শিল্প সাহিত্য

ভোভো ও শোশো

-মিলন কিবরিয়া

হাওয়ায় ভাসছে ভোভো, বাতাসে উড়ছে ভোভো। খুব চেষ্টা করছে ভেসে থাকতে। হাওয়ায় ভেসে ভেসে উপরে, অনেক উপরে উঠে যেতে। উপরে কি সুন্দর নীল আকাশ! উড়তে উড়তে ওই আকাশের সাথে মিশে যেতে ভোভোর খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বার বার ডানদিকে কান্নি খাচ্ছে। সোজা হয়ে উপরে উড়ে যেতে পারছে না। সুতার টানেও সোজা হয়ে থাকতে পারছে না। সাঁই সাঁই করে নিচে নামতে নামতে ধপাস করে পড়লো সবুজ ঘাসের উপরে। যাহ, মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

লাটাইটা হাত থেকে মাঠের উপর রেখে ইমন এক দৌঁড়ে ছুটে এলো ভোভোর কাছে। কোলে তুলে নিল ভোভোকে। দুই দিন ধরে কষ্ট করে সে ভোভোকে বানিয়েছে। লাল রঙের পাতলা কাগজ দিয়ে ভোভোর শরীর তৈরি। আর আছে সরু লম্বা হলুদ লেজ। নাহ, ভোভো এই নিয়ে দুইবার ডান দিকে কান্নি খেতে খেতে পড়ে গেল। দুই দিকে সমান ভার হয়নি। দুই দিকের ভার সমান করতে হবে, না হলে ভোভো উড়তে পারবে না। ভোভোকে নিয়ে মাঠের উপর বসে পড়লো ইমন। পকেট থেকে আঠা আর টুকরা কাগজ বের করে ভোভোর বাম দিকে সেঁটে দিল। দুই একবার ফু দিয়ে বাতাসে একটু ভোভোকে দুলিয়ে আঠা শুকিয়ে নিল। তারপর সুতায় কয়েকটা টান দিয়ে ভোভোকে আকাশের দিকে ভাসিয়ে দিল। এক দৌড়ে এসে লাটাই তুলে নিল হাতে।

এবার আর কান্নি খেলো না ভোভো। দুই দিকেই সমান ভর। লাটাইয়ের সুতায় একটু ঢিল ঢিল হয়ে টান পড়ছে, আর ভোভো সাইঁ সাঁই করে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। বাতাসে পাক খেয়ে ভোভোর হলুদ লেজটা দুলছে এদিক ওদিক। ভোভোর মনটা আনন্দে ভরে গেল। অনেক অনেক উপরে নীল আকাশ। আজ আকাশের সাথে তার গল্প হবে, কথা হবে।

নিচের দিকে তাকালো ভোভো। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে সব। যে মাঠ থেকে সে উড়াল দিয়েছে সেই মাঠ, মাঠে লাটাই হাতে ছুটতে থাকা ইমন। মাঠের দুই প্রান্তের গোল পোস্ট, ছেলেদের পায়ে পায়ে নাচতে থাকা ফুটবল, ছক্কা হাঁকাতে যাওয়া ক্রিকেট ব্যাট, বোলারের হাত থেকে ছুটে যাওয়া টেনিস বল আর সেই সাথে মাঠে খেলতে থাকা সবাই ছোট হয়ে আসছে। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা গাছ, তারাও ছোট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আশে পাশের রাস্তা দড়ির মতো সরু হয়ে যাচ্ছে; রিক্সা গাড়ি সব কেমন যেন খেলনার মতো লাগছে। যতই উপরে যাচ্ছে, আকাশের দিকে যাচ্ছে ততই নিচের দালান, ঘর, দোকান সবই ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে আসছে।

একটু দূরে চোখ গেল ভোভোর। আহা, কী সুন্দর দৃশ্য! ঘন সবুজ হয়ে আছে জায়গাটা। গাছের পরে গাছ জড়াজড়ি করে আছে। পার্ক, বাগান নাকি বন! চোখ জুড়িয়ে গেল, মন ভরে গেল ভোভোর। আরো উপরে আকাশের দিকে উঠে গেল ভোভো। এখন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট একটা নদী। এঁকে বেঁকে চলে গেছে দূর, বহু দূর। নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকা, ট্রলার; সব ছোট থেকে ছোট, আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে।

ভোভো আকাশের দিকে তাকালো। উপরে নীল আকাশ বিকালের নরম রোদে ঝকমক করছে। বাতাসে দুলছে ভোভোর শরীর আর নেচে বেড়াচ্ছে তার হলুদ লেজ। একটা দুইটা পাখি উড়ে যাচ্ছে ভোভোর পাশ দিয়ে, দূর দিয়ে। নিজেদের ঘরে ফিরছে ওরা। এক ঝাঁক ছোট পাখি আকাশে ঢেউ তুলে উড়তে উড়তে একেবারে ভোভোর পাশে চলে এল। সবাই মিলে সারাক্ষণ কিচির মিচির করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ভোভো চিৎকার করে জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

কোন উত্তর দিল না পাখিরা। আবার ঢেউ তুলে আপন মনে উড়ে দূরের দিকে চললো, মনে হলো ভোভোর কথা শুনতেই পায়নি। আরো জোরে চিৎকার করে ভোভো জিজ্ঞাসা করলো, শুনতে পাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

এবারও ভোভোর কথার কোন জবাব না দিয়ে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে গেল ওরা। একটু মন খারাপ হলো ভোভোর। ইচ্ছা করলেও সে পাখিদের মতো উড়ে উড়ে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারবে না। সে যে সুতায় বাঁধা!

এমন সময় ভোভো শুনতে পেল একটা মিষ্টি নরম গলা। কে যেন বলছে, এ্যাই তোমার নাম কি?

চমকে উঠে ভোভো আশে পাশে তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না।

ভোভো আবার শুনতে পেল সেই একই গলা, এবার আরেকটু জোরে। কে যেন চেঁচিয়ে বলছে, এ্যাই তুমি কে? তোমার নাম কি?

নিচের দিকে তাকাল ভোভো। দেখতে পেল একটা বড় সাদা ঘুড়ি উড়তে উড়তে উপরের দিকে উঠে  আসছে। তার বেগুনি রঙের লম্বা লেজ হাওয়ায় দুলছে এদিক ওদিক। ভাসতে ভাসতে চলে এল ভোভোর কাছে। দুই বার গোত্তা খেয়ে ভোভোকে তার কসরৎ দেখালো। টান টান সুতায় ঝাঁকি খেয়ে উঠে এলো ভোভোর পাশে।

ভোভো বললো, আমার নাম ভোভো। তোমার নাম কি?

আমার নাম শোশো। একটু দম নিয়ে সাদা ঘুড়ি তার নাম বললো।

বাহ, কি সুন্দর নাম তোমার। আর অনেক বড়ো তুমি। ভোভো বললো শোশোকে।

ভোভোর কথায় খুব খুশি হলো শোশো। নিজের দিকে তাকালো। ভোভোর চেয়ে বেশ বড়সড় সে আর লেজটাও অনেক লম্বা। বেগুনি রঙের লম্বা লেজটা বাতাসে ভেসে ভেসে যেন সারা আকাশ জুড়ে দুলছে আর দুলছে।

তুমিও খুব সুন্দর। লাল আর হলুদ রঙে তোমাকে খুব মানিয়েছে। ভোভোকে বললো শোশো।

ধন্যবাদ। খুশি হয়ে উত্তর দিল ভোভো।

তোমাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। শোশো বললো।

না, না, দেখবে কোত্থেকে? আজই প্রথম আমি আকাশে উড়লাম। তাও তিন বারের বার, প্রথম দুইবার তো কান্নি খেয়ে মাটিতেই পড়ে গেলাম।

আহা, মন খারাপ করো না। সান্ত্বনা দিল শোশো, সব ঘুড়িই কখনো না কখনো কান্নি খায়। কান্নি না খেয়ে কি উড়া যায়! কান্নি খায়, গোত্তা খায়; তবেই ঘুড়ি উড়ে বেড়ায়।

তুমিতো অনেক কিছু জানো! অবাক হয়ে বললো ভোভো।

জানবো না! একটু গর্ব হলো শোশোর। আমি তো এই আকাশে নতুন না। আজ নিয়ে আমি তিন দিন আকাশে উড়লাম।

আকাশে ভেসে থাকতে, উড়ে বেড়াতে অনেক মজা। কত কি দেখা যায়; মাঠ, নদী, বন, পাখি। তোমার কত মজা, ভোভো বললো।

ভোভোর কথায় সায় দিল শোশো, ঠিক বলেছ। আকাশে উড়তে অনেক মজা, অনেক আনন্দ। আরো আনন্দ হয়, যদি তুমি আকাশে কাট্টি খেলে জিততে পার।

তুমি জিতেছ? বোকার মত জিজ্ঞাসা করে বসলো ভোভো।

ভোভোর প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো শোশো। না হলে কি তুমি আমাকে দেখতে পেতে? না জিতলে তো আমি কাটা পড়ে ভেসে যেতাম ঐ আকাশে।

ভোভো অবাক হয়ে বললো, ওরে, বাপরে। তুমি তো সাংঘাতিক! তিন দিন ধরে কাট্টি খেলছো! আর জিতেই চলেছো।

ভোভোর প্রশংসা শুনে শোশো খুব খুশি। বেগুনি লেজ দুলিয়ে আকাশে তিনটা ডিগবাজি খেয়ে বললো, এই তিন দিনে আমি পাঁচ পাঁচটা ঘুড়ি কেটেছি।

পাঁচটা! বলো কি, পাঁচটা ঘুড়ি? ভোভোর যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।

দেখো, কি মজবুত আমার মাঞ্জা। বলে শোশো তার সুতার দিকে তাকাল। সাথে সাথে ভোভোও তাকাল। লাল রঙের মাঞ্জা দেয়া সুতায় আঁটকে আকাশে নেচে বেড়াচ্ছে শোশো। সাদা শরীর, লম্বা বেগুনি লেজ আর লাল রঙের মাঞ্জা দেয়া সুতায় শোশোকে রাজার মতো লাগছে।

আজও কি কাট্টি খেলবে? জানতে চাইল ভোভো। তারপর নিজের সুতার দিকে তাকাল। তার দেখাদেখি শোশোও তাকাল। সাদা রঙের মাঞ্জা দেয়া সুতায় আঁটকে আকাশে ভাসছে ভোভো।

গল্প করতে করতে খুব কাছাকাছি চলে এলো দুই বন্ধু, ভোভো আর শোশো। তারপর একে অন্যকে পার হয়ে দুই দিকে চলে গেল। দূরে, বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে উড়তে উড়তে আবার কাছাকাছি আসতে লাগলো।

কাট্টি খেলা শুরু? ভোভো জিজ্ঞাসা করলো।

হ্যা, কাট্টি খেলা শুরু। চেঁচিয়ে জবাব দিল শোশো।

আজও জিতবে তুমি? জানতে চাইল ভোভো।

যার মাঞ্জায় ধার বেশি সে জিতবে কাট্টি খেলায়, শোশো জানাল।

উড়তে উড়তে একেবারে কাছাকাছি চলে এলো দুই ঘুড়ি। পাল্টি খেয়ে ভোভোর সুতায় প্যাচ পরাতে চাইল শোশো, পারলো না। উড়তে উড়তে দুই বন্ধু দূর থেকে আরো দূরে সরে গেল। ধীরে ধীরে আবার দুই জনই দুই জনের দিকে এগিয়ে এলো।

শোশো দিল পাল্টি আর প্যাঁচ, ভোভোও দিল পাল্টি আর প্যাঁচ।

এবার আর ফসকালো না, ভোভোর সুতার সাথে শোশোর সুতার প্যাঁচ লেগে গেল।

একটু ঢিল, একটু টান; শুরু হলো কাট্টি খেলা।

মাঝ আকাশে একটা সাদা ঘুড়ি বেগুনি লেজ আর একটা লাল ঘুড়ি হলুদ লেজ সুতার প্যাচে আঁটকে কাট্টি খেলায় মেতে উঠলো।

একটু দূরে সরে যেতে যেতে ভোভো চেঁচিয়ে বললো, তুমি অনেক ভালো, শোশো। অনেক ভালো বন্ধু।

শোশোও দূরে যেতে যেতে চেঁচিয়ে উঠলো, তুমিও। ভোভো, তুমিও অনেক ভালো।

ভোভোর সুতায় টান পড়লো, শোশোর সুতায় ঢিল পড়লো। শোশোর সুতায় টান পড়লো আর ভোভোর সুতায় ঢিল পড়লো। দুই বন্ধু ভাসতে লাগলো, একটু দূরে দূরে উড়ে উড়ে। কোন কাটাকাটি হলো না।

এবার দুই জনের সুতায় ঢিল, আরো দূরে সরে গেল দুই বন্ধু। তারপর আবার টান। সে কি টান! মনে হলো কেটেই যাবে কারো সুতা। না, হলো না। এবারও কোন কাটাকাটি হলো না। নাচতে নাচতে একটু নেমে এসে আবার উড়তে উড়তে উপরে উঠে এলো দুই বন্ধু।

কাট্টি হলো না, বন্ধু। চিৎকার করে বললো ভোভো।

তাই তো দেখছি, উত্তর দিল শোশো।

এখন কি হবে?

কাট্টিই হবে, জোর গলায় বললো শোশো। সুতায় সুতায় এমন প্যাঁচ লেগেছে সে আর ছুটবে না।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আলো কমে আসছে। সূর্য ডুবু ডূবু করছে আর সুতায় প্যাঁচ লেগে দুই বন্ধু আকাশে নাচানাচি করছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া ভেসে এলো। সেই হাওয়ার তোড়ে সাঁই সাঁই করে উপরে উঠে যেতে লাগলো ভোভো আর শোশো। আর টান বাড়তে লাগলো সুতায়।

বাতাসের টান আর সুতার টান দুইয়ে মিলে কাট্টি হয়ে গেল শোশোর।

বিদায় বন্ধু। বলে শোশো তার বেগুনি লেজ নাড়তে নাড়তে উড়ে যেতে লাগলো উপরে, আরো উপরে আকাশের দিকে।

মন খারাপ হলো ভোভোর। চেঁচিয়ে বললো, বি-দা-য়। তোমাকে কখনো ভুলবো না।

বন্ধু ভোভোকে হারিয়ে ভীষণ মন খারাপ হলো শোশোর। উদাস মনে ভাসতে ভাসতে আকাশের দিকে উড়ে চললো। হঠাৎ পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো।

আর অবাক হয়ে দেখলো তার পাশে পাশে ভেসে ভেসে উঠে আসছে ভোভো।

তুমি? তুমি কেন? তুমি কি ভাবে? খুবই অবাক হলো শোশো। কাটা পড়েছি তো আমি।

দুই জনেরই কাট্টি হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে বললো ভোভো। এ হচ্ছে বন্ধুত্বের প্যাঁচ, দুই সুতাই কেটে গেছে কিন্তু প্যাঁচ খোলে নাই।

নিচের দিকে তাকালো দুই বন্ধু। ডুবু ডুবু সূর্যের লাল রঙে মোড়া পৃথিবী। শোশো বললো, পৃথিবী কী সুন্দর!

কী অপূর্ব! কী অপরূপ! ভোভো লেজ দুলিয়ে সায় দিল।

উপরের দিকে তাকাল দুই বন্ধু। মাথার উপরে নীল আকাশ, সাথে ডুবতে থাকা সূর্যের লাল রঙের ছোঁয়া। ভোভো বললো, কী সুন্দর আকাশ!

কী মিষ্টি! কি মায়াময়! শোশো জবাব দিল।

তারপর?

দুই বন্ধু, ভোভো আর শোশো সুতার প্যাঁচে জড়াজড়ি করে তাদের হলুদ আর বেগুনি লেজ নাচিয়ে ভাসতে থাকলো আকাশে। গল্প করতে করতে উড়ে চললো দূরে, বহু দূরে।

লেখকঃ চিকিৎসক ও গল্পকার

অলংকরণঃ আদিবা তাসনিম বানু, ৭ম শ্রেণি, সেন্ট মেরিস স্কুল, চট্টগ্রাম।