দিলাল রাজা ও তার বংশধরেরা -ইকবাল সরোয়ার সোহেল
সন্দ্বীপের শেষ স্বাধীন শাসক দেলোয়ার খাঁ (দিলাল রাজা নামে যিনি অধিক পরিচিত) বাংলাদেশের সন্দ্বীপের শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন। একজন শক্তিশালী ও দানশীল শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল, যার কারণে তাকে বাংলার রবিন হুড নামে অবিহিত করা হয়। তিনি ধনীদের থেকে চুরি করে গরীবদের উপহার দিতেন। তাঁর জীবনী আজও জনপ্রিয় এবং সন্দ্বীপের স্থানীয় লোককাহিনী ও অদ্ভুত কেচ্ছায় তাঁর নাম পাওয়া যায়। তাঁকে সতেরশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বাঙ্গালী মুসলিম শাসক হিসেবে গণ্য করা হয়।বলা হয়ে থাকে, পর্তুগিজদের যুদ্ধে হারিয়ে সন্দ্বীপের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন দিলাল রাজা। দিলাল রাজা একটানা প্রায় ৫০ বছর সন্দ্বীপ শাসন করেন। ১৬১৬ থেকে ১৬৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাধীনভাবে সন্দ্বীপের রাজা ছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও মুদ্রাব্যবস্থা।
সম্ভবত ১৫৮৫ সালে ঢাকায় দেলওয়ার খাঁর জন্ম হয়েছে। তাঁর ছোটবেলা নিয়ে আনেক জনশ্রুতি আছে। কয়েকটি বর্ণনায় কথিত আছে যে শিশু দিলাল তাঁর মায়ের সাথে জাহাজে ছিলেন। জাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে তারা সন্দ্বীপের সৈকতে পড়েন। সন্দ্বীপ পর্তুগিজ জলদস্যুতার জন্য তখন পরিচিত ছিল। লোককাহীনি অনুযায়ী একটি কোবরা শিশু দিলালকে রোদ থেকে রক্ষা করেছিল। ভবিষ্যৎ-এ সন্দ্বীপের ইতিহাসে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে দিলাল, এই ঘটনা তাই যেন প্রমাণ করে।
ইতিহাসবিদদ্বয় সৈয়দ মুর্তাজা আলী এবং মুহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন যে দিলালের মাতৃভূমি ঢাকায় ছিল। তিনি মুঘল নৌবাহীনিতে কর্মরত ছিলেন। যদুনাথ সরকারের বর্ণনায় দিলাল ছিল মুঘল নৌবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি পালিয়ে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
যেহেতু বহু দশক ধরে সন্দ্বীপে জলদস্যুতা প্রভাব ছিল, এভাবে অনেক লোকই সন্দ্বীপকে শাসন করেছিল। পর্তুগিজ জলদস্যু সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস তিবাঁওকে পরাজিত করার পর আরাকান রাজ্য ক্ষমতা গ্রহণে সফল হয়। মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ও ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ বাংলার সুবাহদার থাকাকালে দিলাল ঢাকার মুঘল নৌবাহিনীর একজন অধিনায়কের চাকরী পান। সন্দ্বীপ দখল করার জন্য দিলাল এই দায়িত্ব থেকে গোপনে পদত্যাগ করেন ও সন্দ্বীপে তিনি তার খান্দান এবং ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী নিয়ে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। সৈয়দ মুর্তাজা আলীর মতে, আরাকানের মগদের বিরুদ্ধে মুঘলদের যুদ্ধ শুরু হওয়ায় দিলাল শান্তিপূর্ণভাবে সন্দ্বীপ শাসন করতে পেরেছেন। কেন যে দিলাল একটি স্থিতিশীল চাকরী থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং নিজের জন্য বিপজ্জনক স্বাধীন জীবনধারা বেছে নিয়েছিলেন, তা অজানা। তিনি প্রায় ৫০ বছর শাসন করেন, যেটা ১৬১৬ থেকে ১৬২২ সালের মধ্যে যেকোন একসময় শুরু হয়েছিল। দিলালের ছেলে শরীফ খাঁন মুঘল অধীনস্থ ৫০০ সেনানীর মনসবদার নিযুক্ত হয়েছিলেন।
ইংরেজ ভ্রমণকারী স্যামুয়েল পরচাস লিখেছেন, সন্দ্বীপের মুসলমান সংখ্যাগুরু হলেও দিলাল সংখ্যালঘু হিন্দুদের সাথে ন্যায্য আচরণ করতেন। দিলালের বিচার ব্যবস্থা ছিল অনন্য। তার একটি আইন ছিল যে ঝগড়ার পরে উভয় পক্ষকে একই জায়গায় দাঁড়াতে হবে এবং দিলালের আগমন ও রায়ের পরেই স্থান ত্যাগ করা যাবে। দিলাল প্রয়োজনে স্বজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দ্বিধা করেননি বলে জানা গেছে। তিনি হিন্দুত্ববাদের জাতি-বর্ণ ভেদাভেদকেও অস্বীকার করতেন।
শত্রু বা সামরিক কৌশলের হাত থেকে সন্দ্বীপের হেফাজতের ক্ষেত্রে, দিলালের অত্যন্ত কঠোর নীতি ছিল। সন্দ্বীপের একমাত্র রাস্তাটি খাড়ির মধ্য দিয়ে ছিল। এটি দ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করেছে। এটি ছিল অগভীর এবং সরু। দিনে দুইবার জোয়াড় আসতো এবং তখনই এই খাড়ি নৌকা চলাচলের উপযোগী হতো। এই জন্যই কোন নৌকাই বেশিক্ষণ এই খাড়িতে অবস্থান করতে পারতো না। এই খাড়ির মুখে তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন যেখান থেকে যেখান থেকে সহজেই যেকোন বহিঃশত্রুর আক্রমণ রুখে দেওয়া যেত। দ্বীপের অভ্যন্তরে তার মহলটি ছিল একটি কেল্লা, যার চারপাশে খাদ এবং পিছনে ঘন জঙ্গল ছিল।
১৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানের মগ রাজা সীরিসুদ্ধম বুঝতে পেরেছিল যে দিলাল রাজা তার আরাকানের অধিপত্য মানতে রাজী নন, তাই একটি সেনা-বহর পাঠিয়েছিলেন সন্দ্বীপের দিকে। দিলাল অবিলম্বে তার সেনানীদের সন্দ্বীপের প্রবেশপথে খাঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকার হুকুম দেন। খাঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করে, মগরা ভয় না পেয়ে তাদের নৌকা থেকে নেমে দিলালের মহলের দিকে যেতে লাগল। সেই মুহুর্তে, দিলালের সেনানীরা মগদের আক্রমণ করতে বেরিয়ে আসে এবং কেল্লার সেনানীরাও তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। অনেক মগ নিহত বা বন্দী হলেও কেউ কেউ তাদের ভাঙ্গা নৌকা নিয়ে আরাকানের দিকে পালিয়ে যায়। এই আক্রমণের স্মরণে এলাকাটি আজও মগধারা নামে পরিচিত। সন্দ্বীপ তখন থেকে একটি শান্তিপূর্ণ দ্বীপ ছিল এবং দিলাল পুরো দ্বীপটিকে সুরক্ষিত করে তোলেন যাতে শত্রুরা দ্বীপটি সহজে দখল করতে না পারে।
১৮ নভেম্বর ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে, বাংলার সুবেহদার শায়েস্তা খাঁ তাঁর এক সেনাপতি আবুল হাসানকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ দিলাল রাজার শাসিত সন্দ্বীপ বিজয় করার হুকুম দিয়েছিলেন। ওলন্দাজ সেনাবাহিনীও এই অভিযান সমর্থন করেছিল। মগরা পর্তুগিজদের সাথে ছিটকে পড়েছিল, যার ফলে পর্তুগিজরাও তখন মুঘলদের সাহায্য করেছিল। শরীফ খাঁন খূব ভালো করে সন্দ্বীপকে হেফাজত করার চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি আহত হন। এরপর মুঘল বাহিনী দিলালের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলে যেখানে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিলাল একগুঁয়ে প্রতিরোধের প্রস্তাব দেন কিন্তু মুঘল ঘোড়সওয়ারদের দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ২৬ জানুয়ারি ১৬৬৬ এর মধ্যে বিজয় সফল হয় এবং ইউরোপীয় জলদস্যুদের প্রধান ক্যাপ্টেনকে পুরস্কৃত করা হয়। দিলাল, তাঁর ছেলে শরীফ এবং ৯২ জন সহযোগীকে একটি লোহার খাঁচায় বন্দী করা হয় এবং ঢাকার কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বৃদ্ধ দিলাল সেই কারাগারেই জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের মতে, তাদের মুর্শিদাবাদে আটকে রাখা হয়েছিল কিন্তু ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ আব্দুল কাদের দাবি করেন মুর্শিদাবাদ আসলে আঠারশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুর্শিদকুলি খাঁ দ্বারা বাংলার রাজধানী স্থাপন করা হয়। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা মনে করেন, দিলালকে বন্দী করে জাহাঙ্গীরনগরে পাঠানো হয়েছিল মোঘল সেনাপতি ও জমিদার মনোয়ার খাঁনের (ঈশা খাঁর বংশধর) দায়িত্বে। পরে সেখানেই দিলাল রাজা মৃত্যুবরণ করেন। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে পর্যায়ক্রমে আব্দুল করিমকে সন্দ্বীপের মুঘল ফৌজদার নিয়োগ করা হয়। ১৬৬৬ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর মোঘলরা সন্দ্বীপ শাসন করে।
দিলালের অনেক ছেলে ও দুই মেয়ে (মুছাবিবি ও মরিয়ম বিবি) ছিল। ছেলেদের মধ্যে শুধু শরীফ খাঁর নাম জানা আছে। ক্ষতিপূরণের উপায় হিসেবে, বাংলার সুবেহদার শায়েস্তা খাঁ দিলালের ছোট ছেলেদেরকে ঢাকা শহরের কাছে ১০-১২ গ্রামের জায়গীর প্রদান করেছিলেন, ধলেশ্বরীর তীরের পাথরঘাটা-মিঠাপুকুর এলাকায়। ২০০ বছর পর এসব গ্রামগুলো নদী ভাঙনের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। দিলালের বংশধররা তারপর সাভারের গেণ্ডা গ্রামে স্থানান্তরিত হন।
দিলাল রাজা বা নবাব দেলোয়ার খাঁর নবম উত্তর পুরুষ হচ্ছেন, ডাকসুর সাবেক ভিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম (খান) সেলিম (৮ম বংশধর), সাভারের সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান ইমু (৮ম বংশধর), মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মেয়ে স্বর্ণালী ইসলাম, ছেলে তৌহিদুল ইসলাম খান (সুমন্ত), আশরাফ উদ্দিন খান ইমুর তিন ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন খান শান্তুনু, গোলাম শফিউদ্দিন খান ও গোলাম ফয়েজ উদ্দিন খান এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার, ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান সবাই ৯ম বংশধর।দিলালের মেয়েদ্বয়ের বংশধররা সন্দ্বীপে রয়ে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে মুছাবিবি চাঁদ খাঁর সাথ বিয়ে হয়েছিল এবং ছোট মেয়ে মরিয়ম বিবির বিয়ে হয়েছিল মুলিশ খাঁর সাথে। সন্দ্বীপে এখনও মুছাপুর এলাকা ও মুছাবিবির দিঘী উল্লেখযোগ্য আছে। চাঁদ খাঁ ও মুছাবিবির চারজন ছেলে হলেন জুনুদ খাঁ, মুকীম খাঁ, সুরুল্লাহ খাঁ এবং নূরুল্লাহ খাঁ। জুনুদ খাঁর ছেলে মুহম্মদ রাজা হলেন আবু তোরাব ও ফুলবিবির বাবা। মুকীম খাঁনের ছেলে মুহম্মদ হোসেন এবং তার ছেলে মুহম্মদ মুরাদ। ফুলবিবি ও মুহম্মদ মুরাদের বিয়ে হয় এবং তাদের ছেলে মুহম্মদ হানিফও সন্দ্বীপের একজন উল্লেখযোগ্য জমিদার ছিলেন। আবু তোরাবের মহল হরিশপুরে অবস্থিত ছিল এবং ১৭৬৭ সালে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম ব্রিটিশ-বিদ্রোহী নেতা।
রাজা দেলওয়ার খার এক বোন ছিল, যার নাম ছিল হীরাবিবি। সন্দ্বীপের রহমতপুরের আদম খাঁ পাড়া বা আদিল খাঁর বাড়িই দিলাল রাজার বোন হিরাবিবির বাড়ি। এটিই ইতিহাসের সেই বাড়ি, যেখানে দিলাল তার বোনকে কথা অমান্য করার অপরাধে অশ্বথগাছ সংবলিত বনবাসে পাঠিয়েছিলেন বলে বিশ্লেষিত হয়ে আসছে। কালের হিসেবে বর্তমানে সন্দ্বীপের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে এটিই সবথেকে পুরাতন বাড়ি হিসেবে বিবেচিত হয়, যার আনুমানিক বয়স ৩৭০ বছর।(লেখকঃ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক)
