শিল্প সাহিত্য

মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ: ৭ম পর্ব

-শোয়েব নাঈম

আচ্ছাদিত স্ববিরোধীতার স্বয়ম্ভু ছিলেন কবি-লেখক মীর আবদুস শুকুর ওরফে আল মাহমুদ । এদেশের সকল মৌলিক বিষয়ে তার অবস্থান ছিল অভিসন্ধি খাঁজকাটা কুমিরের গল্পের মতো, কেবল আশার ছদ্মবেশ দেখিয়েছিলেন। তার লেখার সাথে ধর্মতত্ত্ব সংহত করতে গিয়ে আত্মবিরোধীতায় সাহিত্যকে কালিমালিপ্ত করেছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের আলোচনা প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন-
“…একজন অতিশয় চতুর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরই সুচতুর রচনা। যিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলনপ্রয়াসের ছদ্মবেশের নিচে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র জালটি সুকৌশলে বিছিয়ে রেখেছেন… “
এই হচ্ছে আল মাহমুদের মননশীলতার সীমা-পরিসীমা। তিনি সাহিত্যচর্চার মুখোশে ভারত ‘আধিপত্যবাদের’ বিরোধীতার নামে বিদ্বেষপ্রসূত তীব্র ঈর্ষান্বিত হয়ে বাংলাদেশের  সাহিত্য-নিকুঞ্জে আত্মহননের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ঔপনিবেশ প্রতিস্থাপনের চক্রান্ত করেছিলেন।
“দিশেহারা কবির দল” প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন,
“…এখন, এ সময় কবিতা রচনা হলো একদল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গ্রাম্য বালকের এ শহরের চৌহদ্দিতে নাগরিক বখাটেপনার সর্বশেষ উপায় মাত্র…”
এমন আলোচানা পাঠে আল মাহমুদ সম্বন্ধে  গভীর উপলব্ধির অভিজ্ঞান কখনো আসে না। সর্বদাই তাকে মনে হয় উদ্দেশ্যপ্রবণ, ইজমাক্রান্ত স্ববিরোধী এবং অন্যের দৃষ্টির উপর ভরকরা এক মতলববাজ, যে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে লাঞ্ছিত হওয়া ভয়ের সংকীর্ণতায় কিছু গোষ্ঠীর দ্বারা সবসময় নিরাপত্তাবেষ্টিত হয়ে থাকতেন।
ক্ষুদিরামকে উপমহাদেশের সার্বজনীন চরিত্র ঘোষণা দিয়ে একদা তিনি ‘সোনার ছেলে’ বিশেষায়িত করে আবার তার স্বভাবগত স্ববিরোধীতায় সেই ইশতেহার বদলে নিয়েছিলেন ।
“…আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেছে শেষে / হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাঙলাদেশে…” – একটি মেকী পদ্যের জন্ম দিয়েছিলেন আল মাহমুদ, একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের তিনি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান যুদ্ধাপরাধী গোলাম-সাইদী গোষ্ঠীদের সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে। এই সীমাহীন স্ববিরোধীতার ফলশ্রুতিতে এই পদ্যটি পাঠপ্রতিক্রিয়ায় তার প্রতি ঘৃণাই ঘনীভূত হয়।
“… ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
    ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
    মতিয়ুরকে ডাক…”
ঊনসত্তরে স্বৈরাচারী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের তৎকালীন সময়ে আল মাহমুদের লেখিত এই ছড়াটি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বুমেরাং হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের গদিরক্ষক আল মাহমুদের বুকেই প্রত্যাঘাত করেছিল , ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না তার শত্রুদের, বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র আবাসভূমির সাহিত্যের ঠিকানায় আজ আল মাহমুদ একজন অসৎকৃত এবং ব্যাপক অর্থে মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবেই চিহ্নিত।
একটি বিন্দুতে ১৯৩৬ (জন্মসাল), আরেকটু বিন্দুতে ১৯৫৮-১৯৭০ এবং অপর আরেকটি বিন্দুতে ১৯৭১-আমৃত্যু লেখে এবার যদি একটি ত্রিভুজ অঙ্কন করা হয় তবে সবচেয়ে বিস্তৃত কোণটি হচ্ছে আল মাহমুদের ৪৮ বছরের সাহিত্যকাল, যা’ বছর হিসাবে যতটুকু দীর্ঘ, সৃষ্টির দ্যুতি নির্ধারণে ততোধিক নিস্পৃহ এবং অসফল। এই সময়কালকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বহুমাত্রিকতাতে অথবা যেভাবেই আল মাহমুদকে দেখি না কেনো ,তাকে শামসুর রাহমানের সমান্তরালে দেখলে ব্যাপ্তিতে ঔজ্জ্বল্যে আর প্রভাবে তেমন উদ্ভাসিত আর দেখা যায় না । স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী এক অসমন্বিত দ্বন্দ্বের কাঠগড়ায় আল মাহমুদকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে শেষ ৪৮ বছরের অন্তঃসারশূণ্য ফসলের দায়ে। সাহিত্যের ইতিহাসে স্বীয় ভাষাসাহিত্যের প্রকৃত সৃষ্টিশীল সেবককেই টিকিয়ে রাখতে পারে অনাগতকাল। বাঙালি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন যেভাবে নানা উত্থান-পতন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক লক্ষ্যে পৌছেছিল, সেই ধারাতে না গিয়ে তিনি আত্মপরিচয়কে স্বনির্ধারণে তার চেতনাকালকে অন্যভাবে ত্রিখণ্ডিত করছেন ব্রিটিশ-ভারতীয় (১৯৩৬-১৯৪৭), পাকিস্তানী (১৯৪৭-১৯৭১),  মুসলিম-বাংলাদেশী (১৯৭১-আমৃত্যু)।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার যে সকল লেখাগুলি বই আকারে ছেপেছিল সেগুলি হচ্ছে:
মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো , কাবিলের বোন (উপন্যাস), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া , অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না , দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, যেভাবে বেড়ে উঠি, কবির আত্নবিশ্বাস, পানকৌড়ির রক্ত (গল্পগ্রন্থ), সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না,নদীর ভেতরের নদী, পাখির কাছে ফুলের কাছে,প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে, ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় , ত্রিশেরা, মরু মূষিকের উপত্যকা, প্রিয় পঞ্চমী, প্রেমপত্র পল্লবে, কবির কররেখা, বিবি মরিয়মের উইল, ছায়ার সঙ্গে মায়ার লড়াই, নদীর সতীন, তোমার রক্তে তোমার গন্ধে, জলবেশ্যা ও তাহারা, মহানবী হযরত মুহাম্মদ : সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যমুনাবতী, তুষের আগুন, নিশিন্দা নারী, যে যুদ্ধে কেউ জেতেনি, কবিশিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস, নগরীর কথা নয় চাষবাসের গল্প,কলংকিনী জ্যোতির্বলয়, আলোক পুলক শিহরণ, পোড়ামাটির জোরা হাঁস, ওরা তিন নারী, যমুনাবতী দিনযাপন, ময়নামতির নেকলেস, সাহসের সমাচার, দশ দিগন্তে উড়াল, আগন্তুক,ধীরে খাও অজগরী, মোহিনীর জীবনাঝঙ্কার, চরণ ধ্বণি, এ কি অশ্রু এ কি রক্ত, আমি সীমাহীন যেন-বা প্রচীন বটবৃক্ষের মতো, তুহিন তামান্না,   জীবন যখন বাঁক ঘোরে , না কোন শূন্যতা মানি না……. ইত্যাদি ।
এই সময়কাল পর্যন্ত আল মাহমুদ কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ মিলিয়ে শতাধিক বই প্রকাশ করেছিলেন। সংখ্যায় বহুত্ব কিন্তু গুণে-মানে আর সৃষ্টিশীলতার বিচারে এসকল বইগুলি তার লেখনীশক্তিকে ধারাবাহিকভাবে করেছিল হ্রস্ব থেকে হ্রস্বতর।
১৯৫৮-১৯৭০ এই তের বছর ‘লোক-লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’- সৃজনক্ষম এই ত্রয়ী কেতাবের বদৌলতে আল মাহমুদের কবি-সত্তাকে দুই বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে যেভাবে, যে মাত্রায় স্বাগত জানিয়েছিল, নিজের মধ্যসত্ত্বভোগী এমন কর্মদোষে সেই আল মাহমুদ আর বিকশিত হয়নি মৃত্যু অবধি মননশীলতার আর উদ্ভাবনী শক্তির বিচারে।
( চলবে….)
শোয়েব নাঈমঃ কবি ও প্রান্ধিক