চলমান সংবাদ

সম্পাদকীয়: মাইলস্টোনে বেদনার অগ্নিকাণ্ড — প্রশ্ন, শোক ও প্রত্যয়ের মুহূর্ত

বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি শোকাবহ দিন অতিবাহিত হলো। গতকাল মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় দেশের মানুষ হতবাক, শোকস্তব্ধ ও প্রশ্নাতুর। রাজধানীর অদূরে একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে “মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ”-এর ওপর পড়ে। আগুনে পুড়ে অল্প সময়েই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ২০ জন কোমলমতি শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

এই দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় বেদনার এক গভীর ক্ষত হয়ে থাকবে। শিশুদের মৃত্যু, একটি স্কুলের ছিন্নভিন্ন চিত্র, নিঃশেষিত স্বপ্ন আর কাঁদতে কাঁদতে অসহায় হয়ে পড়া অভিভাবকদের দৃশ্য আমাদের হৃদয় ছিঁড়ে দেয়। এই শোকের মুহূর্তে কেবল গভীর সমবেদনা জানানোই যথেষ্ট নয়—এই দুর্ঘটনার দায় কে নেবে, এবং কিভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যাবে, তা এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

আমরা জানতে চাই—কীভাবে ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল করার অনুমতি দেওয়া হলো? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এই বিষয়ে আগে কখনও সতর্ক হয়নি? কেন শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নে এত উদাসীনতা? রাষ্ট্রের উচিত দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শনাক্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা। পাশাপাশি দেশের সব প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের নিরাপত্তাব্যবস্থা পূনর্মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই ভয়াবহ দুঘটনার মধ্যে তিনটি মানবিক দৃষ্টান্ত জাতিকে কিছুটা হলেও আলোকিত করেছে। এক শিক্ষিকা মাহেরিন, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে ২০ জন শিশুকে আগুন থেকে উদ্ধার করেন—এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর একটি শিশু, আগুনে ঝলসে যাওয়া অবস্থায় তার বন্ধুর কাছে গেলে সে বলে, “তুমি আসবে আমি জানতাম”—এ যেন অমানুষিক বাস্তবতার মাঝেও বন্ধুত্বের এক অসীম সৌন্দর্য। এবং এরপর রক্তদানের জন্য হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা বিশাল মানবশৃঙ্খল—যা আবারও প্রমাণ করে, বাঙালি জাতি কেবল শোক নয়, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার শক্তি দিয়েই সামনে এগিয়ে চলে।

তবে ভালোবাসা দিয়ে প্রতিকূলতা জয় সম্ভব হলেও, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অবহেলা কখনোই ক্ষমাযোগ্য নয়। এই ঘটনার দায় নিরপেক্ষভাবে নির্ধারণ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর যথাযথ পুনর্বাসন, আহতদের উন্নত চিকিৎসা, এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুদৃঢ় নিরাপত্তা পরিকল্পনা—এসবই এখন সময়ের দাবি।

বাঙালি জাতি যেমন ভালোবাসায় অটুট, তেমনি সচেতনও। আমরা চাই, এই শোক হোক জাগরণের হাতিয়ার। মাইলস্টোনের ওই পোড়া দেয়ালে যেন আগামী দিনের নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণের শপথ লেখা থাকে।