মতামত

ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন: শ্রম আইন ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার অপরিহার্যতা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায্যতার প্রতীক। এটি এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার নেতৃত্ব নির্ধারিত হওয়া উচিত স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অনুসারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে— আইন ও গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা চলছে। এমন বাস্তবতায় শ্রম আইন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে সঠিক নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা একান্ত জরুরি।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা শ্রম কর্মকর্তার দায়িত্ব

২০১৪ সালের ৮ জুলাই উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩১৭(৪)(ঘ) ধারার বিধান অনুযায়ী, শ্রম পরিচালক বা তার মনোনীত একজন শ্রম কর্মকর্তা সরাসরি দেশের সকল ট্রেড ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন তত্ত্বাবধান করবেন।

এই কর্মকর্তা—

  • সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সাধারণ বা বিশেষ সাধারণ সভায় সশরীরে উপস্থিত থাকবেন,
  • সভায় নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন উপকমিটি গঠনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন,
  • সঠিক ও হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রস্তুত,
  • মনোনয়ন যাচাই,
  • গোপন ব্যালটের মাধ্যমে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করবেন,
  • ফলাফল ঘোষণা ও নবনির্বাচিত কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত প্রক্রিয়া ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করবেন।

প্রয়োজনে, এই কর্মকর্তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিতে পারেন, যাতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও, শ্রম পরিচালক নিশ্চিত করবেন যে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই যদি নির্বাচন হয়, তাহলে নবনির্বাচিত কমিটি কেবল পূর্ববর্তী কমিটির মেয়াদ শেষ হলেই দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার ব্যত্যয়: আইন বিধিমালার পরিপন্থী

অনেক সময় দেখা যায়, কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়া, শ্রমিকদের অন্ধকারে রেখে হঠাৎ করে সম্মেলনের নাম করে লোকদেখানো নির্বাচন আয়োজন করা হয় এবং নতুন কমিটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এ ধরনের আচরণ স্পষ্টভাবে শ্রম আইন, গঠনতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চার লঙ্ঘন।

একটি সংগঠনের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমিকদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ও সম্মতি। শুধু কাগজে কলমে নয়, বরং বাস্তব অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, তা না হলে পুরো প্রক্রিয়া অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।

ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ইচ্ছায় নয়, সংবিধিবদ্ধ কাঠামোর আওতায় হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ট্রেড ইউনিয়ন কোনো  সরকারী খাস জমি বা হঠাৎ জেগে উঠা কোন নদীর চর নয় যে, বলপ্রয়োগে দখল করা যাবে। শ্রমিকদের আস্থা ও সম্মতির ভিত্তিতে সংগঠনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

মেয়াদ উর্ত্তীন্য বা নিষ্ক্রিয় কমিটির ক্ষেত্রে বৈধ নির্বাচন আয়োজনের আইনগত প্রক্রিয়া

ট্রেড ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটি যদি মেয়াদ উর্ত্তীন্য বা সম্পূর্ণরূপে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি সুসংহত আইনগত পথ রয়েছে।

এক্ষেত্রে, চাঁদা প্রদানকারী সদস্যদের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশের স্বাক্ষরসহ তলবি সাধারণ সভার আহ্বান করতে হয়, অথবা ট্রেড ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রে যদি তলবি সভা আহ্বানের নির্দিষ্ট বিধান থাকে, তাহলে সেই ধারা অনুসরণ করেই সভা আহ্বাণ করতে হবে।

এই সভা আহ্বানের ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দুটি শর্ত কঠোরভাবে প্রযোজ্য:

  • তলবি সভা আহ্বান করতে পারবেন কেবলমাত্র চাঁদাদানকারী সদস্যরা।
  • সভায় অংশগ্রহণের যোগ্যতাও শুধুমাত্র চাঁদাদানকারী সদস্যদের রয়েছে। মনে রাখতে হবে চাঁদাদানকারী সদস্য ছাড়া অন্য কেউ তলবি সভায় যোগ দেয়া বা  সিদ্ধান্ত গ্রহনে ভূমিকা রাখতে  পারেনা

তলবি সভায় আইন ও গঠনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এরপর, কমিশনের অধীনে নির্বাচন তফশিল ঘোষণা, মনোনয়ন যাচাই, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে শ্রম কর্মকর্তার সরাসরি উপস্থিতি ও তত্ত্বাবধানে। যদি পেশি শক্তি ব্যবহার করে কেউ ট্রেড ইউনিয়ন দখল করার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে সকল শ্রমিক সংঠনের উচিত তাদের চিহ্নিত করে বিষয়টি শ্রম দপ্তরের নজরে আনা। এই ব্যাপারে সরকার এবং শ্রম দপ্তরেরও দায়িত্ব রয়েছে। এই ধরনের ঘটনা তাদের নজরে আসলে বা কেউ তাদের নজরে আনলে উচ্চ আদালতের নির্দশনা এবং শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শ্রম দপ্তরকে মনে রাখতে হবে ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা  উপেক্ষা করা হলে সেটা আদালত অবমাননা হিসাবে পরিগনিত হবে এবং এর দায় শ্রম দপ্তরকেও নিতে হবে।

উপসংহার: আইন মানলেই গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকবে

ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন কেবল একটি প্রশাসনিক কাজ নয়— এটি শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার বাস্তব রূপ। শ্রম আইন, গঠনতন্ত্র, আদালতের নির্দেশনা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে।

অন্যথায়, নেতৃত্বের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, শ্রমিকদের আস্থা বিনষ্ট হবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন দুর্বল হয়ে পড়বে। বলা বাহুল্য দালালী, পেশী শক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবসা, দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির কারনে বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন ইতিমধ্যে ইমেজ সংকটে রয়েছে। সুতরাং শ্রমিক আন্দোলনের ইমেজ পুনরুদ্ধার করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শ্রমিকের সংগঠন শ্রমিকের দ্বারা, শ্রমিকের জন্য এবং শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণেই চলবে। এর ব্যত্যয় হলে শ্রমিক আন্দোলন পথ হারাবে।

সুতরাং, ট্রেড ইউনিয়ন দখল নয়— আইন, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।

(লেখকঃ শ্রম আইন বিশ্লেষক, টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক এবং বিলসডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)