বিজন ভাবনা(২১): যুদ্ধ আর শান্তির গোল্লাছুট -বিজন সাহা

ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের জন্য ইদানিং বেশ দৌড়ঝাঁপ চলছে ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে। মজার ব্যাপার হল এক দিকে তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন, অন্য দিকে ভেনেজুয়েলায় যুদ্ধ জাহাজ পাঠাচ্ছেন। এ যেন এক সাথে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর – সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের দূত। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ আসলেই থামবে কি?
সোভিয়েত আমলের শেষ দিকে এ দেশে শুরু হয় সোপ অপেরার যুগ। মনে হয় “দাসী ইজাউরা” দিয়ে এর শুরু। সেটা ছিল ব্রাজিলের সিরিয়াল। এটা ছিল ব্রাজিলে শ্বেত প্রভু আর কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের বিরোধের ইতিহাস আর প্রেমের গল্প। এরপর আসে মেক্সিকোর “ধনীরাও কাঁদে”। আমরা বন্ধুরা প্রায়ই একসাথে বসে এসব সিরিয়াল দেখতাম আর ফুটবল খেলা দেখার মতই বিভিন্ন ঘটনায় আবেগ প্রকাশ করতাম। লুইস এলবারতো ছিল এই সিরিয়ালের নায়ক। সবাই জানত তার প্রতি মারিয়ানার (মারিয়ানা কি? ভুলে গেছি) ভালবাসার কথা, স্বামীর প্রতি মারিয়ানার সততার কথা। শুধু লুইস আজীবন মারিয়ানাকে সন্দেহ করে গেছে। নিজের ছেলেকে (যাকে সে জানত না) মারিয়ানার প্রেমিক মনে করে মদ খেয়ে হল্লা করেছে। আমরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা করে বলতাম, সারা বিশ্ব জানে তার ছেলে কথা, শুধু লুইস জানে না। আমার বিশ্বাস ইউক্রেনের লাগামহীন দুর্নীতির কথা, যুদ্ধের সময় জেলেনস্কি সহ তার পারিষদবর্গের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের কথা সবাই জানত। এ নিয়ে পশ্চিমা মাধ্যমেই একাধিক বার রিপোর্ট হয়েছে, পানামা পেপার না কি সব যেন ভেসে উঠেছে, বিশ্বের দামী দামী স্থানে তাদের প্রাসাদের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এলেনা জেলেনস্কির দামী পোশাক, গাড়ি এসব নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। রাশিয়ায় যেমন কাউকে আগে থেকে খবর না দিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে শীত আসে এখন তেমনি করেই ইউক্রেনের শাসকশ্রেণীর দুর্নীতি দেখে সবাই গেল গেল করে উঠছে এবং এত কেলেঙ্কারির পরেও জেলেনস্কিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে। আচ্ছা, আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বই কি ভিকি নুল্যান্ডের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেনি ইউক্রেনে কমলা বিপ্লবের পেছনে? আর এই টাকার বেশীর ভাগই তো চোরা গুপ্তা পথে বিপ্লবীদের কাছে এসেছে। দুর্নীতির বীজ বুনে এখন নিজেরাই অবাক হয়ে যাচ্ছে। আবার একই সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আরও বেশি করে সাহায্য দেবার কথা ভাবছে। কেন? অনেকের ধারণা, যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের লেনদেন চলছে তার ভাগ পাচ্ছে অনেকেই – সেটা ইউরোপ, আমেরিকা – এসব দেশের উচ্চ পদস্থ আমলারা পর্যন্ত। অর্থের কাছে বিকে যাওয়া মানুষের কাছ থেকে আর যাই হোক সততা আশা করা যায় না। রাশিয়ায় তাই বলে কামু ভাইনা, কামু মাত রাদনা – মানে কারও জন্য যুদ্ধ আর কারও জন্য জননী যে দুহাতে সন্তানকে সম্পদ দান করে।
দিন যাচ্ছে আর রুশ বাহিনী একের পর এক ইউক্রেন অধিকৃত দনবাসের গ্রাম শহর দখল করছে। যুদ্ধের শুরুতে বন্ধুদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলত – এ কেমন রুশ বাহিনী যে ইউক্রেন সেনাদের হাত থেকে দনবাস মুক্ত করতে পারে না। আসলে সেই ২০১৪ সাল থেকে ইউরোপের সাহায্যে ইউক্রেন তার অধিকৃত দনবাসকে এক অনতিক্রম্য দুর্গে পরিণত করেছিল। প্রায় প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি স্থাপনা তারা বাঙ্কারে পরিণত করে। আর বেসামরিক লোকদের ব্যবহার করে জীবন্ত ঢাল হিসেবে। তাই তো অতি ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হচ্ছে। তবে বর্তমানে রুশ বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে সেদিন খুব দূরে নয় যখন দনবাস পুরোটাই শত্রু মুক্ত হবে। শত্রু এ জন্যেই বলছি যে সেখানকার স্থানীয় লোকজন বর্তমানের বান্দেরার ইউক্রেনকে নিজেদের দেশ বলে মনে করে না। এটা অনেকটা একাত্তরে আমরা যেমন পাকিস্তানি সেনাদের নিজের মনে করতাম না যদিও ফরমালি তারা পূর্ব পাকিস্তানের সেনাও ছিল। অবশ্য জেলেনস্কি সহ ইউক্রেন শাসক চক্রও ইউক্রেন অধিকৃত দনবাসের বা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের লোকদের ঝদুন মানে রুশ বাহিনীর আগমনের জন্য অপেক্ষারত লোক বলেই মনে করে। আর একথা তারা প্রকাশ্যেই বলে।
কয়েক দিন আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন কিরঘিজিয়ায় সককারী সফর কালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাবে রাশিয়ার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ ০২ ডিসেম্বর সোমবার প্রেসিডেন্ট পুতিন মস্কোয় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আবারও নতুন করে রাশিয়ার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আলাস্কার আনকরিজে মার্কিন ও রুশ প্রেসিডেন্টদের সামিটের ভিত্তিতে ট্রাম্প প্রশাসন ২৮ দফার এক শান্তি প্রস্তাব পেশ করে আলোচনার জন্যে। কিন্তু ইউক্রেন ও ইউরোপ প্রথম থেকেই এর বিরুদ্ধে ছিল। তাদের ও খোদ আমেরিকায় যুদ্ধের পক্ষের লোকদের প্রচেষ্টায় ২৮ দফা ১৯ দফা হয়েছে বলে শোনা গেছিল। রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে তারা এমন কোন চুক্তি স্বাক্ষর করবে না যাতে রাশিয়ার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। যদি ইউক্রেন স্বেচ্ছায় দনবাস থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার না করে তাহলে রাশিয়া যুদ্ধ করেই সমস্ত এলাকা নিজেদের দখলে আনবে। মূল কথা রাশিয়া তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জন করবেই – তা সে আলোচনার মাধ্যমেই হোক আর যুদ্ধ করেই হোক। যদি ইউরোপ শান্তি চুক্তি করতে না দিতে চায় সেটা তাদের সমস্যা। পুতিন বলেন যে ইউরোপ নিজেই আলোচনার টেবিল থেকে সরে গেছে। তারাই রাশিয়াকে পরাজিত করার জন্য ওত পেতে বসে আছে। ইউরোপ বা ন্যাটোকে আক্রমণ করার কোন পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই। রাশিয়া নিজে থেকে ইউরোপ আক্রমণ করবে না এ ব্যাপারে তিনি লিখিত অঙ্গীকার দিতে প্রস্তুত, তবে বাধ্য করা হলে রাশিয়া হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। পুতিন আরও ঘোষণা করেন যে যদি ইউরোপ যুদ্ধ শুরু করে তাহলে রাশিয়া যেকোনো মুহূর্তে তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে প্রস্তুত। সেটা দুই বছর আগেই হোক আর আজই হোক। পুতিন ইউরোপের যুদ্ধবাজদের সতর্ক করে দেন যে সেখানে রাশিয়া ইউক্রেনের মত যুদ্ধ করবে না, মানে সাধারণ জনগণের কথা ভেবে লক্ষ্যবস্তু বাছবে না, শুধু মাত্র সারজিক্যাল স্ট্রাইক করবে না। এবং ইউরোপ যুদ্ধ শুরু করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলোচনার জন্য সেখানে কেউ থাকবে না। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, ইউরোপ যুদ্ধে নামলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে সেটা হবে যাকে বলে অল আউট ওয়ার। রাশিয়া তখন অস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারে কোন দ্বিধা করবে না।
ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করতে ইউক্রেন তুরস্কের ইকনোমিক জোনে রাশিয়ার ট্যাঙ্কার আক্রমণ করেছে। এ বিষয়ে পুতিন সতর্ক করে দেন যে এখন রাশিয়া তিন ধরণের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে – ১) যাতে ইউক্রেনে কোন অস্ত্র আসতে না পারে সেজন্যে ইউক্রেনগামী জাহাজ আক্রমণ করবে কারণ এসব জাহাজে করেই ন্যাটো ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করে, ২) ইউক্রেনের যেসব এলাকা থেকে এসব সামুদ্রিক ড্রোন ছোড়া হয় সেসব এলাকা ধ্বংস করবে অথবা ৩) ইউক্রেনকে সমুদ্রমুক্ত করবে মানে ওদেসা, নিকোলায়েভ সহ সমস্ত উপকুলীয় এলাকা দখল করবে, যা বরাবরই রুশ অধ্যুষিত ছিল এবং এখনও যেখানে রাশিয়ার ব্যাপক সমর্থন আছে। সব দেখে মনে হয় রাশিয়া আগে যদি অন্তত চেষ্টা করত কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে সংযত থাকতে, এখন তারা কোন রাখঢাক করছে না এবং ইউক্রেন বা ইউরোপ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইলে রাশিয়া পূর্ব–দক্ষিণ ইউক্রেনের পুরো রুশ বেল্ট দখল করবে। এছাড়া যদি শান্তি চুক্তি হয়ও রাশিয়া বারবার বলছে এখন কিয়েভে কোন আইন সম্মত প্রশাসন নেই, তাই আলোচনা করলেও তাদের সাথে কোন চুক্তি স্বাক্ষর করা অর্থহীন। তাই রাশিয়া চায় সব চুক্তির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশেষ করে ক্রিমিয়া ও দনবাসের উপর রাশিয়ার আইনসংগত অধিকারের স্বীকৃতি। এর অর্থ, যদি এর পরে ইউক্রেন বা কেউ এসব এলাকা আক্রমণ করে তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক নিয়মের আওতায় রাশিয়ার উপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে এবং রাশিয়া সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এখনও পশ্চিমা বিশ্ব ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ মনে করে আর তাই ন্যাটোর অস্ত্র দিয়ে যখন ক্রিমিয়া আক্রমণ করা হয় এটাকে তারা রাশিয়ার উপর আক্রমণ বলে মেনে নেয় না। ২০১৪ থেকে শুরু করে একাধিক বার ইউরোপের মধ্যস্থতায় বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া বুঝেছে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের মানে আমেরিকা, চীন, ভারত, জাতিসংঘ, ব্রিকস এসব দেশ ও প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টি ছাড়া কোন চুক্তি করা অর্থহীন।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত উইটকফ ও জামাতা কুশ্নার মস্কো ঘুরে গেছেন পুতিনের সাথে দেখা করে। ইউরোপ নাখোশ কারণ তাদের আর ডাকা হয় না। সত্যি বলতে কি সোভিয়েত আমলেও ইউরোপ ছিল দূরসম্পর্কের আত্মীয় – তাদের দিয়ে দুই পক্ষই দলভারী করত, তবে মতামতের খুব একটা তোয়াক্কা করত না। এখন তাদের অবস্থা ক্ষয়ে যাওয়া জমিদারদের মত। সব জায়গায় নাক গলাতে চায়, অথচ কেউ আর পুঁছে না। এতদিন তাদের পুঁছত মুলত তাদের অর্থনীতির কারণে যার ভিত্তি অনেকাংশেই ছিল রাশিয়ার সস্তা জ্বালানি। তবে তারা নিজেরাই রাশিয়ার জ্বালানি থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এটা দেখে আমার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক এক প্রজাতন্ত্রের কথা মনে পড়ে। তার সম্পর্কে বলা হত, এই দেশ সবচেয়ে স্বাধীন কারণ তার উপর বিশ্বের কোন কিছু নির্ভর করে না। ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসব মিলে ইউরোপের অবস্থাও তাই – তাদের উপর আর কিছুই নির্ভর করে না। এমনকি পুতিনের ভারত সফর নিয়ে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরা উষ্মা প্রকাশ করলেও ভারতের সরকারের কাছে কোন পাত্তা পায়নি। সব কিছুরই একটা পজিটিভ দিক থাকে। ইউরোপ মুক্ত বিশ্ব বা ইউরোপের নাক গলানি মুক্ত বিশ্ব – এটাই হবে ইউক্রেন যুদ্ধের সেই পজিটিভ দিক।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
