আফগান পার্লামেন্টের কজন সদস্য এবং হামিদ কারজাই ও ড. আব্দাল্লাহ আব্দাল্লার সাথে কাবুলে অজ্ঞাত একটি জায়গায় বৈঠক করেন। ছবিটি ১৯শে অগাষ্ট ড আব্দাল্লার ফেসবুকে পোস্ট করা হয়
আফগান পার্লামেন্টের কজন সদস্য এবং হামিদ কারজাই ও ড. আব্দাল্লাহ আব্দাল্লার সাথে কাবুলে অজ্ঞাত একটি জায়গায় বৈঠক করেন। ছবিটি ১৯শে অগাষ্ট ড আব্দাল্লার ফেসবুকে পোস্ট করা হয়

কাবুলে নতুন একটি সরকার গঠন নিয়ে তালেবান নেতৃত্ব এবং তালেবান বিরোধী আফগান রাজনীতিকদের পাশাপাশি তৃতীয় যে পক্ষটি তৎপর সেটি হলো পাকিস্তান।

কাবুলে ভবিষ্যৎ সরকারে তালেবানের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দেন-দরবার করতে গত পাঁচদিন ধরে ইসলামাবাদে অবস্থান করছেন অধুনালুপ্ত তালেবান বিরোধী জোট নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের শীর্ষ সাতজন আফগান রাজনীতিক।

তাদের মধ্যে রয়েছেন নব্বইয়ের দশকের তালেবান বিরোধী সামরিক জোটের কিংবদন্তির জাতিগত তাজিক নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের দুই ভাই, যাদের একজন – আহমেদ জিয়া মাসুদ – হামিদ কারজাই সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রয়েছেন অত্যন্ত সুপরিচিত আফগান হাজারা নেতা – করিম খালিলি এবং সাবেক যে আফগান প্রেসিডেন্টকে তালেবান ২০১১ সালে হত্যা করে সেই বুরহানউদ্দিন রাব্বানির ছেলে সালাহউদ্দিন রাব্বানি। আরও রয়েছেন আফগান পার্লামেন্টের স্পিকার মীর রহমান রেহমানি।

এই আফগান নেতারা অবশ্য বলেছেন তার নিজেদের উদ্যোগে আসেননি, বরঞ্চ পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণেই তারা এসেছেন।

পাশাপাশি, কাবুলে সাবেক প্রেসিডেন্ট কারজাই এবং দোহার মীমাংসায় আলোচনা আফগান সরকারের প্রতিনিধি আব্দাল্লাহ আব্দাল্লাহর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে যে কথাবার্তা চলছে তাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমদ খানের পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার মি. খান ও মি কারজাইয়ের সাথে একটি বৈঠকও হয়েছে।

লন্ডনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন আফগানিস্তানে পাকিস্তান যে তাদের পছন্দমত একটি সরকার চাইছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তালেবানের হাতে কাবুল পতনের পরদিন পাকিস্তানের সংবাদপত্র
তালেবানের হাতে কাবুল পতনের পরদিন পাকিস্তানের সংবাদপত্র

পাকিস্তানের লক্ষ্য – তালেবানের প্রাধান্য

“পাকিস্তানের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট। তারা কাবুলে এমন একটি সরকার চাইছে যেখানে তালেবানের প্রাধান্য থাকবে। কারণ পাকিস্তান মনে করে তালেবান সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে এবং আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব তাতে খর্ব হবে,” বলেন ড. সিদ্দিকা।

পাকিস্তান সবসময় মনে করে কাবুলে পাকিস্তান-বান্ধব একটি সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ২০০১ সালে আমেরিকার হাতে তালেবানের পতনের পর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব দ্রুত কমেছে এবং সেই সাথে বেড়েছে তাদের চির শত্রু ভারতের প্রভাব।

বিশেষ করে, আশরাফ গনি আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তার সাথে ভারতের বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে আফগান সরকারের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল। পাকিস্তানের বিশ্বাস করে, আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী তৎপরতায়, বিশেষ করে বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদে মদত দিচ্ছে, এবং কাবুলে আশরাফ গানি সরকার তাতে সাহায্য করছে।

তালেবানের আফগান দখলের পর সৌদি, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী?

তালেবানের কাবুল দখলের পর পাকিস্তান সেই বাস্তবতা বদলানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে।

তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক বলছেন, অন্য অনেকের মত পাকিস্তানও চাইছে কাবুলে ভবিষ্যৎ সরকারে তালেবানের প্রাধান্য থাকলেও সরকারে তালেবান ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুন ছাড়াও আফগানিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর – তাজিক, হাজারা, উজবেক – প্রতিনিধিত্ব থাকুক।

এবং সেই সাথে, ড.আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান আফগানিস্তানে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইছে যেখানে এক ধরণের একটি নির্বাচন পদ্ধতি থাকুক যেটা বাকি বিশ্বের কাছে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য হয়।

তবে কাবুলে একেবারে তাদের পছন্দমত একটি সরকার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পাকিস্তান করছে বলে ড সিদ্দিকা মনে করন না। তার মতে – পাকিস্তান চাইছে যে তালেবানের সাথে অন্য আফগান নেতারা নিজেরাই দেন-দরবার করে ক্ষমতার অংশীদারি হোক।

“কিন্তু একইসাথে পাকিস্তান চাইছে সবকিছু যেন তাদের জ্ঞাতসারে হোক। সে কারণেই পুরো নর্দার্ন অ্যালায়েন্স এখন ইসলামাবাদে,” বলেন ড সিদ্দিকা। এবং সেইসাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কাবুলে তৎপর।

ইমরান খান
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তালেবানের কাবুল দখলের পরদিনন তিনি বলেন, ‘আফগানরা দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে’

স্বীকৃতির মুলা

ক্ষমতা ভাগাভাগিতে তালেবান যেন রাজী হয়, তার জন্য পাকিস্তান ভবিষ্যতে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না।

১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর যে মাত্র তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তার একটি ছিল পাকিস্তান। এবার পাকিস্তান সতর্কভাবে এগুচ্ছে। মঙ্গলবার পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ভবিষ্যতে কাবুল সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে” পরামর্শ করে নেয়া হবে।

এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানও তালেবানের কাছ থেকে ক্ষমতা ভাগাভাগি-সহ নারী শিক্ষা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে প্রশ্রয় বন্ধের প্রতিশ্রুতি চায়।

কেন পাকিস্তান ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য চাপ দিচ্ছে? ইসলামাবাদে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আমির রানা বলেন পাকিস্তানের আশংকা রয়েছে সরকারে অন্যান্য পক্ষের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আফগানিস্তানে একসময় আবারো অরাজকতা শুরু হবে।

তিনি বলেন, অন্যান্য সব প্রতিবেশী দেশ এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর সাথে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জে. বাজওয়া (ফাইল ফটো)। তালেবানের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জে. বাজওয়া (ফাইল ফটো)। তালেবানের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে

তালেবান কথা শুনবে?

কিন্তু পাকিস্তানের ওপর তালেবানের কতটা প্রভাব রয়েছে? পাকিস্তানের কথা তারা কতটা কানে নেবে?

ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তালেবানের ওপর পাকিস্তানের বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রভাব অনেক।

“প্রতিদিন পাকিস্তানের প্রতিটি খুঁটিনাটি কথা হয়তো তালেবান শুনবে না। কিন্তু বৃহত্তর কৌশলগত নীতির প্রশ্নে তালেবানের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি।“

আফগানিস্তানের যুদ্ধে তালেবানের নাটকীয় বিজয় এবং আফগানিস্তানে তাদের সরকার গঠন পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসী এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের উৎসাহিত করবে, শক্তিশালী করবে – এ নিয়ে নিয়ে পাকিস্তানের একাংশের মধ্যে গভীর উদ্বেগ রয়েছে এবং তা তারা প্রকাশও করছে।

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্টী তেহরিকে তালেবান বা টিটিপি, যাদের সিংহভাগ নেতা আফগানিস্তানে পালিয়ে আছে বলে সন্দেহ করা হয়- তালেবানের বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে। লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তালেবান জিতেই যে সব বন্দিদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন টিটিপির ডেপুটি প্রধান ফাকির মুহাম্মদ।

ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, তালেবানের ব্যাপারে পাকিস্তানে জনমত যে দ্বিধাবিভক্ত কোনো সন্দেহ নেই।

“আফগানিস্তানে তালেবানের এই সাফল্যে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই কট্টর ইসলামপন্থীরা চাঙ্গা হবে, তারা ভাবছে তাদের নীতিই সঠিক। পাকিস্তানে এর প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি। কট্টর ইসলামপন্থীরা একসময় পাকিস্তানেও একই ধরণের ইসলামি শাসন কায়েমে চাপ শুরু করবে – এমন আশংকা বহু মানুষের।”

তবে, ড. সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের ভেতরে এসব দ্বিধা-শঙ্কা থাকলেও তালেবানকে আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।

“তারা এখন পাকিস্তানের জনগণ এবং বাইরে বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন ১৯৯৬ সালের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়। এরা নারী শিক্ষাকে সমর্থন করে, অন্যদের ক্ষমতার ভাগ দিতে চায়।”

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা