বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (৩): মত ও পথ

-বিজন সাহা  

কয়েকদিন আগে সেভার সাথে বেড়াতে গেলাম নিস্কুচনি সাদে। এটা মস্কো নদীর দক্ষিণ তীরে এক বিশাল পার্ক। এক দিকে পার্ক কুলতুরি, অন্য দিকে ভরোবিওভি (লেনিনস্কি) গরি। নিস্কুচনি সাদ আসলে পার্ক কুলতুরির অংশ।  ওদিকে আমরা প্রায়ই হাঁটতে যাই, তবে সেদিন ছিল কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরা। কয়েক দিন আগে ক্রিস্টিনা যখন মস্কো এসেছিল, ওরা গেছিল সেদিকে আর একটা গাছের ছবি পোস্ট করেছিল। গাছের শেকড় ছিল দেখার মত। তখনই ঠিক করি ওর ছবি তুলতে হবে। তাই আমি আর সেভা তাইনাকে (তাইনা সেভার কুকুর, ছোট্ট, তাই সাধারণত ওর ঝোলায় বসে শহর ঘুরে বেড়ায়। আমরা ওর নাম রাখি তাইকা, এটা সেভার আগের কুকুর আইকার অনুকরণে। আইকা বৃদ্ধ, অসুস্থ, যেকোনো সময়ে মারা যেতে পারে তাই ঐ ব্যবস্থা। আইকা মারা গেলে সেভা অনেকদিন কাউকে নিতে রাজি হয়নি। এখন তাইনা ওর সর্বক্ষণের সাথী) নিয়ে চললাম সেই গাছের উদ্দেশ্যে। রবিবার। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। বিশেষ করে দীর্ঘ শীতের পরে যখন গরম পড়েছে, তাপমাত্রা ২০ ছাড়িয়ে গেছে। প্রাণোচ্ছল মস্কো। কেউ ঘুরছে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঘুরছে দল বেঁধে। কেউ সাইকেলে, কেউ বা স্কুটারে করে সোঁ সোঁ করে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। এই এক নতুন বিপদ। আজকাল কত লোক যে আহত হয় এই সব ইলেক্ট্রো স্কুটার চালকদের আঘাতে। এদের অধিকাংশই বাচ্চা। এ নিয়ে সমাজে এখন বিশাল বিতর্ক। এসব বন্ধ করা উচিৎ নাকি কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। আমাদের ছাত্রজীবনে এসব ছিল অনেকটা ভূতুরে জায়গা। যখন লেনিনস্কি প্রস্পেক্ট হয়ে আসতাম তখন পার্ক কুলতুরি ঢুকতাম এই সাদ দিয়ে। তাহলে আর টিকেট কাটতে হত না, ১০ বা ১৫ কোপেক বেঁচে যেত। সেই সময়ে ১০ বা ১৫ কোপেকের বেশ দাম ছিল। শায়েস্তা খানের আমলের মত না হলেও বর্তমানের মাপে খুব কম ছিল না। এখন অবশ্য পার্ক কুলতুরিতে ঢুকতে পয়সা লাগে না। ও হ্যাঁ, পার্ক কুলতুরি মানে গোর্কি পার্ক। কুলতুরা হল কালচারের রুশ শব্দ, আর পার্ক কুলতুরি মানে কালচারাল পার্ক। এই পার্ক রুশ ও সোভিয়েত লেখক মাক্সিম গোর্কির নামানুসারে। বিদেশীদের কাছে তাই গোর্কি পার্ক নামেই পরিচিত। যাহোক নিস্কুচনি সাদ সোভিয়েত আমলে আজকের মত এতো সাজানো গোছানো ছিল না। এটা হয়তো সোভিয়েত আমলে পরিচর্যার অভাবে। অথবা হতে পারে আমি নিজে ঠিক এমন করে ঘুরে  বেড়াইনি এদিকটায়। এই বাগান তৈরি করেন নিকিতা ত্রুবেৎস্কই ১৭২৮ সালে। ধারণা করা হয় যে তিনি এখানে বিভিন্ন ধরণের আনন্দ উৎসবের আয়োজন করতেন যা থেকে এটা নিস্কুচনি সাদ নাম পায়। আক্ষরিক অর্থে নিস্কুচনি মানে বোরিং বা বিষণ্ণ নয়। সেই সময় এখানে তাদের বাগান বাড়ির সামনে ছিল বিভিন্ন ধরণের রাস্তা, গোলকধাঁধা ইত্যাদি। পরবর্তীতে গলিৎসিন ও অরলভ ফ্যামিলিও এখানে বাগান বাড়ি তৈরি করেন। ১৮২৬ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাই এই এস্টেটগুলো কিনে রাজ পরিবারের গ্রীষ্মকালীন বাড়ি তৈরি করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ক্রেমলিনের অদূরে অবস্থিত নিস্কুচনি সাদ রুশ দেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে মস্কোর বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার মত নিস্কুচনি সাদ নতুন আঙ্গিকে জনসম্মুখে আসছে। এখন চারিদিকে  সুন্দর সুন্দর রাস্তা, বিশ্রাম নেবার জন্য এখানে সেখানে বেঞ্চি, ওঠা নামার সিঁড়ি, সাইকেল ও স্কুটার চলার রাস্তা। আছে কৃত্রিম হ্রদ যেখানে পাখিরা আপন মনে সাঁতার কাটছে। আছে দোকানপাট, থিয়েটার। এখানে সেখানে মিউজিক বাজছে, কোথাও শিল্পীরা নিজেরাই গান করছে। সব মিলিয়ে মস্কো এখন সত্যিকার অর্থেই প্রায় আদর্শ এক শহর। মস্কোর কোন কোন হাঁটা পথ ৬০ – ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা যাতে লোকজন চাইলে সাইকেলে করে যাতায়াত করতে পারে। এক কথায় এঞ্জয় করছি আমাদের এই পদ ভ্রমণ। মাঝে মধ্যে মশারা গান শুনিয়ে যাচ্ছে। আর নদীর তীর থেকে ভেসে আসছে নাচ গানের শব্দ। আমরা যে রাস্তা দিয়ে গেলাম আগে সেখানে হাঁটা রাস্তা ছিল বলে মনে হয় না। তখনও সেখানে রেল লাইন ছিল, তবে চলত মূলত মালগাড়ি। এখন মাটির উপর দিয়ে মস্কো সেন্ট্রাল লাইন – খুব জনপ্রিয় লাইন। ওখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা চললাম বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যখন সেই গাছের কাছে এলাম বনে তখন আলো কমে গেছে। একটু অবাক হলাম সেখানে কয়েকটি পেপসির খালি বোতল দেখে। এখানে এসব সাধারণত চোখে পড়ে না। গাছের গায়ে রঙ দিয়ে এটা সেটা লেখা।
– গত পরশু এসব ছিল না। – সেভা বলল।
– হ্যাঁ, এরই মধ্যে কেউ হয়তো লিখে গেছে।
– এই কারণেই আমি এদের পছন্দ করি না। অনেকেই আমাকে সাহায্য করে, আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে, কিন্তু এদের বেশির ভাগ এই রকম। তাই এই দেশের জন্য আমার কিছু করতে ইচ্ছা করে না।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (২): কন্ট্রাস্ট - বিজন সাহা

এটা সেভা রুশ তরুণ সমাজকে উদ্দেশ্য করে বলল।
– আমি চল্লিশ বছরের বেশি হল এদেশে আছি। হাতে গণা কয়েক বার হয়তো খারাপ ব্যবহার করেছে লোকজন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো ব্যবহার পেয়েছি। এই যে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলি, কেউ মেট্রোর দরজা ধরে রাখে অথবা গাড়িতে উঠতে বা নামতে গেলে সরে দাঁড়ায় অথবা অন্য কোন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়  এসব আমরা মনে রাখি না। অথচ এই ছোট ছোট জিনিস দিয়েই সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের সব দেশে খুব কম রাস্তাঘাটই এরকম পরিষ্কার পরিচ্ছিন্ন থাকে। লোকজন ভাবেই না যে রাস্তাঘাট এটা ডাস্টবিন নয়, এখানে চাইলেই ময়লা বা থুথু ফেলা যায় না। উল্টো তারা রাস্তায় আসে নোংরা ফেলার জন্য। তাই দুই এক জনের এরকম কাজ দেখে সমাজ বিচার করলে চলবে? আমরা এর মধ্যে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ হাঁটলাম, ঐ এক জায়গা ছাড়া আর কোথাও তো কোন নোংরা দেখলাম না। অবশ্যই যারা এভাবে নোংরা ফেলে তাদের সমালোচনা করব, তাই বলে পুরো সমাজকে দোষ দিলে তো চলবে না।
– কিন্তু এরা কখনোই ঠিক হবে না,  আজীবন এমনটাই থাকবে।
– না, থাকবে না। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরাও এমনটাই ছিলাম। মনে করতাম প্রচলিত আইন অমান্য করার মধ্যেই সব বীরত্ব, সেটাই বিপ্লব। এরাও তাই। কিছুদিন পরে যখন চাকরি জীবনে ঢুকবে বা সংসার শুরু করবে – সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই যে ঠিক হবে তা নয়, তবে বেশির ভাগ ঠিক হয়ে যায়।
– মনে হয় না। দেখ না ওরা কীভাবে স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে এত মানুষজন কাউকে গ্রাহ্য করছে না।
– করবে, নিজদের ছেলেমেয়ে হলেই করবে। একমাত্র দায়িত্ব মানুষকে বিনয়ী হতে শেখায়। দায়িত্ব পেয়ে যারা বিনয়ী হতে শেখে না তারা কখনোই ভালো মানুষ, ভালো শাসক হয় না। তবে সমস্যা হল সমাজে মানুষ বিভিন্ন রকমের। সবার নিজের নিজের ভালো মন্দ এবং সবাই নিজেদের সেই কাজে আরও দক্ষ করতে চায়।
– যেমন?
– ভালো ছাত্র আরও ভালো পড়াশুনা করতে চায়, আরও বেশি জানতে চায়। ভালো গায়ক আরও ভালো গাইতে চায়। আবার অত্যাচারী আরও বেশি করে অত্যাচার করতে চায়। ন্যাশনাল হকি লীগে শুধু গ্রেতস্কি বা অভেচকিনরাই খেলে না, খেলে সেই সব খেলোয়াড় যাদের মূল কাজ যেভাবেই হোক অভেচকিনদের আটকে রাখা, খেলতে না দেয়া। এসব তারা করে খেলার আইনের মধ্যে থেকেই। অভেচকিনরা যেমন তাদের গোল করার দক্ষতা বাড়াতে চায়, ওরাও তেমনি অভেচকিনদের খেলতে না দেবার দক্ষতা বাড়াতে চায়। অথবা আজকাল বিভিন্ন ধরণের হ্যাকার – একদিকে কোম্পানিগুলো চায় নিজ নিজ কোম্পানির ডিফেন্স শক্তিশালী করতে, হ্যাকাররা অনবরত তা ভাঙে। ভালো মন্দের এই অবিরাম দ্বন্দ্বই আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যায়। তাই খারাপ শুধু খারাপই নয়, খারাপ অগ্রগতির পথে ডোপিং। প্রচণ্ড মসৃণ জায়গা থেকে গাড়ি স্টার্ট নিতে পারে না, দরকার বাধা। সমাজে খারাপ আছে বলেই সেটা বাধা দেবার প্রয়াস আছে। আমরা বিপদে পড়লেই না সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নানারকম পথ খুঁজতে শুরু করি, নাহলে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করি। তাই সমাজে ভালো মন্দ সব ধরণের মানুষেরই দরকার আছে। আসল কথা অনুপাত। সমাজে যখন খারাপ বা অসামাজিক মানুষের পরিমাণ একটা নির্দিষ্ট অনুপাত ছাড়িয়ে যায় তখনই বিপদ। তাই আমরা নিজেরাই নিজের জায়গায় ভালো বা সৎ থেকে সেই অনুপাত ধরে রাখতে পারি, সমাজকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করতে পারি, সমাজের উন্নয়নে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারি। নিজে ভালো থাকা, নিজের কাজ ভালো ভাবে করা এসব শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও। মানুষ সমাজের অংশ, দেশের অংশ। একে অন্যের পরিপূরক। দেশ ভালো না থাকলে মানুষ ভালো থাকতে পারে না আবার মানুষ ভালো না থাকলে, মানুষ ভালো না হলে দেশও ভালো হতে পারে না। বছর খানেক আগে আমাদের দেশে এক শাসক ছিলেন। সে সময় লোকের কাজ ছিল, দেশে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন হয়েছিল, কিন্তু দেশে সুস্থ্য রাজনীতি ছিল না। ফলে মানুষের মনে সুখ ছিল না। সেই শাসককে তাড়িয়ে নতুনদের বসিয়েছে মানুষ। এরা নিজেরা এখনও নিজেদের ভালো শাসক হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি। ভাঙ্গায় ওস্তাদ হলেও গড়তে পারছে না কিছুই। আবার মানুষ আগের মতই, এমনকি আরও বেশি অসুখী। পেটে ভাত যেমন দরকার তেমনি দরকার ন্যায় বিচার। তারা একে অন্যের পরিপূরক কিন্তু প্রতিস্থাপক নয়। মানুষ প্রায়ই একটি পাবার জন্য এতটাই ব্যাকুল হয়ে পড়ে যে আবেগে ভেসে অন্যটি বিসর্জন দেয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো