁটি ছিল।জলপাইগুড়ি, দিনহাটাসহ সব সীমান্তে ঘুরে বেড়াতেন এই বিপ্লবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা কাজে গোটা ভারতের অর্ধেক ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বা তার পরিবারের কেউ কোন সনদ বা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেননি।

জসিম উদ্দিন মণ্ডলের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া এক খণ্ড জায়গায় তিনি বসবাস করতেন। বাড়ির পাশেই নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে   পশ্চিম টেংরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়।

শ্রমিক আন্দোলনের এই কিংবদন্তি নেতা ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।

আজীবন নিজে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল থেকেও নিজের ভাগ্য বদলের জন্য চেস্টা করেননি কখনো। নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিলনা। তবে একদম সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহার করে অসাধারণ বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা ছিল জসীম উদ্দীন মন্ডলের। তিনি  ছিলেন ত্রিকালদর্শী। ব্রিটিশ রাজ খেদাও আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, মুক্তিযুদ্ধে অবদান এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রেলশ্রমিক তথা দেশের শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর প্রবাদপ্রতীম ভূমিকার কথা এদেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।

l