মতামত

সিআরবি’তে হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে পিছু হটতেই হবে

– রবীন গুহ

মানুষের বুকের ভিতর যেখানটায় হৃদপিন্ড থাকে তার পাশেই থাকে ফুসফুস, যা আমাদের শ্বাস নিতে সাহায্য করে। এই ফুসফুসের কাজ শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস নয়। নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভিতরে গ্রহন করা বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রক্তে মিশিয়ে দেয়া এবং রক্ত থেকে দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছেঁকে এনে তা বাইরে বের করে দেয়া হচ্ছে ফুসফুসের প্রধান কাজ। চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব রেলের সদর দপ্তর  বা সিআরবি নামে খ্যাত এলাকাটিকে চট্টগ্রামের ফুসফুস নামে খ্যাত। সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালা প্রাকৃতিক নৈসর্গ্যের  নীলাভূমি এই জায়গাটিতে  প্রায় তিনশত বড় বড় গাছ যার বেশ কযেকটি শতবর্ষী গাছ। সাত রাস্তার মোড় থেকে কদমতলী ও টাইগার পাসমুখী সড়কের দুপাশে বিশালাকার শতবর্ষী রেইন ট্রি আর শিরীষের সারি। বৃক্ষ, গুল্ম ও লতায় ঘেরা সিআরবিতে দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যের আলোতে নানা রকমের নকশা আঁকা দেখা যায়। অনেক পরিচিত বৃক্ষের সাথে আছে নানা রকম স্বল্প পরিচিত আর বিলুপ্ত প্রায় গাছও। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিআরবি এলাকায় ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ১৫৪টি ঔষধি। বিপন্ন প্রায় ৯টি প্রজাতির গাছও আছে সেখানে। সিআরবি এলাকায় যে শতবর্ষী রেইনট্রিগুলো আছে, সেগুলোতে বহু ধরনের পরগাছা, যেমন- ছত্রাক, শৈবাল, অর্কিড ও পরজীবীর বসবাস। এসব গাছপালাকে কেন্দ্র করে সিআরবিতে অনেক ছোট ছোট প্রাণি, যেমন- ব্যঙ, সাপ, নানা রকম পাখির বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়। এসব  গাছ কাটা হলে এসব আশ্রয়ী প্রজাতিও ধ্বংস হয়ে যাবে। নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে  এখানকার পুরো একটা ইকো সিস্টেম।

আর এখানেই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ সমাপ্ত করেছে। সিআরবিতে অবস্হিত রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির যে জমিটুকু অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেটার সঠিক নাম শহীদ আবদুর রব কলোনি। সেখানে শহীদের স্মৃতি হিসেবে কয়েকটি কবরও আছে। যদিও সরকারীভাবে কৌশলে নামটি এড়িয়ে গোয়ালপাড়া বলছেন। তারা আরো বলছে, এখানে হাসপাতাল হলে গাছ কাটা পড়বে না।

শুধু গাছই  নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য এই  সিআরবিতে ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের নেতৃত্বে  এখান থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়  চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতিরোধ করা। ব্রিটিশ বিরোধী যুব বিদ্রোহেরও স্মৃতি বিজড়িত এই স্হান। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর হিসেবে এখানে স্হাপিত ভবনটি ব্রিটিশ স্হাপনার এক অপূর্ব নিদর্শন। তাই, এক্ষেত্রে প্রযোজ্য সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারা যেখানে  বলা আছে, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান রক্ষা করতে হবে।

কথিত আছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে নীলাভূমি চট্টগ্রাম শহর। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সৌন্দর্য্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের নগর জীবনের জন্য দালান-কোঠা ছাড়াও যে বাচ্চাদের খেলার  জন্য মাঠ লাগে, একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য, বা বয়স্ক ও অসুস্হ মানুষের মর্নিং, বা ইভিনিং ওয়াকের জন্য একটু জায়গা বা পার্ক দরকার সেগুলো এই নগরীতে খুব একটা নেই বললেই চলে! নেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্যও  তেমন বেশি সুযোগ। এর আগে জাম্বুরী মাঠ, সার্কেট হাউস মাঠ নান পার্কের নামে মানুষের যাতায়াত সীমিত করা হলো। বিপ্লব উদ্যানে প্রকল্পের নামে নস্ট করা হলো! আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিং পুল আর মার্কেটের নামে খেলার জায়গা সংকুচিত করা হলো। ডিসি হিলে ডিসি সাহেবের বাসা। সেখানে করা নজরুল মঞ্চ বছরের তিনটার বেশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করতে দেয়া হয়না। এখন তো করোনার অজুহাতে ডিসি হিলে কাউকে ঢুকতেই দেয়া হয়না! শহীদ মিনারেও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ। তাও আবার সেটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পায়তারা চলছে। তবে, একমাত্র সিআরবি একটা জায়গা যেখানে উন্মুক্ত একটা মঞ্চ আছে যেখানে পহেলা বৈশাখের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানসহ বছরজুড়েই নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চলতে থাকে।  বাচ্চারা চাইলে একটু খেলতে পারে, বয়স্করা একটু হাটাহাটি করতে পারে, কেউ চাইলে দুদন্ড জিরিয়ে নিতে পারে। এ জায়গায় হাসপাতাল হলে একদিকে যেমন  বিতাড়িত হবে প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ, কাটা পড়বে গাছগাছালি আর অন্যদিকে তৈরি হবে মেডিকেল বর্জ্য, গড়ে উঠবে দোকানপাট। এছাড়া বাণিজ্যিক আগ্রাসনের মধ্য গোটা এলাকার চেহারাও পাল্টে যেতে পারে।

দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলো হয় অনেক ক্ষেত্রেই সরকারী জায়গায়। বিলাসবহুল সেইসব হাসপাতালে সাধারণত: চিকিৎসার সুযোগ পায় বড়জোড় দেশের শতকরা দশ থেকে বিশ ভাগ লোক। আমাদের দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্হাকে কাজে লাগিয়ে এমনিতেই ধনীরা দেশের তাবৎ সম্পদের বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছে; যার ফলে দিনদিন বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের জীবনমানের বড় মাপের ব্যবধান। এমন অবস্হায় সরকারী সংস্হাগুলো কিসের ভিত্তিতে বা, কাদের স্বার্থে দেশের শতভাগ মানুষের সম্পদ শতকরা দশ থেকে বিশ ভাগ মানুষের সুবিধার জন্য সহজ শর্তে বিলিয়ে দিচ্ছে?  সিআরবি মত জায়গা  বাদ দিয়ে অন্যত্র সরকারী জায়গায় হাসপাতাল করতে হলে সরকারী হাসপাতালই হতে পারে যেখানে দেশের শতভাগ মানুষ সেবা নিতে পারবে। রেলওয়ের সম্পত্তি মানেই জনগণের সম্পত্তি। এই সম্পত্তি যদি কোন বিশেষ কারণে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি ভিত্তিক লিজ দেয়া হলে সেক্ষেত্রে চুক্তির শর্তগুলি হতে হবে স্বচ্ছ ও নাগরিকদের তা বিস্তারিত জানার অধিকারও রয়েছে। জমি অধিগ্রহনের ব্যাপারে ইউনাইটেড গ্রুপের সাথে রেলওয়ের যেসব শর্তাবলীর ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, সেগুলো অস্বচ্ছ ও অনেকটা  লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেই চুক্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রশাসন বলছে, এই লিজ কেবল ৫০ বছরের জন্য। এর পর সরকারের কাছে মালিকানা হস্তান্তর করা হবে। চুক্তির এরকমের নানা জানা-অজানা শর্তগুলি সরকার বা জনগণের জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেই ব্যাপারগুলোও খোলাসা হওয়া প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম ও দেশের বিশিষ্টজনেরাও বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়ে বা সশরীরে নানা সংগঠনের ব্যানারে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে উপস্হিত হয়ে তাদের আশংকা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিগত ক’দিনে মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও উদ্বেগের যে  বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তাতে এটা পরিস্কার যে, বিষয়টা কেউই মেনে নিতে পারছে না। এ আন্দোলনে শুধু চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ নয়, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও সামিল হয়েছেন। সবাই বলেছেন, সিআরবি রক্ষা করতে হবে চট্টগ্রামের স্বার্থে। সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন সংগঠন।

চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্হা আধুনিকায়নের স্বার্থে আরো অনেকগুলো সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বড়মাপের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন আছে। তবে সেক্ষেত্রে স্হান নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর কোন হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় সেটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। তাই, হাসপাতাল হোক-অন্যত্র। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে সিআরবি বা তার আশেপাশের কোন এলাকায় হাসপাতাল স্হাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে পিছু হটতেই হবে।