চলমান সংবাদ

আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলন ২০২৫ ও বাংলাদেশের শ্রম বাস্তবতা: একটি মূল্যায়ন

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বিশ্বের শ্রমখাত সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক সম্মেলন, আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলন (International Labour Conference – ILC), ২০২৫ সালের ২ থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত জেনেভায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) ১৮৭টি সদস্য রাষ্ট্রের সরকার, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। এবারের সম্মেলনে শ্রমিকদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে এমন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কর্মস্থলে জৈব-ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা, প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা, অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আনুষ্ঠানিক শ্রম ব্যবস্থায় উত্তরণ, এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মানোন্নয়ন।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির বাস্তবতা মূল্যায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার সম্মিলন

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। গার্মেন্টস, নির্মাণ, কৃষি ও প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানে জাতীয় অর্থনীতির বড় একটি অংশ পরিচালিত হয়। তবে শ্রমখাত এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—বিশেষত ব্যাপক অনানুষ্ঠানিকতা, নিম্ন মজুরি, কর্মস্থলের নিরাপত্তাহীনতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে নানা প্রতিবন্ধকতা লক্ষণীয়।

বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই বিশাল জনগোষ্ঠী সামাজিক সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা থেকে প্রায় পুরোপুরি বঞ্চিত।

ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের অধিকার

ILO-এর কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে, শ্রমিকদের সংগঠন গঠন ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই এই অধিকার চর্চায় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। শিল্পকারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিলে নেতাদের উপর শারীরিক নির্যাতন, হয়রানি, ছাঁটাই বা এমনকি গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয়। ফলে শ্রমিকদের গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা

২০২৫ সালের সম্মেলনে কর্মস্থলে জৈব-ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনা হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বিশেষত জাহাজ ভাঙা শিল্প, চামড়া শিল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের জন্য। এসব খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুরক্ষার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি।

কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি

নারীর কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ বাড়লেও, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি এখনও একটি গুরুতর সমস্যা। ২০০৯ সালের হাইকোর্ট নির্দেশনা, ২০২২ সালের শ্রম বিধিমালার সংশোধন ও ২০১৯ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন কিছুটা প্রতিকার দিলেও অধিকাংশ কর্মস্থলে এখনও অভিযোগ করার সুরক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ফলে নারীরা মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য আজও সংগ্রাম করছেন। আইএলও কনভেনশন ১৯০ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এখনো অনুস্বাক্ষরিত না হওয়া খুবই হতাশার এবং দুঃখজনক।

পড়ুন:  ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে আইএলও'র বিদায়ী কান্ট্রি ডিরেক্টরকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা উপহার

প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি ও নতুন চ্যালেঞ্জ

এবারের সম্মেলনে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিতে শোভন কাজের বিষয়টি প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসছে। বাংলাদেশে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি ও অন্যান্য গিগ-ওয়ার্কাররা এখনও শ্রম আইন ও সামাজিক সুরক্ষার আওতার বাইরে। তাদের জন্য নেই নির্ধারিত মজুরি, কাজের সময়ের সীমা বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা।

কী করা প্রয়োজন?

  • শ্রম আইন সংস্কার: শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং শ্রম আইনকে ILO কনভেনশন তথা আন্তর্জাতিক শ্রমমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

  • পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা: প্রতিটি শিল্পখাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে জাহাজভাঙা, স্টিল-রিরোলিং মিল ও নির্মাণ খাতে।

  • নারীর জন্য নিরাপদ কর্মস্থল: যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রতিটি কর্মস্থলে কার্যকর কমিটি গঠন ও যথাযথ অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

  • অনানুষ্ঠানিক খাতের রূপান্তর: অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ক্রামান্বয়ে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এনে ধাপে ধাপে আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

  • গিগ-ওয়ার্কারদের স্বীকৃতি: তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা ও কাজের শর্তাবলির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

ILO-র ১১৩তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করছেন—যা শ্রমিকদের জন্য একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল দেশের শ্রম খাতের বাস্তব চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। একটি ন্যায্য, নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন কর্মপরিবেশ গঠনে তারা যেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন—এটাই সময়ের দাবি।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)