মতামত

বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮ প্রসঙ্গে

-ফজলুল কবির মিন্টু

হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে শিল্প মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে “জাহাজভাঙ্গা ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা-২০১১” নামে জাহাজভাঙ্গা শিল্প সেক্টরের জন্য একটা বিধিমালা প্রণয়ন করেছিল। বিধিমালা প্রনয়ণ করা হয় সাধারণত মূল আইনকে ব্যাখ্যা করার জন্য। অথচ শিল্প মন্ত্রণালয় কোন আইন প্রণয়ন না করে শুধুমাত্র বিধিমালা প্রণয়ন করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে শিল্প মন্ত্রণালয় “বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮” নামে একটা আইন প্রণয়ন করে কিন্তু সমালোচনা পিছু ছাড়েনি। এই আইনের শিরোনাম হতে ভাঙ্গা শব্দ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ লিখায় এই আইনটি কেবল মাত্র জাহাজভাঙ্গা শিল্পের জন্য প্রযোজ্য কিনা তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়। অবশ্য আইনের ভিতরের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় এই আইনটি আসলে জাহাজভাঙ্গা শিল্প সেক্টরের জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে।

এখন“বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮” নিয়ে কিছু বিষয় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। আইনটিতে ৮টি অধ্যায় ও ৪৬টি ধারা রয়েছে। জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও ইয়ার্ডের কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন এবং হংকং কনভেনশন সহ শিল্প সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট অনুসরন করার মত সক্ষমতা অর্জন এবং এ উদ্দেশ্যে আইন প্রনয়ন করার লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

অত্র আইনে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানের সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে সরকারকে একটা জাহাজভাঙ্গা পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ড নামে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা গঠণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে চেয়ারম্যান করে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় তথা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিস্ফোরক অধিদপ্তর হতে একজন প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি, নৌবাহিনীর প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পুলিশ চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোশিয়েশনের সভাপতি সহ মালিক পক্ষের ২ জন প্রতিনিধির সমন্বয়ে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ডে কোন শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই বহুল আলোচিত এই আইনে স্টেকহোল্ডার হিসাবে শ্রমিক শ্রেণীকে অস্বীকার কিংবা অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন এবং আইন প্রণয়নেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। এ আইনের ২০ ধারায় ইয়ার্ডে কর্মরত আহত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক জীবন বীমা ছাড়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও পেশাগত  নিরাপত্তা বিষয়ে মালিকের আর কোন করনীয় সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।

এ আইনে বোর্ডের মাধ্যমে প্রত্যেক ইয়ার্ডে সেফটি অফিসার নিয়োগ, শ্রমিকদের প্রশিক্ষন কারিকুলাম তৈরি, প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান মনোয়ন এবং তাদের কার্যক্রম মনিটরিং, ৫ বছরের মধ্যে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের একটা হালনাগাদ ডাটাবেজ তৈরি, প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সনদধারী শ্রমিকদের দ্বারা জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রম পরিচালনা, ব্যবহৃত তেল, Sludge হ্যান্ডলিং, এসবেস্টস সহ ক্ষতিকর পদার্থ হ্রাস করার জন্য যোগ্য এজেন্সি নিয়োগ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। এ আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে ছাড়পত্র দেয়ার পূর্বে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জাহাজ বহির্নোঙরে থাকা অবস্থায় জাহাজের মধ্যে থাকা বর্জ্যের তালিকা প্রস্তুত করবেন। অতঃপর পরিবেশ এবং মানব সম্পদের জন্য ক্ষতিকর কোন বর্জ্য নাই এই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পর পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র দিবেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর জাহাজ কাটার পূর্বে বিস্ফোরক অধিদপ্তর হতে “Gas Free For Man Entry” এবং “Gas Free For Hot Work” মর্মে ২টি সনদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার অনুমতি পাওয়া যাবে।

দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এই প্রথা আগেও ছিল ২০১৮ সনের আইনেও তা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু কোন সনদ পেতে জাহাজ মালিকদের কোন বেগ পেতে হয়না। ফলে জাহাজে ক্ষতিকর বর্জ্য থাকুক আর না থাকুক, জাহাজে মানুষ প্রবেশের জন্য এবং গরম কাজ করার জন্য গ্যাস ফ্রি থাকুক আর না থাকুক জাহাজ মালিকরা প্রায়শঃ সনদ পেয়ে থাকেন। এ এক অজানা রহস্য।

জাহাজ রিসাইক্লিং আইনে মালিকের দায়িত্বও নির্ধারন করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে জাহাজ বিচীং করার পর এবং জাহাজ কাটার পূর্বে মালিক ইঞ্জিন রূমে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করবেন এবং বাঙ্কার খালি করবেন। রেজিস্টার্ড ডিলারের মাধ্যমে বাঙ্কার অপসারন,ব্যবহৃত তেল বা Sludge শোধনাগারের কাছে অপসারনের ব্যবস্থা করা সহ সকল কার্বনডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য সিলিন্ডার নির্ধারিত ডিলার অথবা বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্সধারী ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করবেন।

“বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮” তে জাহাজ রিসাইক্লিং বোর্ড, সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাজ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দায়িত্ব নির্ধারন করা হয়নি। ফলে শ্রমিকের জীবন মান উন্নয়ন তথা জাতি সংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর ৮ নম্বর গোল শোভন কাজ বাস্তবায়ন উপেক্ষিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।

আইনটি ভাল কিংবা মন্দ বিশ্লেষণের চেয়ে যেটা সবচেয়ে বেশী জরুরী তা হচ্ছে আইনের বাস্তবায়ন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে এ আইনে জাহাজ রিসাইক্লিং বোর্ড গঠনের কথা বলা হলেও আইন প্রনয়ন হয়েছে প্রায় তিন বছর হতে চলেছে বোর্ডও গঠিত হয়েছে কিন্তু আইন বাস্তবায়নে বোর্ডের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।

জাহাজভাঙ্গা শিল্প সেক্টর একটি উচ্চতর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র। প্রতি বছর দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে গড়ে ১৫ থেকে ১৬ জন শ্রমিক মারা যায়। অতিতের সকল রেকর্ড ভংগ করে বিগত ২০১৯ এই সংখ্যা অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ – বিলস এর তথ্যমতে ২০১৯ সালে ২৩ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। নিহতের পরিসংখ্যান জানা গেলেও আহতের সঠিক সংখ্যা জানা অনেক দুরূহ ব্যাপার, অনেক সময় সব আহতের সংবাদ ইয়ার্ডের বাইরে প্রকাশিত হয়না। বিগত ২০১৯ সালে মারাত্মক আহতের সংখ্যা ত্রিশের বেশী হবে বলে ধারনা করা হয়। ২০২০ সালে করোনার কারণে কাজ কম থাকায় দুর্ঘটনার হার কমলেও ২০২১  সালে আবারো উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুর্ঘটনায় ২ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং ৪ জন শ্রমিক আহত হওয়ায় নতুন করে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।  এ ছাড়া এসবেস্টস সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পরিবেষ্টিত পরিবেশে কাজ করে বিধায় শ্রমিকেরা ফুসফুসের নানাবিধ জটিল রোগ সহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশেজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। তাই জাহাজভাঙ্গা শিল্পে কোন আইন প্রনয়নের সময় অবশ্যই শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আবার শুধু আইন প্রনয়ন হলেই হবেনা, আইএলও কনভেশন ৮৭ এবং ৯৮ এর সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে শ্রমিকেরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের পাশাপাশি সংগঠিত হওয়া, দর কষাকষির অধিকার এবং সক্ষমতা যেন অর্জন করতে পারে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট সকলকে নজর দিতে হবে।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি