মতামত

চা শ্রমিকদের মুল্লুক চলো আন্দোলনের শতবর্ষ:বিদ্যমান অবস্থা

-তপন দত্ত

।।এক।।

আমেরিকার শিকাগো শহরে সংগঠিত মহান মে দিবসের ঘটনার ঠিক ৩৫ বছর পরে ১৯২১ এর মে মাসে ভারতবর্ষের চা শ্রমিকরা আরেকটি মে দিবসের জন্ম দিয়েছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনে এটি একটি মাইলফলক হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঐতিহাসিক দিনটি ক্রমান্বয়ে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া নিষ্পেষিত শোষিত মানুষগুলোর এই আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে পারেনি।

বৃটিশ ভারতে চা শিল্পের যাত্রা শুরু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ১৮৩৯ সালে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চা চাষ শুরু হয় ১৮৪০ সালে। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ শুরু হয় ১৮৫৪ সাল থেকে। সমগ্র ভারত বর্ষে অবশ্য চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৫১ সাল থেকে । ভারতবর্ষের তৎকালীন বেঙ্গল ও আসাম প্রেসিডেন্সির ডুয়ার্স, তেরাই, দার্জিলিং, চট্টগ্রাম ও আসামের সিলেটের বিস্তীর্ন বন জঙ্গল ঘেরা উঁচু নীচু পার্বত্য অঞ্চলে বৃটিশ পুঁজির মালিকানায় চা চাষ  শুরু হয় ব্যাপক ভিত্তিতে। শিল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাপদ সংকুল বন জঙ্গল পরিস্কার করে চা চাষ শুরু করার জন্য প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বৃটিশ প্লান্টার্সরা নানা হীন কৌশলে গ্রামের গরীব ভূমিহীন কৃষকদের চা বাগানের কাজে ধরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত অমানবিক ও নির্মম।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, কুঠির শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং পরিনামে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। এক বিরাট সংখ্যক গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষ সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও ভূমিহীন অবস্থায় পৌঁছে ছিল। বেকারত্ব চরম সীমায় পৌঁছে যায়। গ্রামীণ ভূমিহীন নিঃস্ব মানুষগুলোকে নানা মিথ্যা প্রলোভনে চা বাগানে চালান করে দেওয়ার জন্য উনবিংশ শতকের ৭ম ও ৮ম দশকে ভারতবর্ষে বহু কেন্দ্র সৃষ্টি হয় । এই সব গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলোকে মিথ্যা প্রলোভনে শ্রমিক সংগ্রহের ডিপো গুলোতে নিয়ে আসা হতো। শ্রমিক সংগ্রহের মূল কেন্দ্র ছিল পশ্চিম বাংলার বাকুরা, বীরভূম, চুচুড়া অঞ্চলের আদিবাসীএলাকা, বর্তমান ঝারখন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশের দারিদ্র কবলিত গ্রামীণ জনপদ এখানে থাকতো কোম্পানীর আড়কাঠি। তারা নানা মিথ্যা প্রলোভনে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে রেলে বা হাটিয়ে বাকী পথ জাহাজে করে বিভিন্ন বাগানে পাঠিয়ে দিত। কোথায় তাদের নেওয়া হচ্ছে, কিছুই তাঁরা জানতোনা। বৃটিশরা এবং স্থানীয় ভদ্র লোকেরা চা শ্রমিকদের বলতো কুলী। দীর্ঘ ভ্রমণে জাহাজে গাদাগাদি করে যাওয়া, অসুস্থতা, খাদ্যভাবে এই সব লোকের একাংশ মারা যেত। লাশ মাঝ নদীতে ফেলে দিত। বাগানে পৌছার পর জীবন ধারন আরো শোচনীয় হয়ে পড়তো। দৈনিক ১২/১৩ ঘন্টা কাজ করতে হতো।

এইসব মানুষগুলোর উপর নির্মম শোষণ নির্যাতনে ভারতীয় জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ডে বহু মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল এই ঘটনায়।

ফলে ১৯০১ সালে আসাম লেবার এন্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর নিয়ম হয় যে, কুলি সর্দারদের (যারা কুলি সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকতো) বাগানের কর্মচারী হতে হবে স্থানীয় দালালদেরও শ্রমিক সংগ্রহের জন্য লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু তাতেও শ্রমিক সংগ্রহের নির্মম পদ্ধতি রোধ করা যায়নি। পরবর্তীতে আরেকটি ঘৃণ্য আইন করেছিল বৃটিশ রাজ। “ওয়াচম্যান ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট” এবং “ইন্ডিয়ান পেনাল কোড” এই দুইটি আইনের ফলে শ্রমিকরা চুক্তি ভংগ করে বাগান ত্যাগ করলে বাগান মালিক তাকে গ্রেপ্তার করতে পারতো। প্রকৃতপক্ষে এই আইনগুলি ছিল দাস প্রথার নামান্তর। ১৯২৬ সালে এই আইনগুলির কিছু পরিবর্তন করে মালিকদের গ্রেপ্তার করা ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হলেও  চা শ্রমিকের উপর শারীরিক যৌন নির্যাতন, মজুরি কম দেওয়া, অতিরিক্ত কর্ম ঘন্টা ইত্যাদির কোন পরিবর্তন হয়নি।

১৮৪০ সালে শুরু হয়ে ১৯২৮ সালের মধ্যে তৎকালীন ভারতবর্ষে বাগান শ্রমিক সংখ্যা দাঁড়ায় ৯,০৬,৭৮৬ জন। তন্মধ্যে আসামে সিলেট, চট্টগ্রাম সহ ৫,৪৪,১৯৩ জন। বাকীরা দক্ষিন ভারতের।

(সূত্রঃ D Chamanlal, Coolie- The Story of Labour and Capital in India. Volume-11, P-18)

চা শ্রমিকদের উপর এই সব নির্যাতন নিপীড়নের কাহিনী তৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি মেহনতী মানুষের প্রতি দরদী সাহিত্যিকরা উপন্যাস, রূপক কাহিনী ইত্যাদি লিখেছেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক মূলক রাজ আনন্দের “দুটি পাতা একটি কুঁড়ি” চা শ্রমিকদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস তৎকালীন ভারতবর্ষ ও খোদ বৃটেনে তুমুল আলোড়ন তুলে ছিল। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয় রামকুমার বিদ্যারত্ন প্রনীত “কুলি কাহিনী”। আমাদের স্বাধীনতার পূর্বে প্রকাশিত সিলেটের অজয় ভট্টচার্যের “কুলি ম্যাম”  (১৯৭০),  চট্টগ্রামের কমিউনিস্ট নেতা কল্পতরু সেনগুপ্তের “চা বাগান শ্রমিকদের সংগ্রাম” ইত্যাদি লেখা, পুস্তক ও স্মৃতিকথা উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগর পরিকল্পিত ও সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যা ভূষণ সম্পাদিত কলিকাতা থেকে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত “সোম প্রকাশ” রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশিত হতো।

সমসাময়িক “ঢাকা প্রকাশ” এর একটি সংবাদ উদ্ধৃত করে “সোম প্রকাশ” লিখেছে, “ রূপ চাঁদ বিশ্বাস কহিলেন চা-করগন কুলি দিগকে যতপরোনাস্তি প্রহার করিয়া থাকেন।

কুলিদিগকে ১০/১২ বেতন প্রদানের কথা বলিয়া কাছাড় প্রভৃতি জেলায় লইয়া যাওয়া হয়। বাস্তবিক পক্ষে .মাস শেষে  তাহারা ২/১ টাকার অধিক পাইতে পারেনা। কুলিদিগকে সচরাচর যে খাদ্য দেওয়া হয় তাহা অতিশয় কদর্য। গো-অশ্ব প্রভৃতি পশুগণেরও আহারযোগ্য নহে। অথচ এই আহার দ্রব্যের জন্য মাসে ২ টাকা কাটিয়া লওয়া হয়”।

ঐ সময় সোম প্রকাশ পত্রিকার ন্যায় সঞ্জীবনী ও বেঙ্গলী পত্রিকাতেও নিয়মিত আসামের কুলিদের উপর নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশিত হতো।

চা শ্রমিকদের উপর মালিকদের নির্যাতন এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে ১৮৮০ সাল নাগাদ “ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন” এর সহ সম্পাদক দ্বরকানাথ গাঙ্গুলী এসোসিয়েশন কর্তৃক চা বাগানের কুলিদের অবস্থা তদন্তের জন্য আসাম প্রেরিত হন। তদন্তের পর তিনি বেঙ্গলি পত্রিকায় একগুচ্ছ প্রবন্ধ লেখেন। ঐ প্রবন্ধগুলো ঔপনবেশিক শোষক কর্তৃক কুলিদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের জ্বলন্ত স্বাক্ষ্য হয়ে আছে।

–চলবে

পরবর্তী এবং শেষ পর্ব আগামী ২0 জুন প্রকাশ করা হবে।

লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি এবং প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন