বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৯১): আতঙ্ক

-বিজন সাহা

এক কবি বন্ধু আতঙ্ক নিয়ে খুব সুন্দর এক কবিতা লিখেছে। দুই লাইনে দেশের অবস্থা এত সুন্দর করে মনে হয় শুধু কবিতাতেই প্রকাশ করা যায়। আমি একটু ঠাট্টা করেই মন্তব্য করলাম – আতঙ্ক অনেকটা শাঁখের করাতের মত – সতর্ক করে বাঁচায় আর ভয় দেখিয়ে মারে। আসলেই তাই। ভয় আছে বলেই আমরা সাবধানে থাকার চেষ্টা করি আবার এই ভয়েই কারণেই দু’বেলা মরার আগেই মরে যাই। সমস্যা হয় তখন এই ভয়, এই আতঙ্ক যখন বাতাসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, সময় যায় কিন্তু ভয় যায় না। কারণ কারো উপর ভরসা করার কোন জায়গা নেই। আর ভরসা করার জায়গাটা যখন হারিয়ে যায় সাধারণ মানুষের খুব বেশি কিছু আর থাকে না যাকে অবলম্বন করে সে শান্তিতে বাঁচতে পারে। দেশে বিদেশে সরকারই সেই ভরসার জায়গাটুকু দেয়। কিন্তু আমাদের অভাগা দেশে সরকারই মনে হয় সবার আগে সেই জায়গাটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। কেন? কারণ সে নিজেই এখন ভীত, সন্ত্রস্ত। আমার তো মনে হয় বর্তমান সরকারের যারা স্টেক হোল্ডার তারা যদিও আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার বাস্তবে রাষ্ট্র উল্টো হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস হয় না? বাংলাদেশের হিন্দুদের মূল বৈশিষ্ট্য হল নিজেদের বাঁচাতে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার অক্ষমতা। তারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না করে আক্রমণকারীদের দয়ার উপর নিজের ভাগ্য ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এই মুহূর্তে ঠিক তাই করছে। রাষ্ট্রের কাঠামো যারা ধ্বংস করছে তাদের প্রতিরোধ তো করছেই না, উল্টো তাদের উপর ছেঁড়ে দিয়েছে নিজের ভবিষ্যৎ। গণ ধোলাই, গণ ধর্ষণ এসব আজ বাংলাদেশের দৈনন্দিন চিত্র। আর যারা এসব করছে রাষ্ট্র তাদের কাছে অসহায়। রাষ্ট্রের এই চেহারা হিন্দু সহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চেহারা থেকে আলাদা নয়। তাই সংবিধানে যাই লেখা থাকুক না কেন চারিত্রিক ভাবে রাষ্ট্র এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের এবং একমাত্র রাষ্ট্রেরই আছে প্রজাদের সাজা দেওয়া বা বিচার করার মনোপলি। কিন্তু কী হচ্ছে দেশে? কয়েক জন তরুণ সমন্বয়ক নিজেদের খুশি মত মব ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে জনগণকে ঠ্যাঙ্গাচ্ছে।

আচ্ছা জুলাই আগস্টে এই যে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো – তারা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিল? আমার যতদূর মনে পড়ে এমনকি অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা উন্নতির পরেও সাধারণ মানুষ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য রাস্তায় নেমেছিল ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী ও অর্থ পাচারকারীদের কারণে, বিচারের অভাবে। আমার তো মনে হয় দেশে হেলমেট শব্দ Hell Mate মানে নরকের সখা থেকে এসেছে। একটু পেছনে ফিরলে দেখব এরা কারা। বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন লেখায় বলেছি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ চারিত্রিক ভাবে জামায়াত শিবির হয়ে যাচ্ছে। আজ দেশের সরকার ডি ফ্যাক্টো জামায়াত শিবির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস যে বলতে হচ্ছে – জামায়াত শিবির আজ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ হয়ে যাচ্ছে। যে অন্যায় অত্যাচার, যে আইনহীনতার, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে সরকার ফেলানো হল আজ সেই সবই নতুন করে বিকশিত হচ্ছে বহু গুণ বর্ধিত কলেবরে। আমরা অথবা বলতে পারেন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জোর গলায় আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার চাইছে। আমরাও তা চাই। কিন্তু সেটা করতে হলে তো সেই সময় যারা হেলমেট বাহিনী গঠন করেছিল, তার কলকাঠি নেড়েছিল তাদের বিচারও করতে হবে। এই সরকার কি সেটা চায়? ফেসবুকে বর্তমান সমন্বয়কদের অনেকেরই  পুরানো দিনের বিভিন্ন ভিডিও দেখা যায়। কোথাও তারা বঙ্গবন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ আবার কোথাও শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে দিচ্ছে চারপাশে মীরজাফরদের উপস্থিতি সম্পর্কে। এখন বোঝা যাচ্ছে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে হেলমেট বাহিনী তৈরি করে ভেতর থেকে আওয়ামী লীগের ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়াই ছিল এদের উদ্দেশ্য। এ কথা তারা নিজেরাই বুক ফুলিয়ে বলছে। কথা হল মীরজাফরের নিজেরও সেই প্ল্যান থাকতেই পারত এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি বাংলার নবাবও হয়েছিলেন, যেমন এ কাজে সফল হয়েছিলেন খন্দকার মুশতাক। এরপরেও বাংলার মানুষ তাদের ক্ষমা করেনি। তাহলে সমন্বয়কদের ক্ষেত্রেই উল্টো ঘটবে কেন? কেন একই অপরাধে অপরাধী হয়েও তারা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে? ধরলাম জুলাই আগস্টের বিপ্লবীদের জন্য ইন্ডিমিটি বিল পাশ করা হয়েছে। কিন্তু সেটা তো কাউকে এই সময়ের আগের অপরাধ থেকে মুক্তি দেয় না। আজ যদি লাকি আক্তার সহ শাহবাগীদের বিরুদ্ধে মামলা দাড় করানোর দাবি আসে, একই দাবি কেন ওঠে না আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে ডুব দিয়ে থাকা এসব বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে? তাছাড়া এ প্রশ্নও করা জরুরি যে মব কারা। তারা কি সাবেক হেলমেট বাহিনী? হাসিনা আমলে যারা ছাত্রলীগের ভেতরে ঢুকে বিরোধীদের পিটিয়েছে, ছাত্রলীগের জন্য দুর্নাম কুড়িয়েছে, আজ তারাই কি মব হয়ে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চড়াও হচ্ছে না? মনে রাখবেন দেশ যখন আইনহীনতা নামক মহামারিতে আক্রান্ত তখন কেউই নিরাপদ নয়। আপনি, আমি কেউই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারব না। কারণ সবসময়ই আপনার চেয়েও শক্তিশালী কেউ বেরিয়ে আসবে আর জোর যার মুল্লুক তার তত্ত্বে আপনার উপর ছড়ি ঘুরাবে। তাই সময় থাকতে সবাইকে নেমে আসতে হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।

স্বৈরাচার কি? এটা কি শুধু যখন আমার মুখ বন্ধ করে রাখা হয়? যখন আমাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়? নাকি আমি যখন একই ধরণের অপরাধে অপরাধী তখন সেটাও স্বৈরাচার? আমরা কেন স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ এসবের সংজ্ঞা শুধু নিজেদের ইচ্ছেমত ও সুবিধামত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করি? আমরা কেন কাজ দেখে কে ভালো আর কে মন্দ সেটা ঠিক করি না? কোন মানুষ ভালো না মন্দ সেটা যাচাই করতে হয় তার কাজ দেখে। অর্থাৎ কাজই নির্ধারণ করে কেউ ভালো না মন্দ। সেই অর্থে আমি বর্তমান সরকারের সাথে বিগত সরকারের তেমন কোন পার্থক্য দেখি না। তারাও ঢালাও ভাবে জনগণের অর্থ খরচ করত, এরাও করছে। তাদের মত এরাও কর ফাঁকি দিচ্ছে বা নিজেদের কর মউকুফ করছে। আজকাল পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আমি প্রায়ই বলি যে সমস্ত কারণে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে খারাপ বলত এখন ঠিক সেই সবই তারা গ্রহণ করছে আর যা কিছু ভালো ছিল তা ত্যাগ করেছে। জানি না নতুন সরকার বিগত সরকারের সার্বজনীন পেনশন থেকে শুরু করে অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী চালু রেখেছে কি না। তবে তারা যে সেই আমলের দমন পীড়ন নীতি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনাও বলত তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে নির্বাচনে আসতে। নতুন দলের নেতেরাও বলে তাদের সাথে একমত হলে নির্বাচন দেবে। শেখ হাসিনা না হয় দেশটাকে তাঁর বাপের মনে করতেন। আপনারা কি মনে করেন? নাকি কওমি জননীর সূত্রে আপনারাও দেশকে নিজের মনে করেন? চাইলে নির্বাচন দেবেন, না চাইলে না। আচ্ছা এই যে আগস্টের আগের বিভিন্ন অপরাধের বিচার করতে চাইছে বর্তমান সরকার, মামলা মোকাদ্দমা করছে, আসামী বানাচ্ছে কিন্তু সেই সময়ে অসমাপ্ত বিভিন্ন মামলা যেমন সাগর-রুনি হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যা, ব্লগার হত্যা এসব নিয়ে কথা বলে না কেন এরা? ডঃ ইউনুস গণতন্ত্রের ধারক বাহক না হলেও গণতন্ত্রের সুবিধাভোগী, আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ক্লিনটন ফান্ডে লাখ লাখ ডলার ডোনেশন দেন, কিন্তু এখন ক্ষমতা পেয়েও নিজের দেশে কেন ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন না? কেন আছিয়াদের মরতে হয় নিজের আত্মীয়দের হাতে? কেন মেয়ের ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করে জীবন দিতে হয় বাবাকে? এসব দেখে মানুষ কেন আতঙ্কে ভুগবে না। কেন মানুষ ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখবে না? তবে একথাও ঠিক যে শুধুমাত্র রাষ্ট্র একা পারবে না নারী বিদ্বেষ, ধর্ষণ এসব অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে। যতদিন পর্যন্ত বিজিত ও অধীনস্থ মহিলাদের উপভোগ করার রীতি সমাজে সঠিক বলে বিশ্বাস করা হবে ততদিন ধর্ষণ থাকবে। কারণ এটা ধর্ষণকে ন্যায্যতা দেবার দলিল। কাদের এরা ধর্ষণ করে? যাদের কোন না কোন ভাবে পরাজিত করতে পেরেছে, যাদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তাই শুরুটা করতে হবে ঐ জায়গা থেকে। মানে যেহেতু ধর্ষণের পেছনে ধর্মীয় বয়ান আছে তাই শুরুটা করতে হবে ওখান থেকেই। মনে আছে রাজা রামমোহন রায়ের কথা? তিনি যখন সতীদাহ প্রথার অবসানের জন্য লড়াই করছিলেন, তখন ধর্মীয় শাস্ত্রেই তিনি সতীদাহের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রমাণ খুঁজেছিলেন। একই ভাবে একদল লোক যেমন ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে গণিমতের মালের পক্ষে যুক্তি দেয়, একই ভাবে এর বিরুদ্ধে এন্টিডোট সেখানেই খুঁজতে হবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৯২): একটি জন্মদিন ও কিছু কথা- বিজন সাহা

যখন দেশে ছিলাম তখন অনেক সময় বন্ধুদের সাথে ইফতারি করতাম। খুবই সাধারণ আয়োজন থাকত। মুড়ির সাথে সিঙ্গারা, পিঁয়াজি, ছোলার ঘুগনি ইত্যাদি। তবে আমরা যারা রোজা রাখতাম না তারা হোটেল বা টি স্টলে পর্দার আড়ালে ঠিক খেতে পারতাম। এখন প্রায়ই দেখি বিভিন্ন দোকানে হামলা হচ্ছে। তাদের অবশ্য অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের গল্প জানার কথা নয়। রামায়ণ মহাভারতে দেখা যায় তপস্যা ভাঙার জন্য দেবতারা বিভিন্ন খাবার ও অপ্সরাদের পাঠিয়ে দিতেন। গৌতম বুদ্ধ যখন তপস্যারত তাঁকেও নানা ভাবে প্রলোভন দেখানো হয়। রোজা, উপোষ এসব মূলত নিজেকে লোভ থেকে সংযত রাখা। নিজের লোভ সামলানোর জন্য অন্যদের খাবার বঞ্চিত করা কতটুকু ধর্মীয় সেটা ভাবার বিষয়। রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে দেশের নাগরিকের যেমন রোজা রাখার অধিকার বা স্বাধীনতা আছে, তেমনি স্বাধীনতা আছে না রাখার। এই অধিকারে বাধা দেয়া অপরাধ। রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে মৌন থাকার অবকাশ নেই। রাষ্ট্র বাধ্য বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে। যদি না পারে সেই রাষ্ট্র একদিন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

যাক অনেক নেগেটিভ কথা বলা হল। কিছুটা পজিটিভ দিয়ে শেষ করি। এক লোক হাঁটতে হাঁটতে এক সমাধি ক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হল। চারিদিকে শুধু ক্রুশ আর ক্রুশ। এর যেন আর কোন শেষ নেই। জানেন তো ক্রুশ দেখতে অনেকটা যোগ চিহ্নের মত। অনেকক্ষণ ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেঁড়ে সে বলল – জীবনে এ রকম পজিটিভ জায়গা আর দেখিনি।  হয়তো আমাদের নেতারা এত অনাচার, এত ধর্ষণ, এত মৃত্যু দেখেও সেটাই ভাবে। মৃত্যু মানে কম লোক, মানে নিজের ভাগে হালুয়া রুটির পরিমাণ বেশি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো