মতামত

স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া জীবন: রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

-ফজলুল কবির মিন্টু

১২ বছর আগে ধসে পড়া সেই ভবনের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে ছিল শুধু শ্রমিকদের দেহ নয়, চাপা পড়েছিল তাদের স্বপ্ন, মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকারের দাবিও।
২৪ এপ্রিল ২০১৩, সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যায় হাজারো শ্রমিকের জীবন। ইতিহাসের ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত এই ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু হয় অন্তত ১১৭৫ জনের, আহত হন আরও দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। যারা বেঁচে ফিরেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন শারীরিক পঙ্গুত্ব, মানসিক ট্রমা ও আর্থিক দুঃসহতা।

আজ, ২০২৫ সালের এই দিনে—এক যুগ পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিচার আজও হয়নি। দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা তো দূরের কথা, অনেক মামলাই থমকে আছে আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতায়। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতা আর বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি শ্রমজীবী মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে এক গভীর হতাশার নাম।

এই এক যুগে বহুবার প্রতিশ্রুতি এসেছে—ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, নিরাপদ কর্মপরিবেশের আশ্বাস। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বহু পরিবার এখনো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়নি। আহত শ্রমিকদের অনেকে চিকিৎসা ব্যয় বহনে অক্ষম, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও প্রায় অনুপস্থিত।

রানা প্লাজার মতো ঘটনা একবার ঘটলেই তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা কি তা পেরেছি?
রানা প্লাজার পরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে আরও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা ঘটেছে—নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, সীমা অক্সিজেন কারখানার ট্র্যাজেডি—সবই দেখিয়ে দেয়, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ এখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

২০২৩ সালে চালু হওয়া ‘এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম’ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে বাস্তবতায় এই স্কিম কতটা কার্যকর হয়েছে, সেই প্রশ্ন এখনো বহাল। শুধু পোশাক খাত নয়, এই স্কিমের আওতা বাড়িয়ে জাহাজভাঙা শিল্প, স্টিল ও রিরোলিং মিলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ খাতে প্রসার ঘটানো জরুরি।

পড়ুন:  রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্তি -টিইইউসি’র মোমবাতি প্রজ্বলন ও প্রতিবাদের প্রতিজ্ঞা

একটি জাতির বিবেকের প্রশ্ন

রানা প্লাজার শহীদদের স্মরণ করা মানে শুধু শোক প্রকাশ নয়—এটি একটি জাতির আত্মজিজ্ঞাসা। শ্রমিকদের নিরাপত্তা কি এখনো আমাদের অগ্রাধিকারে আছে? নাকি আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এইসব মৃত্যুকে খবরে পড়ে একদিন দুঃখ করে ভুলে যেতে?

শ্রমিকদের রক্ত আর কান্না যেন আর কোনো ভবন ধ্বংসের নিচে চাপা না পড়ে। আমরা যদি এই এক যুগ পরেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি, তবে এই ব্যর্থতা শুধু রাষ্ট্রের নয়—সমগ্র সমাজের।

শ্রমিকের জীবন, মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লড়াই থেমে গেলে রানা প্লাজার মতো আরেকটি ট্র্যাজেডির সম্ভাবনা কখনোই দূর হবে না।
এই ধ্বংসস্তূপে জন্ম নেয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা এখনো দিতে পারিনি—তবে দিতে হবে, দিতেই হবে।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)