‘দিলু’ – কাওসার পারভীন
বৃষ্টি থেমেছে একটু আগে । ব্যালকনিতে আসতেই জমাট অন্ধকারে উজ্জ্বল একটা বিন্দু লক্ষ্য করলাম। একমুহূর্ত ভাবতেই বুঝে নিলাম ব্যালকনির শেষপ্রান্তে কে দাঁড়িয়ে ! ও আমাকে দেখার আগেই আমি সরে এসেছি । কাজের মাঝে সিগারেটে টান দিয়ে নিচ্ছে দিলু, আলোহীন অংশটিতে দাঁড়িয়েছে। অনেক ছবি-তথ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, সঞ্চয় করার কথা, পরিবারের কথা মনে করিয়ে আবেগ তৈরী ও বিভিন্ন দিক নিয়ে আমার সুদীর্ঘ বয়ানে, কাউন্সেলিং-এ কিচ্ছু হয়নি – তামাক, পান, সিগারেট সব বহাল রয়েছে ।
: “আবার ঐরকম হইয়া যাব” ।: “মানে ? আবার বাচ্চা হয়ে যাবে ? ” – আমিও হাসি। দিলু হাসতে থাকে, কাশির শব্দ আসে।
মাঝে মাঝেই বলি আবার। কিছু কিছু মানতে চেষ্টা করে। তবে সিগারেট-পান কিছুতেই কমাতে পারেনি দিলু ।
একসময় খান বাহাদুরদের গৃহস্থালি কাজ, মাঝে মাঝে ইট ভাটায় কাজ, পানি আনার কাজ ও ছোট বড়ো অনেক কাজ করেছে দিলু সংসারে একটু সাচ্ছন্দের আশায়। সংসার সামলাতে অবিরাম খেটেছে স্বামী-স্ত্রী দুজন। তবুও একপর্যায়ে খরচ মেটাতে ওর বর পৈতৃক বসতবাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। ছেলে-নাতিনাতনি নিয়ে পরিবারে সাতজন ওরা । প্রহরীর কাজ করে, লোকের ফরমাশ খেটে যা অর্জন করতো দিলুর বর, তা দিয়ে অনেকটা গুছিয়ে উঠতে উঠতে মানুষটা মারা গেলো একদিন । বাস-অ্যাসিস্ট্যান্ট বড়ো ছেলে সংসারের হাল ধরতে পারে না পুরোপুরি । কাছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হওয়াতে বৌমা কোনোরকমে একটা কাজ পায়। নাতি-নাতনি দুটিকে দিলু যত্ন করে আগলে রাখে, বৌমা কাজ শেষে ফিরে এলে দিলু খাবার এগিয়ে দেয়, স্নেহ তো আছেই, দায়িত্ব নেয়ায় কৃতজ্ঞতা তার চেয়েও বেশি। ছেলের পছন্দে, প্রেমের বিয়ে যদিও, অর্থের টানাপোড়েন, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তর্ক-বিতর্ক-বাহাসের একপর্যায়ে বৌমা কোলের ছেলেটিকে নিয়ে নিঃশব্দে বাবার বাড়ি চলে যায়। কদিন পর অভিভাবকের উপদেশ মেনে তালাক চেয়ে নোটিশ পাঠায়। সব অগোছালো হয়ে যায়। বড়ো ছেলে যেখানে যখন কাজ পায়, সেখানেই থাকে, মাঝে মাঝে আসে অনেকদিন পর পর। অচেনা সময় হাতড়ে নাতনি আর ছোট ছেলেকে নিয়ে দিলুর নুতন সংগ্রাম শুরু। সংসার-খরচ, নাতনির হাই-স্কুলে ভর্তি, ওর ছোট ছেলের চিকিৎসা – কি করবে বুঝতে না পেরে দিলু গ্রাম ছেড়ে আসে কাজের খোঁজে ।
কারো বাড়িতে দিলু খায় না । ওরা তিনজন একসাথে খেতে বসে, ছেলে আর নাতনিকে মুখে তুলে খাবার খাওয়ায়। কাজ শেষে মা ফিরলে মার কাঁধে মুখ রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে জড়িয়ে থাকে রতন, আনন্দিত হয়, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বলতে পারে না – ‘মা এসেছে’ তবে শব্দের চেয়ে শক্তিশালী ওর নীরব প্রকাশ ।রতনের কখনো জ্বর হলে, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে দিলু সহজে হাসে না, চোখ ছলছল করে। নুতন সমস্যা, বিপদ কত শত – তবুও দিলু নিত্য বাস্তবতার ঠোকর খেয়ে খেয়ে শূন্য থেকে উঠে দাঁড়ায়।
দিলুকে কর্ম ঘন্টা – বিশ্রামের সুস্পষ্ট বিবরণ জানিয়েছি যখন, তখন আরো বলেছি,
: “পারলে তোমার রতনের মতো আমার জন্যেও একটু মায়া রেখো “।
দিলু ভারী কাশির দমকে হাসতে থাকে, ওর চোখ চিকচিক করে ওঠে।
” —দুই ছটাক চক্ষু
ক্যামনে বলো ধরে
এক ভরি অন্তর
তিন পাহাড় দুঃখ
ক্যামনে বলো ধরে
দুই আনা প্রেমের বাকি
ও জীবন তোর
আর দুই আনা বাকি”