ইন্টারিম সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে প্রশ্ন: নির্বাচন আয়োজনেই কি অনীহা? -ফজলুল কবির মিন্টু

জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন মাস বাকি। এই সময় সরকারের প্রধান মনোযোগ থাকার কথা অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিতে। কিন্তু ইন্টারিম সরকার সাম্প্রতিক সময়ে যে ধারাবাহিক সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের এইসব সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক নয়—নির্বাচনী প্রেক্ষাপটেও এর তাৎপর্য রয়েছে। অনেকে বলছেন, সরকারের পদক্ষেপগুলো এমন এক সময় আসছে, যখন নির্বাচন নিয়ে জনগণের আস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।
বন্দরের ইজারা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন
সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়া চর টার্মিনাল, এবং বে টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের হাতে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ।
সরকার বলছে, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ নিশ্চিতের জন্য এসব টার্মিনাল বেসরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংগঠন, বন্দর ব্যবহারকারী ও দেশীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তাদের প্রশ্ন— দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ও বন্দর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারাবে না তো?
মুনাফা নিশ্চিতে ট্যারিফ বাড়ানো
এরই মধ্যে সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও হ্যান্ডলিং ট্যারিফ গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি আধুনিকীকরণের অংশ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এই সিদ্ধান্ত আসলে বিদেশি ইজারা গ্রহীতাদের মুনাফা নিশ্চিত করার প্রস্তুতি।
এই ট্যারিফ বৃদ্ধিতে আমদানি–রপ্তানি ব্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে দেশের পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।
একজন বন্দর ব্যবহারকারী বলেন, “এখনই যদি ট্যারিফ বাড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে বিদেশি অপারেটরদের হাতে গেলে খরচ দ্বিগুণ হতে পারে। এতে পুরো রপ্তানি খাত চাপে পড়বে।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সন্দেহ
এমন এক সময়ে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যখন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে মনোযোগী থাকার কথা। কিন্তু একের পর এক বিতর্কিত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত জনমনে প্রশ্ন তুলেছে— সরকার আদৌ নির্বাচন আয়োজনের সদিচ্ছা রাখে কি না।
একজন জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “এগুলো শুধু অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এগুলো জনবিশ্বাস ও রাজনৈতিক আস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। নির্বাচনের আগে সরকার যেভাবে নতুন নতুন বিতর্ক তৈরি করছে, তাতে মনে হচ্ছে তাদের অগ্রাধিকার অন্যখানে।”
বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, এই সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে— যাতে জনগণের মনোযোগ নির্বাচনী ইস্যু থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়।
নাগরিক সমাজের আহ্বান
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারের উচিত এখনই নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সময়সূচি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা। একইসঙ্গে বিদেশি ইজারা ও ট্যারিফ বৃদ্ধির মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।
একজন নাগরিক প্রতিনিধি বলেন, “দেশ এখন এক সংবেদনশীল মোড়ে। সরকার যদি সত্যিই নির্বাচন চায়, তাহলে তাকে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে— বিতর্ক তৈরি করে নয়, সংলাপ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে।”
(লেখকঃ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী)