শিল্প সাহিত্য

আমাদের দাদামণি

– নাজিমুদ্দীন শ্যামল

কবি অরূন দাশগুপ্ত

অরুণ দাশগুপ্ত একাধারে কবি, সাংবাদিক, সঙ্গীতজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ সংস্কারক একজন মণীষী। তাঁর ঋষিতুল্য  জীবনাচার বিগত দশক গুলোতে আমার মতোন অনেককেই শুধু আকর্ষণ করেনি, বরং এক ধরণের ঘোর তৈরি করেছে। তাঁর সততা, বিগত শতাব্দীর শেষের দশক গুলোতে আমাকে ও আমাদেরকে ভীষণভাবে প্রণোদিত ও প্রভাবিত করেছে। আমি ও আমরা অনেকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথামৃত শ্রবণ করতাম। তাঁর কবিতা, গদ্য  আর  বক্তৃতা মালা আমাকে ও আমাদেরকে সততা, সাম্য, মানবতা, শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে বিগতপাঁচ দশক ধরে। আমি ও আমরা সবাই  অকৃতদার এই ঋষিপুরুষ ব্যক্তিত্বকে দাদামণি বলে ডাকি। চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশে  এবং কলকাতায় তিনি এই ভালোবাসার নামে অর্থাৎ‘দাদামণি’ নামে সুখ্যাত।

দাদামণির সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিগত শতাব্দীর আশির  দশক থেকে। এটা আমার লেখালেখি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার কারণে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই চর্চা ও চর্যার মাঝেও এত বছরে কখন যে তিনি আমার পিতৃতূল্য একজন হয়ে উঠেছেন তা  টেরও পাইনি। গত শতকের আশির দশক থেকে অদ্যাবধি তাঁর স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েআছি। তিনিতো আমার ও আমাদের কাছে ঋষিতুল্য সাধক পুরুষ। তিনি কবিদের কবি, লেখকদের লেখক, চিন্তকদের চিন্তাবিদ আর নির্লোভ এক রেঁনেসা মানব। শহর চট্টগ্রামের বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে তাঁর ‘কল্যাণী’ বাড়িতে দেশের সব কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। কবি শামসুর রাহমান, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুলহুদা, আবুবক্কর সিদ্দিকী, মুনিরুজ্জামান থেকে শুরু করে আমার মতো নবীন পর্যন্ত, সাংবাদিক কেজি মুস্তাফা থেকে শুরু করে আজকের তরুণ পর্যন্ত, শিল্পী মূর্তজা বশীর, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ থেকে শুরু করে চারুকলা কলেজের নবীন শিক্ষার্থী পর্যন্ত, প্রফেসর  ড. অনুপম সেন, আবুল মোমেন, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, ড. রশীদ আলফারুকী থেকে শুরু করে মুক্ত বুদ্ধি চর্চার নবীন পর্যন্ত সবাই তাঁর ঘরে যেতেন। শুধু তাই নয়, দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদের অনেককেও আমি তাঁর গৃহে দেখেছি। আমার মনে পড়ছে বিখ্যাত অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের পিতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত চট্টগ্রাম এলে তাঁকে নিয়েও আমি ও চলচ্চিত্র কর্মী শৈবাল চৌধুরী তাঁর বাসায় গিয়েছি। সেখানে প্রতি বুধবার  ড. অনুপম সেন সহ দেশসেরা লেখক, কবি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের সমাগম হতো। যাঁরা সেই সমাগমে কখনো না কখনো হাজির হয়েছেন তাঁর সবাই জানেন, এটি ছিল জ্ঞান, মুক্তবুদ্ধি ও শিল্পসাধনার এক অনন্য সমাগম। আমার তরুণবেলার উজ্জ্বল স্মৃতিগুলোর মধ্যে দাদামণির সান্নিধ্যের স্মৃতি অত্যন্ত প্রভোজ্জ্বল হয়েআছে।

আমাদের দাদামণি কবিতা লিখেছেন। তাঁর অসাধারণ সব কবিতা বাংলা ভাষায় শুধু নতুন  আঙ্গিক ও ধারাই তৈরি করেনি, বরং অপ্রচল এক শৈল্পিক ধারাকে বহমান করেছে। রবীন্দ্র আর নজরুল  বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য অনন্য- অসাধারণ। চট্টগ্রামে নজরুল বিষয়ে তাঁর গবেষণা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশ হয়েছে। তাঁর সঙ্গীত বিষয়ক রচনা গুলো আর নানা বিষয়ে সহস্রাধিক প্রবন্ধ গত অর্ধশত লিটল ম্যাগাজিন, জার্নাল ও পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। অকৃতদার এই ঋষি ব্যক্তিত্ব তাঁর আরেক বন্ধু সুচরিত চৌধুরীর মতো প্রচারে নয়, প্রকাশেই নিজের জ্ঞান সাধনার সার্থকতা মনে করতেন। তাঁর কবিতা গুলো সংগ্রহ করে বই প্রকাশ করা গেলে বেশ কয়েকটি বই যেমন হবে, তেমনি নানা বিষয়ে প্রকাশিত সব লেখাকে গ্রন্থাকার দিতে পারলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত হবে।

দাদামণি যতটা না লিখেছেন তার থেকে অনেক বেশি সময় দিয়েছেন লেখক তৈরি করার জন্য। তিনি দেশের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করছেন। তাঁর হাত ধরে দেশের অনেক খ্যাতিমান লেখক তৈরি হয়েছে। অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা যেমন তিনি প্রকাশ করেছেন, তেমনি নবীন লেখক-কবিদের লেখাও যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করেছেন। তাঁর হাত ধরে চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চার এক স্বকীয় ধারা খুব সহজাত ভাবেই তৈরি হয়েছে, যা বিগতপাঁচ দশক ধরে সক্রিয় রয়েছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব কাছ থেকে দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কজন স্বনামধন্য শিক্ষকের পিএইচডি অভিসন্দর্ভও তিনি পূনলেখনও সম্পাদনা করেছেন। একই সঙ্গে নানা পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে এসব গবেষণা কর্মকে ঋদ্ধ করেছেন।

তরুণ বয়সে বামধারার রাজনীতি ও ভাবাদর্শ দাদামণিকে অসাধারণ সাহস ও ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছে। তারুণ্যের সময় অর্থাৎ বিগত শতকের ষাট বা সত্তুরের দশকে তিনি গ্রামীণ জনপদে শিক্ষা বিস্তারের আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি দৈনিক আজাদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষকতা বা সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনে এবং ব্যক্তি জীবনে চর্চিত সততা আগামী প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। তাঁর মতো সৎ, পণ্ডিত  ও নির্লোভ ঋষি এ যুগে পাওয়া সত্যিই বিরল।

জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেও ধন সম্পদ কখনো দাদামণিকে টানেনি, বরং সাম্যবাদী প্রগতিশীল দর্শন তাঁকে ত্যাগ ও ঋষিত্বের এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা প্রতিষ্ঠায় বিগত দশকগুলোতে প্রতিটি প্রগতিশীল  আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে সবাইকে সাহস যুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রতিটি সংগ্রামে তিনি অবদান রেখেছেন।

অজস্র প্রবন্ধ, কবিতা লেখার পরও দাদামণির বইয়ের সংখ্যা মাত্র তিন-চারটি। অনেক কবি, লেখক, শিক্ষকের গুরু হওয়া সত্ত্বেও তিনি জাগতিক তোষামোদির উর্ধ্বে থেকেছেন, কোনো বিনিময় কখনো চাননি। সারা জীবন শিক্ষকতা-সাংবাদিকতা করেও অর্থবিত্ত বা প্রতিষ্ঠার জন্য কখনো লালায়িত হননি। তাঁর অজস্র কাজ ও সৃষ্টি থাকলেও সেভাবে স্বীকৃতি মেলেনি। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে তিনি নেতৃত্ব দিলেও তাঁর কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা রাষ্ট্র তাঁকে কখনো দেয়নি। তিনি অবশ্য এসব পুরস্কার বা স্বীকৃতির জন্য কখনোই ধর্ণা যেমন দেননি, তেমনি কোনো ধরনের লোভ তাঁকে ছুঁয়েছে, এমনটিও কখনো শুনিনি।

আমাদের দাদামণি কবিতা, গদ্য, শিল্প, সাহিত্য ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অনন্য বাতিঘর। এই বাতিঘর থেকে চেরাগ জ্বেলে তিনি চট্টগ্রাম থেকেই এদেশের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও জনপদকে আলোকিত করেছেন ।  তিনি এক স্বপ্নবাজ প্রগতির পাখি। তিনি প্রতিদিন মুক্ত আকাশ হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে, আর প্রতিদিন ছাড়িয়ে যান আকাশের সীমানা। তিনিআমাদের দাদামণি। তিনি আমাদের বাতিঘর, স্বপ্ন দেখার প্রেরণা।

নাজিমুদ্দীনশ্যামলঃ কবি ও সাংবাদিক