খসরু: স্মৃতির আঙিনায় অনুপস্থিতির আলো — শোয়েব নাঈম
ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস উল্টালে অসংখ্য নাম চোখে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে আশির দশকের শেষভাগের ছাত্র ইউনিয়নের কথা উচ্চারণ করলে প্রিয় মুখগুলোর ভিড়ে অনিবার্যভাবেই জেগে ওঠে সাইফুদ্দিন খালেদ খসরুর নাম। খসরু— এই নাম উচ্চারিত হলেই যেন খুলে যায় এক প্রশস্ত আঙিনা। তাকে ঘিরে ছিল সংস্কৃতির প্রশস্ত সমীকরণ। গভীর আলোচনাধর্মী বইয়ের পার্শ্বে চটপটে অভিযানের উপন্যাস, রাতের শেষে কোনও পুরোনো সিনেমার অ্যাকশন-দৃশ্যে চোখ বুঁজে থাকা কিশোর উচ্ছ্বাস। বইয়ে ঠাসা আলমারির পাশে, গল্পে মশগুল একদল তরুণের আড্ডার কেন্দ্রে—হালকা হাসিতে গাঢ় আলোর মতো জেগে থাকা মানুষটি খসরু। মোলায়েম ভঙ্গির সেই তরুণ অচিরেই হয়ে ওঠেন দায়িত্বশীল নেতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। রাজনীতি তার কাছে ছিল পোস্টারের রঙ নয়। ছিল ধারাবাহিক চিন্তার শৃঙ্খল। সে ভালোবাসত শৃঙ্খলাপরায়ণতা, জানতো রাজনীতির নির্মাণ-ইঁট, নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, ইতিহাসের কাঁধে রেখে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। তবু তার মেজাজে ছিল অনমনীয়তা ও নম্রতার মিশ্রণ। কারও সঙ্গে মতবিরোধে কখনো কন্ঠ উঁচু হয়নি। যুক্তি হয়েছে; রাগ জেগেছে, কিন্তু তা হয়েছে আত্মশাসনের আয়নায় ধোয়া।
খসরু বিশ্বাস করত মুক্ত মানুষের জন্য মুক্ত সমাজ। এই বাক্যটি তার জীবনে কোনো banner ছিল না, ছিল অভ্যাস। সে যুক্তি ভালোবাসত, কিন্তু যুক্তিহীন মানুষের জন্য করুণাও বাঁচিয়ে রাখত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সে নেমে গেছে জীবিকার রূপরেখায়। প্রথমে উন্নয়ন সংস্থার মাঠ, পরবর্তীতে শিল্পগোষ্ঠীর জটিলতা, শেষে ব্যাংকের শৃঙ্খলায় পেশাজীবনের দীর্ঘ করিডোর। ডেস্ক, ফাইল, ক্লায়েন্ট। কিন্তু অফিস-আইডিতে যার নাম “খালেদ”, বন্ধুমহলে তিনি বরং “খসরু”। দু’টি নামের মাঝখানে তারই দ্বৈতলয়ের সুর: পেশাদার বিনয় আর বন্ধুত্বের অকপটতা। কিন্তু অসময়ে সে থেমে গেছে। তাকে কি সত্যিই থামানো যায়? না—কারণ যে মানুষ অন্যের স্মৃতিতে বীজ বুনে গেছে, তার জন্য মৃত্যু কেবল দরজা-পরিবর্তন। খসরু এখন দোতলায় চলে গেছে, আমরা নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছি। মাঝখানে সিঁড়িটা তার রেখে যাওয়া কাজ, তার সাজানো আড্ডা, তার ধৈর্যের উচ্চারণ, তার স্নিগ্ধ পোশাক, তার হালকা সুগন্ধ, আর গভীর হাসি। তার চলে যাওয়ার বয়স হয়েছিলও কি? ক্যালেন্ডার বলবে, মাত্র। কাজ বলবে—অগণিত। স্বপ্ন বলবে—আরো কিছুটা বাকি ছিল। আকস্মিক বিদায়— ১১ অগাস্ট ২০২৫ তারিখ রাতের নীলাভ নীরবতায় যেদিন খবরটি এলো, আমরা প্রত্যেকেই হঠাৎ করে নিজেদের বয়সে কয়েক বছর করে বেড়ে গেলাম। চোখ বুজলেই তার শিশুসুলভ হাসি ভেসে ওঠে। সেই হাসি আমাদের বুকে শোকে ভাসিয়ে দিয়েছে।
খসরুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে, বলেছিল, “চল, সন্ধ্যায় দেখা করি”। আর তার সাথে দেখা হলেই পৃথিবীটা একটু কম অন্ধকার মনে হতো। শিল্পকলা একাডেমির মাঠে বসা, রাত্রির ছায়ায় তর্ক, অকারণ হাসি। সবই এখন স্মৃতি-ঝর্ণা। আমরা জানি, স্মৃতি কখনও পুরোপুরি শুকায় না; কেবল স্রোতের ধারা বদলায়। আমরা জানি— সমস্ত শোকের ভিতরেও থাকে নীরব আশীর্বাদ। যে মানুষটি দিতে জানত, সে আজও দিচ্ছে—আমাদের কাঁধে ভরসা রাখবার ভরসা। তার সন্তানরা বড় হবে—তার মতোই পরিপাটি, স্নিগ্ধ, যুক্তিবান। তার সাথিরা যাদের চোখে জল, তারা আবার রাতের শেষে আলো খুঁজে নেবে। তার শহর, যে শহর তার জুতার শব্দ চিনত, আবার নতুন ভোরে উঠবে। আর আমরা, যারা নাম ধরে ডাকতাম “খালেদ”, “ভাই”, “স্যার”, “সাহেব”—আমরা তার জন্য উচ্চারণ করব মৃদু প্রার্থনা। যে নীরবতাকে সে সারা জীবন এড়িয়ে চলেছে, স্রেফ কাজ করে—সেই নীরবতা যেন আজ তাকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে।
খসরু, তোমার দিকে আমাদের ভালোবাসা পৌঁছে যাক, অবাধ, উদ্বেল, নীরব। তুমি থাকো আলোয়।তোমাকে আমরা হারাইনি, আমরা কেবল তোমাকে স্মরণ করার নতুন ভাষা শিখছি।
