চলমান সংবাদ

আফগানিস্তান: নয় হাজার কোটি ডলারে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কেন তালেবানদের হামলার মুখে দিশেহারা

হেরাত প্রদেশের সড়কে পাহারা দিচ্ছে আফগান ন্যাশনাল আর্মি কমান্ডোর এক সদস্য। আফগান সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে বিপুল অর্থ খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
হেরাত প্রদেশের সড়কে পাহারা দিচ্ছে আফগান ন্যাশনাল আর্মি কমান্ডোর এক সদস্য। আফগান সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে বিপুল অর্থ খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যত টাকা খরচ করেছে তার ৬০ শতাংশ বেশি খরচ করেছে আফগান সেনা এবং নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে।

গত বছর পর্যন্ত এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ বছর বাড়তি ৩৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে আফগান সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মিলিয়ে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা কাগজে কলমে তিন লাখের কিছু বেশি। একটি বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছে। একটি কম্যান্ডো সেনা ইউনিট রয়েছে যাদের দক্ষতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকার খুবই গর্বিত। এই বাহিনীর ক্যাডেটদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার সাথে শান্তি চুক্তি করার পর তালেবান যখন জায়গা দখলের লড়াই জোরদার করলো, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা নগ্ন হতে শুরু করে। তারপর মে মাস থেকে তালেবানের শহর দখলের ঝটিকা অভিযান শুরুর পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সেই দুর্বলতা এখন কাবুল সরকারের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

তালেবান এখন আফগানিস্তানের কমপক্ষে চারটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে
তালেবান এখন আফগানিস্তানের কমপক্ষে চারটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তা জেনারেল স্কট মিলার- যিনি গত চার বছর আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন – জুন মাসে আফগান সেনাবাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে তার সন্দেহ চেপে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, আফগানিস্তান “খুব সম্ভবত চরম বিশৃঙ্খল গৃহযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে।”

একইমাসে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগগুলোর এক বিশ্লেষণে বলা হয়, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন হতে পারে। অর্থাৎ আফগান সেনাবাহিনী যে এমনকি কাবুলের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে আমেরিকানরাও সন্দিহান। গত দুই মাসের মধ্যে আফগানিস্তানের প্রায় চারশটি জেলার অর্ধেকই এখন তালেবানের দখলে । চারটি প্রাদেশিক রাজধানী এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। তালেবান দাবি করছে আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ এলাকা তারা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে। সেটা অতিরঞ্জিত হলেও আমেরিকানরাই স্বীকার করছে দেশের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা এখন তালেবানের দখলে।

ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অ্যান্ড ডেমোক্রেসিস এর একটি গবেষণাধর্মী সাময়িকী লং ওয়ার জার্নাল বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের খতিয়ান প্রকাশ করে বলছে, জুলাই মাসে মাসে আফগানিস্তানের ৫৪ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যায়। অথচ কয়েক মাস আগেও মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা ছিল তালেবানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। ধারণা করা হচ্ছে গ্রীষ্ম মৌসুম শেষের আগেই ৩৪টি আফগান প্রদেশের ১৬টি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

আত্মসমর্পণের হিড়িক

বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে আফগান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ কতটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে তার খবর প্রতিদিনই এমনকি পশ্চিমা মিডিয়াতেও বেরুচ্ছে। শত শত সৈনিক লড়াই না করেই তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ তুলে দিয়ে ইউনিফর্ম খুলে চলে যাচ্ছে। তারা তালেবানকে আলিঙ্গন করছে। অনেক সময় তালেবানরা তাদের পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বলছে। মাসখানেক আগে এক হাজারেরও বেশি সৈন্য দলত্যাগ করে তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছে।

এসব আত্মসমর্পণের ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে শহরের বাইরে যেসব সৈন্যরা বিভিন্ন ফাঁড়ি, তল্লাশি চৌকি পাহারা দিচ্ছে তারা আরো বেশি অসহায় বোধ করছে। ইসলামাবাদে সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ হোসেন, যিনি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর একজন সুপরিচিত বিশ্লেষক, বিবিসি বাংলাকে বলেন আফগান সেনাবাহিনীর পেছনে আমেরিকা অনেক পয়সা খরচ করেছে, কিন্তু তাদের পেশাদারিত্ব এখনও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

তিনি আরো বলেন, “এটা ঠিক তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছে, বিশেষ করে তাদের স্পেশাল ফোর্স ইউনিট বিভিন্ন সময়ে তালেবানের বিরুদ্ধে ভালোই লড়াই করেছে। কিন্তু সেগুলো তারা করেছে যখন আমেরিকানরা তাদের সাথে ছিল। কিন্তু আমেরিকানরা চলে যাবার পর যে নতুন পরিস্থিতি তাদের সামনে তৈরি হয়েছে তার জন্য আফগান সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল না।”

সেনাবাহিনীতে জাতিগত দ্বন্দ্ব

কেন তাদের এত অসহায় লাগছে? জাহিদ হোসেন বলেন, তালেবানের মত একটা অত্যন্ত পটু, অভিজ্ঞ একটি লড়াকু গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধের জন্য যে সরঞ্জাম, রসদ, মনোবল প্রয়োজন তা আফগান সেনাবাহিনীর নেই।

সেই সাথে রয়েছে, তিনি বলেন, জাতিগত বিভেদের সমস্যা। সিংহভাগ সিপাহী পশতুন জাতিগোষ্ঠীর, কিন্তু সিনিয়র অফিসারদের সিংহভাগ জাতিগত তাজিক। “এ নিয়ে একটা রেষারেষি, মনোমালিন্য সবসময় রয়েছে।”

“আর সবচেয়ে বড় কথা, আফগানিস্তানের শাসক এলিটদের মধ্যে যে অব্যাহত বিভেদ সেটি বিশ্বের যেকোনো জাতীয় সেনাবাহিনীর মনোবলের জন্য নেতিবাচক।”

তালেবানকে ঠেকাতে হেরাতে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেয় কয়েক শ উপজাতীয় মিলিশিয়া। মরিয়া হয়ে কাবুল সরকার এখন উপজাতীয় মিলিশিয়াদের সাহায্য চাইছে
তালেবানকে ঠেকাতে হেরাতে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেয় কয়েক শ উপজাতীয় মিলিশিয়া। মরিয়া হয়ে কাবুল সরকার এখন উপজাতীয় মিলিশিয়াদের সাহায্য চাইছে

পাশাপাশি রয়েছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। এটা প্রায় ওপেন সিক্রেট যে কাগজে কলমে সেনাবাহিনীর যে সংখ্যা দেখানো হয়, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কম। তালিকায় ভুতুড়ে সৈনিকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র কমান্ডারদের পকেটে যায় – এমন অভিযোগ প্রচুর। এমন খবরও দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় বেরিয়েছে যে অনেক জখম সেনা সদস্য হাসপাতালে চিকিৎসা বা এমনকি খাবারের অভাবে মারা গেছে। অনেক সময় লড়াইতে নিহত এবং জখম সহযোদ্ধাদের হাসপাতালে নেওয়ার যানবাহন পর্যন্ত সৈন্যরা পায় না। এসব নিয়ে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

পাশাপাশি, এটাও সত্যি যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে মাত্রায় প্রাণহানির শিকার আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ হয়েছে তা যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মনোবলের জন্য খারাপ। ২০০১ সালে থেকে তালেবানের সাথে লড়াইতে যেখানে ৭ হাজার নেটো সৈন্য মারা গেছে, সেখানে ২০০৭ সাল থেকে আফগান পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ৭৩ হাজার। মৃত্যুর এই ভীতি আত্মসমর্পণের প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিমান বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন

দূরবর্তী বিভিন্ন ঘাঁটিতে নিয়মিত রসদ সরবরাহের জন্য এবং মোতায়েন সৈনিকদের মনোবল ধরে রাখার জন্য দক্ষ একটি বিমান বাহিনী আফগানিস্তানের জন্য এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কুন্দুজ শহর রক্ষার শেষ চেষ্টায় একজন আফগান স্নাইপার
কুন্দুজ শহর রক্ষার শেষ চেষ্টায় একজন আফগান স্নাইপার

সে কারণে তালেবান এখন বিমান এবং হেলিকপ্টার টার্গেট করছে। কজন বিমান ও হেলিকপ্টার চালককে তারা হত্যাও করেছে।

তাছাড়া, এসব হেলিকপ্টার এবং যুদ্ধবিমান সচল রাখার জন্য যেসব বিদেশি টেকনিশিয়ান আফগানিস্তানে কাজ করে তারা আর থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ফলে, আফগান বিমান বাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক হয়ে পড়েছে যে উপায়ান্তর না দেখে কাবুলের সরকার এখন তালেবান বিরোধী বিভিন্ন উপজাতীয় মিলিশিয়াদের সাহায্য চাইছে। অথচ গত বছর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এসব মিলিশিয়া গোষ্ঠীদের নিরস্ত্র করার কথা ভাবছিলেন।

সম্প্রতি মার্কিন রেডিও এনপিআরের সাথে সাক্ষাৎকারে একজন মার্কিন জেনারেল, যিনি আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে কয়েকবছর আফগানিস্তানে ছিলেন, বলেন, “যেটা দুঃখজনক তা হলো কেক পুরোপুরি বেক হওয়ার আগেই ওভেন থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।”

মার্কিন ঐ জেনারেল হয়তো বলতে চেয়েছেন যে আফগান সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি একটি পেশাদার বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার আগেই তাদের ওপর লড়াইয়ের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমেরিকানরা ফিরে আসছে।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা