বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা – (১২তম পর্ব)

– বিজন সাহা

আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

করি। তবে একটা শর্তে।

শর্ত ছাড়া করা যায় না?

দেখুন জীবনটাই শর্ত। আমরা যা কিছু করি সবই শর্ত সাপেক্ষ।
যেমন?
সে অনেক কথা। অন্য কোন সময় এ নিয়ে কথা বলব।

ঠিক আছে। কিন্তু ঈশ্বরকে নিয়ে আপনার শর্তটি কি শুনতে পারি?

ওনাকে বিদ্যাসাগর হতে হবে।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০১ তম জন্ম দিন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮২০ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঠিক ১০০ বছর আগে। কিন্তু এ নিয়ে দেশে তেমন কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। এ বছর রুশ লেখক দস্তয়েভস্কির ২০০ তম জন্মদিন বেশ উৎসাহের সাথে পালন করা হচ্ছে এদেশে। আমাদের দেশেও তাঁর অনুসারীরা এ উপলক্ষ্যে বই বের করছেন। এমন কাজ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে হয়েছে বলে শুনিনি। অথচ হতেই পারত।

বাংলাদেশ বিশ্বের অনন্য এক দেশ যার জন্ম ভাষা থেকে। হ্যাঁ, ভাষা থেকে। এই ভাষাকে কেন্দ্র করেই একুশ। যদি ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা অপমানিত না হত, অধিকার বঞ্চিত না হত তাহলে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের অকাল মৃত্যুর কোনই কারণ ছিল না। অন্তত ভূমিষ্ঠ হবার পর পরই পাকিস্তান মৃত্যু ব্যাধিতে আক্রান্ত হত না। কিন্তু পাকিস্তান সে পথে যায়নি। তারা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, উত্তরে বাঙালি ঘর ভেঙ্গেছে, স্বাধীন হয়েছে। আজ শুধু দেশই স্বাধীন নয়, একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর আধুনিক বাংলা ভাষার রূপকারদের একজন এই বিদ্যাসাগর। তাই তাঁর জন্মদিন মর্যাদার সাথে পালিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আসলে সাতচল্লিশ পূর্ব বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি এসবের প্রতি আমাদের অনীহা আমাদেরকেই দীন করে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত করে। বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ভালবাসা যদি সত্যিকার অর্থেই লোক দেখানো না হয়, আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করতে চাই, তাহলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যারা এই ভাষা, এই সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছেন, উন্নত থেকে উন্নততর করেছেন তাদের কথা বলেতে হবে, তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে, তাদের লেখা, তাদের কাজ সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
আজ দেশে অনেক কিছুর সাথে নারীবাদও গতি পেয়েছে। অনেক মহীয়সী নারী আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছেন। তবে নারীর অধিকার আজও সমাজে স্বীকৃতি পায়নি। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বলতে গেলে একাই লড়াই করে গেছেন। বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা এসব তো তাঁর হাত দিয়েই শুরু। নারীবাদীরাও তো সেই অবদানের কথা স্মরণ করে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্য কিছু করতে পারে, তাঁর কথা, তাঁর কাজ, তাঁর অবদানের কথা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারে।

তবে এসব তো গেল অন্যদের কথা। এবার আসা যাক বামদের কথায়। না না, ঈশ্বর চন্দ্রকে কখনোই বাম বলা যাবে না। তাঁর নামই বাম বিরোধী। কিন্তু তাঁর কাজ?

আমাদের রেনেসাঁ শুরু হয় ইংরেজদের হাত ধরে। রামমোহন রায় এ জন্যে বিলাত গিয়েছিলেন। এরপরে যারা কী রাজনৈতিক, কী সামাজিক, কী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। তবে এদের অনেকেই সেটা করেছেন ইংরেজের কাছে নতজানু হয়ে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরও সমাজ সংস্কার করেছেন ইংরেজদের উপর নির্ভর করেই। কিন্তু তাই বলে তিনি আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেননি। নিজের ইংরেজ কলিগদের ব্যবহারের প্রত্যুত্তরে তিনি টেবিলের উপর পা তুলতে দ্বিধাবোধ করেননি। এটা অভদ্রতা নয়, সাহেবদের বোঝানো বাঙালি বা কালো চামড়ার মানুষ হলেও আমাদের আত্মমর্যাদা আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীন দেশেও আমরা প্রায়ই আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে পারি না।

এখানে আরও একটা বিষয় উল্লেখ করা যায়। আমাদের দেশে অনেকেই সার্বক্ষণিক রাজনীতি করেন। বিশেষ করে বাম ঘরানার রাজনীতি যারা করেন। এ জন্যে তারা পার্টি থেকে অনুদান পান। এতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই এই সব সার্বক্ষণিকের জীবন হয় কষ্টের। সংসারে অনটন লেগেই থাকে। অন্তত আমি যখন দেশে ছিলাম, চিত্রটা এমনই ছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই অনেক সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই সাথে চাকরিও করতেন। আয় করতেন যথেষ্ট আর অর্থ দিয়ে শুধু স্কুল কলেজই চালাতেন না, মাইকেল মধুসূদন দত্ত সহ অনেককেই সাহায্য করতেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মতিলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত রাজনীতিবিদগণও রাজনীতির বাইরে নিজেদের পেশায় কাজ করে যথেষ্ট উপার্জন করতেন। রাজনীতি যদি পেশা হয়ে যায়, তার মধ্যে যদি চ্যারিটি না থাকে সেটা একদিন জনগণের কথা ভাবতে ভুলে যায়। এখান থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ যে নিজে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল না হলে সমাজের জন্য খুব বেশি কিছু করা যায় না।

তবে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি করে আমাদের শেখা দরকার ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে সেটা হল তাঁর কাজের পদ্ধতি।  “তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে” কথাটি মহামায়া বলেছিলেন কংসকে উদ্দেশ্য করে। এর একটা অর্থ হতে পারে “সবকিছুর ধ্বংসের চাবিকাঠি তার ভেতরেই থাকে।” কোন কিছু বদলাতে হলে ভেতর থেকেই সেটা করতে হয়, শুধু বাইরে থেকে কোন কিছু পরিবর্তন করতে গেলে প্রচণ্ড বিরোধের মুখোমুখি হতে হয় যা অতিক্রম করা অনেক সময়ের ব্যাপার। ঘরের শত্রু বিভীষণের সাহায্য ছাড়া রামও সহজে লঙ্কা জয় করতে পারে না। এটা বললাম এ কারণে যে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য জনমত গড়তে শুরু করেছেন তখন হিন্দু সমাজের প্রাভাবশালী লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি বড়লাট ডালহৌসি দ্বিধাগ্রস্থ। তখন তিনি বড়লাটের কথায় শাস্ত্রের সাহায্য নিতে  উদ্যোগী হন আর দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের সাথে পড়াশুনা করে শাস্ত্রেই বিধবা বিবাহের পক্ষে যুক্তি খুঁজে পান। শুধুমাত্র শাস্ত্রের সাহায্য নিয়েই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সামাজিক বাধাগুলো পেরিয়ে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। বিধবা বিবাহ প্রচলন বা সতীদাহ রোধ – এগুলো শুধু সামাজিক নয়, মানসিকতার পরিবর্তনও বটে। এসব পরিবর্তন মানতে গিয়ে ব্যক্তি মানুষকে শুধু নয়, পুরো সমাজকে একটা বিশাল মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আর বিধবা বিবাহ প্রচলন সফল ভাবে তিনি করতে পেরেছেন, মানুষের সমর্থন লাভ করতে পেরেছেন শুধুমাত্র যে শাস্ত্র মানুষ বিশ্বাস করে সেই শাস্ত্রকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে বা শাস্ত্রের মধ্যে তাঁর এই কর্মকাণ্ডের যুক্তি খুঁজে বের করে।

বহুবিবাহ রদ করতে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এলাকায় যারা বহুবিবাহ করেছেন তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যেটা পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আইন পাশ করাতে সহায়ক হয়। এখান থেকেও শিক্ষা নেবার আছে। যেমন ধরুন যখন কোন কারখানায় শ্রমিকেরা বেতন পায় না বা কোথাও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয় তখন বিভিন্ন দল সেখানে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। কিন্তু যেসব জায়গায় এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে সেখানে যদি তারা আগে থেকেই যান প্রতিপক্ষ জানবে এরা একা নয়। সেটা একদিকে যেমন যারা অন্যায়ের শিকার হয় তাদের মনোবল বাড়ায়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষকে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তায় ফেলে। আসল কথা হল যেকোনো কাজে নামার আগেই তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ভাবা, সকল ধরণের সবলতা, দুর্বলতা মাথায় রেখে সামনে এগুনো। এই ভাবনাই বিজ্ঞানমনস্কতা।

আজ আমরা যখন সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার কথা বলি, আমরা সেটা সমাজের ভেতর থেকে না করে সাধারণত নিজেদের সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সেটা করি বা করতে চাই। যুগ যুগ ধরে জেঁকে বসা বিশ্বাস সাধারণ মানুষকে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে। আমাদের প্রচেষ্টা হয় বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া। যেটা দরকার, সেটা হল ভেতর থেকে পরিবর্তন আনা, প্রতিষ্ঠিত সামাজিক আচার আচরণ, মূল্যবোধকে উপহাস না করে, সেই মূল্যবোধের ভেতর থেকে যুক্তি বের করেই সমাজকে পরিবর্তন করা। সেক্ষেত্রে সমাধানটা হয় স্ব-সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সেলফ-কনসিস্টেন্ট। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা বুঝেছিলেন। দুঃখজনক হলেও আমরা নিজেরা সেটা বুঝি না। একটা সময় ছিল যখন কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ইত্যাদি পার্টির ভেতর কাজ করে তাদের প্রভাবিত করত। আসলে যে কোন কাজেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রধান উপায় তাঁকে কনভিন্স করা। আজ আমাদের দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সমাজ বিরোধী ও সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম করা হয়। অনেকেই এসব কাজকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু তারা যদি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত ধর্মগ্রন্থেই এসব কাজের প্রতিষেধক খোঁজার চেষ্টা করতেন সেটা হয়তো অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত। অন্তত আমাদের রাজনীতিবিদরা ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারেন। সেদিক থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তাঁর চিন্তা ভাবনা, তাঁর কর্মপদ্ধতি আজও প্রচণ্ড রকম প্রাসঙ্গিক।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া