মাত্র ১৩ দিনে ৩৩ বছরের ইজারা -ফজলুল কবির মিন্টু

লালদিয়া টার্মিনালের ইজারা চুক্তি ঘিরে দুই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছে—দেশের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো কি এখন তড়িঘড়ির প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে? যেন কেউ সময় গুনছে, কত দিনে একটি জাতীয় বন্দর বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়া যায়।
ঘটনাগুলো এক নজরে দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়: ৪ নভেম্বর প্রস্তাব দাখিল, ৫ নভেম্বর কারিগরি মূল্যায়ন, ৬ নভেম্বর আর্থিক মূল্যায়ন। তারপর অভিযোগ রয়েছে—শুক্র–শনিবার দুই ছুটির দিনেই নেগোসিয়েশন সম্পন্ন হয়েছে। ৯ তারিখে বোর্ড অনুমোদন, ১০–১১ তারিখে মন্ত্রণালয়, ১২ তারিখে উপদেষ্টা কমিটি, ১৬ তারিখে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন—আর পরদিন চুক্তি স্বাক্ষর। মোট ১৩ দিন। মাত্র ১৩ দিনে ৩৩ বছরের ইজারা। প্রশ্ন ওঠে—এ ধরনের চুক্তি কি আদৌ এমন গতিতে হওয়া উচিত?
এই চুক্তি নিয়ে সরকারের বক্তব্য হলো: সবই হয়েছে নীতিমালা মেনে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। কিন্তু জনগণের উদ্বেগটা অন্য জায়গায়—স্বচ্ছতা। চুক্তিতে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট থাকার অর্থ হলো, বিস্তারিত জানানো যাবে না। বন্দর, শুল্ক, নিরাপত্তা, শ্রমবাজার—সবকিছুকে প্রভাবিত করবে এমন চুক্তির শর্ত, ঝুঁকি বা সুবিধা—কোনোটিই জনগণ জানতে পারবে না। কৌশলগত বন্দর সুবিধা যদি স্বচ্ছতার আড়ালে চলে যায়, তাহলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা কোথায়?
এই উদ্বেগের শেকড় আছে আগের অভিজ্ঞতায়। জাইকার সঙ্গে মেট্রোরেলের ঋণ চুক্তির কথা মনে করা যেতে পারে। তখন ব্যাপক প্রশংসা হয়েছিল—‘বিশ্বমানের প্রকল্প’, ‘অর্থায়ন নিশ্চিত’ ইত্যাদি। কিন্তু চুক্তির সূক্ষ্ম শর্তগুলো তখন জনসমক্ষে ছিল না। পরে জানা গেল—দরপত্র একবারই আহ্বান করা যাবে, দ্বিতীয়বার নয়; আর দরকষাকষিও নিষিদ্ধ। নতুন মেট্রোলাইনের জন্য দরপত্র আহ্বানে জাপানি ঠিকাদাররা যখন ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলনের বিপরীতে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার দর প্রস্তাব করল, তখন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকল না। না পুনঃদরপত্র আহ্বান, না দর কমাতে আলোচনা। শুধু মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এটাই অস্বচ্ছ চুক্তির পরিণতি। তাহলে প্রশ্ন জাগে—লালদিয়া চুক্তি কি সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি?
৩৩ বছর কম সময় নয়। এক–দুই প্রজন্মের বন্দর-নির্ভর বাণিজ্যের ওপর এই চুক্তির প্রভাব পড়বে। একটি বন্দর পরিচালনার সুযোগ দেওয়া মানে কেবল কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়া নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সারাদেশের আমদানি–রফতানি খরচ, শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ, কাস্টমস রাজস্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা—সবকিছু। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে: সময় নিয়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়া, ব্যবসায়ী সমাজকে জানানো, বন্দর ব্যবহারকারীদের আলোচনার টেবিলে আনা—এসব কি খুব কঠিন ছিল?
বিশ্বে বন্দর ইজারা দেওয়া নতুন কিছু নয়। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কেনিয়া, গ্রিস—অনেক দেশ বিদেশি অপারেটরের কাছে বন্দর দিয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আলোচনার সময়সীমা সাধারণত কয়েক মাস থেকে এক–দেড় বছর পর্যন্ত হয়। কারণ, বন্দর একটি সার্বভৌম সম্পদ—এখানে ভুল সিদ্ধান্তের মূল্য কয়েক দশক ধরে দেশকে দিতে হয়। আমাদের প্রক্রিয়ার গতি তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম শ্রমিক–কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) চুক্তিটি যেভাবে দ্রুত করা হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ—শ্রমিক, ব্যবসায়ী, বন্দর ব্যবহারকারী—কেউই আলোচনার অংশ ছিল না। তাদের প্রশ্ন, প্রজন্মের পর প্রজন্মের সম্পদ বলে পরিচিত একটি বন্দরকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষের মতামত এত সহজেই এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী? স্কপ ইতিমধ্যে ২২ নভেম্বর শ্রমিক কনভেনশন আহ্বান করেছে। এই ক্ষোভ কি কেবল শ্রমিকদের? নাকি এটি বৃহত্তর জনআলোচনার প্রয়োজনীয়তার প্রতিফলন?
অনেক সময় সরকার এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, যেন প্রশ্ন করলেই কেউ উন্নয়নবিরোধী। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বড় উন্নয়ন প্রকল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো জনপর্যায়ের স্ক্রুটিনি—আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা। প্রশ্ন করা মানে উন্নয়ন ঠেকানো নয়। বরং প্রশ্ন করার সুযোগ না থাকা মানে—উন্নয়নের ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো অনুত্তীর্ণ অংশ।
এ কারণে জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত চুক্তি বাতিল—এমন অবস্থান কেউ কেউ নিতে পারেন, কেউ কেউ নাও নিতে পারেন। কিন্তু একটি জিনিস স্পষ্ট—চুক্তি হওয়ার আগেই আলোচনার সুযোগ থাকা উচিত ছিল। চুক্তি হওয়ার পর অনুতাপ সাধারণত জাতির জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
লালদিয়া চুক্তির এই গতি তাই শুধু গতি নয়—এটি আমাদের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার সার্বিক স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
(লেখকঃ টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)
