বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৮৩): সত্যের দাবি   

-বিজন সাহা

বেশ কয়েক বছর আগে সিরিয়ার এক শিশুর জলে পড়ে থাকা মৃতদেহের (!) ছবিতে ছেয়ে গেছিল ইন্টারনেট। এরপর এসেছিল বাচ্চাদের উপর রাসায়নিক আক্রমণের খবর। খুব কম মানুষই আছে যে এসব ছবি দেখে শিউরে ওঠেনি, এজন্য আসাদকে অভিশাপ দেয়নি। পরে অবশ্য জানা গেছে এসবই ছিল নাটক, সিরিয়ার বাচ্চাদের টাকা দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছিল। কোন কিছু না বুঝেই তারা এই নাটকে অংশগ্রহণ করেছিল। এটা করেছিল ব্রিটেন ভিত্তিক এক মানবাধিকার সংগঠন। তবে সমস্যা হল এটা যারা করে তারা জানে তাদের কাজ তাৎক্ষণিক শকের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলা আর তার উপর ভিত্তি করে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা পাশ করিয়ে আনা। এই ঘটনা মোটেই নতুন নয়। হিটলার গত শতকের তিরিশের দশকে রেইখস্টাগে আগুন ধরিয়ে কমিউনিস্টদের উপর দায় চাপিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন চালু করে। আমেরিকা এভাবেই মিথ্যা ছড়িয়ে ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। এ তো গেল বর্তমান যুগের কথা। প্রাচীন কালেও এ ধরণের ঘটনার কথা শোনা যায়, অন্তত মহাকাব্যে। দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করতে না পেরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন “অশ্বত্থামা হত।” যদিও “ইতি গজ” বলে এটাকে সত্যতা দেবার চেষ্টা করেন, তবে সেটা ঢাকঢোলের ডামাডোলে হারিয়ে যায়। এ জন্যে তাঁকে ক্ষণিকের জন্য হলেও নরক দর্শন করতে হয়েছিল। কিন্তু এই ধরাধামে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। অথবা ট্রয়ের যুদ্ধে গ্রীকরা কাঠের ঘোড়া রেখে চলে যায় আর ঘোড়ার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেনারা রাতে ট্রয়ের প্রাচীর খুলে দেয়, পতন হয় ট্রয়ের। তাই যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরণের মিথ্যার আশ্রয় নতুন কিছু নয়। এমনকি ন্যায়ের জন্য যুদ্ধও অন্যায় দিয়ে ভরা। তাই এখানে প্রবঞ্চনা থাকবে এতে যেমন অবাক হবার কিছু নেই আবার একই ভাবে সেখানে যা ঘটে তাকে একমাত্র সত্য ভার্সন হিসেবে মেনে নেবার কিছু নেই। দিনের শেষে ইতিহাস লেখে বিজয়ীরা। তবে ইতিহাস যাতে এক তরফা না হয়, ইহিতাস যাতে সত্য বিবর্জিত না হয় সেটাও আমাদের দেখতে হবে।

স্নায়ু যুদ্ধ পরবর্তী যুগে এ ধরণের ঘটনার শুরু রিগায় যখন পশ্চিমাদের ভাড়াটে স্নাইপার মিছিলে গুলী করে দায় চাপায় সোভিয়েত মিলিশিয়ার ঘাড়ে। মানুষ তখন সব কিছুতেই সোভিয়েত নিরাপত্তা বাহিনীর দোষ দেখার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল। তাই মিথ্যাকে সত্য বানাতে সময় লাগেনি। এখন সেই ঘটনার সাথে জড়িত পশ্চিমাদের অনেকে নিজেরাই এসব তথ্য প্রকাশ করছে। তবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে ইরাক আক্রমণের আগে। জাতি সংঘে কলিন পাউয়েলের টেস্ট টিউবে সাদা পাউডার ঝাঁকিয়ে ইরাকের কাছে ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র আছে এই দাবির ভিডিও দেখেনি এমন লোক পাওয়া কষ্ট। হ্যাঁ, সেই সময় ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ ইরাক আক্রমণ সমর্থন করে। ফলাফল? ইরাক আজ অনেক অনেক পিছিয়ে পড়া এক অঞ্চল (ইচ্ছে করেই দেশ বছি না) যেখানে সুশাসন বা দুঃশাসন বলে কিছু নেই, আছে অরাজকতা। কথা ছিল গণতন্ত্র আসবে, সেই জায়গায় এলো গণহত্যা। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাল, দেশ হারাল, শুধু ইরাক নয়, গণতন্ত্রের বেদীতে প্রাণ দিয়ে সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য ডুবে গেল লাখ লাখ মানুষের রক্তবন্যায়।

এখানেই শেষ নয়। সমাজ দুই ভাগে বিভিক্ত জেনেও কিয়েভে আয়োজন করা হল ময়দানের। ইনুকোভিচকে বলা হল মিছিলের উপরে গুলী না চালাতে, অথচ সেই রিগার স্টাইলে মিছিলের উপর গুলী চলল, চালাল অন্য পক্ষ। সরকারি সেনারা চেয়ে চেয়ে দেখল। ইনুকোভিচ পালিয়ে গেল। পশ্চিমা সমর্থনে যারা ক্ষমতায় এলো তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না মানুষের প্রতিবাদ মিছিলে ট্যাঙ্ক উঠিয়ে দিতে।  ক্রিমিয়া স্বাধীন হল, দনবাসে শুরু হল যুদ্ধ যা এখনও চলছে। ইউক্রেন ধ্বংসের পথে। ধ্বংস হয়েছে সে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধ্বংস হয়েছে অর্থনীতি, জোর করে সাধারণ মানুষদের ধরে ধরে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফার বলি হতে। প্রাণ হারাল  মালয়েশিয়ার বিমানের শতাধিক যাত্রী। দায়ী করা হল রাশিয়াকে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারল না। উল্টো সমস্ত ফ্যাক্ট বলল এটা ইউক্রেনের কাজ। ধামাচাপা দেয়া হল সেই তদন্ত, যেমন ধামাচাপা দেয়া হল নর্থ স্ট্রীমের তদন্ত। ২০১৪ সালে রাশিয়া কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলে যখন ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসল ও রাশিয়া সৈন্য সরিয়ে আনল, সাজানো হল বুচার নাটক। বিশ্বকে দেখানো হল রাশিয়ার সহিংসতা। কিন্তু আবারও প্রমাণ ছাড়া। রাশিয়া আজও সেই ঘটনার তদন্ত চেয়ে উত্তর পাচ্ছে না। তদন্তের দরকার নেই। দরকার নেই সত্য প্রতিষ্ঠার। দরকার রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমে জনমত সৃষ্টি। হয়েছিল। মারিওপলে নাটক করা হল। দেখা গেল সেই মহিলা ইউরোপে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ভিডিও সেশনে অংশগ্রহণ করার পরে। এর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার  খায়েশ এতটুকু কমল না ইউরোপের। কিন্তু কী মূল্যে? ইউক্রেন আজ কোথায়? কোথায় ইউরোপের অর্থনীতি? এখানেই কি শেষ?

দেশে জুলাই আগস্টের ঘটনায় কত জন মারা গেল, কাদের হাতে মারা গেল এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন আছে। অনেকেই বলছে সবাই সরকারি দলের কর্মী ও পুলিশের হাতে মারা যায়নি, একটা বড় অংশ মারা গেছে সরকার বিরোধীদের হাতেও। আর পুলিশের মৃত্যু যে আন্দোলনকারীদের হাতে ঘটেছে সে নিয়ে তো কোন প্রশ্ন নেই। এমনকি প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র সচিব এই প্রশ্ন তুলে বদলী হলেন। কিছুদিন আগে কোন কোন বিপ্লবীরা তো প্রকাশ্যে ঘোষণা করল অগ্নিকান্ড, পুলিশ হত্যা এ সবই তাদের কাজ বিপ্লবকে সফল করার জন্য। আমার মনে তাই অন্য একটি প্রশ্ন জাগল। সিরিয়া ও ইউক্রেনে বিভিন্ন সময় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের খবর শোনা গেছে, কিন্তু প্রথম কয়েকদিন হৈচৈ করে একটা জনমত সৃষ্টি করে সেসব কারপেটের নীচে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে অনেক ঘটনাই যে মঞ্চায়িত সে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আসল কথা – এফেক্ট তৈরি করা, জনমত গড়া সেটা কিন্তু করতে পেরেছে। আর এসবের পেছনে ছিল ব্রিটেন ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। দেশে আমরা দেখছি অনেক শহীদ বেহেশত থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে – হয়তো আদমের মত ঈশ্বর কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে। জুলাই আগস্টের ঘটনার পেছনে যে আমেরিকা জড়িত তাতে কেউ সন্দেহ করে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখানেও কি সিরিয়া, ইউক্রেন স্টাইলে ফেক হত্যা এবং স্বপক্ষের কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছিল বিপ্লব সফল করার জন্য? বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে তদন্ত করতে হবে, জানতে হবে সত্য কথা – যাতে বাইরে থেকে কেউ সহজে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রভাবিত করতে না পারে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৮২): বিকল্পধারা -বিজন সাহা

আজকাল অনেকেই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে নতুন করে বৈধতা দিতে চায়, বলতে চায় শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন প্রবর্তনের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল দেশকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু প্রশ্ন হল তারা যদি এই হত্যাকাণ্ড বৈধ মনে করত তাহলে ইন্ডিমিটি ল বা নির্দোষতা আইন প্রণয়নের কী দরকার ছিল? আসলে যেকোনো হত্যাই, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অবৈধ। এটা তারা ভালো ভাবেই জানত আর সেজন্যই এই আইনের প্রয়োজন হয়েছিল। চব্বিশের আন্দোলনেও অনেক রক্ত ঝরেছে, ঝরেছে দুই পক্ষের তরফ থেকেই। পরাজিত পক্ষকে দায়ি করে শত শত মামলা দায়ের করা হচ্ছে আর বিজয়ী পক্ষকে ইন্ডিমিটি ল-এর মাধ্যমে বেকসুর খালাস দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পারতপক্ষে এই হত্যাযজ্ঞে নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার করে নিল। আর এ জন্যেই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ বিচার দরকার। একই সাথে আয়না ঘর সম্পর্কেও আমাদের প্রশ্ন তোলা দরকার। বিভিন্ন দেশে এ ধরণের টর্চার সেল থাকে। গুয়ান্টামা এক অতি পরিচিত নাম। বারাক ওবামা নির্বাচনের আগে এটা বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন। সেটা এখনও বন্ধ হয়নি। আয়না ঘরের সম্পর্কে প্রচুর গুজব শুনলেও এর সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায়নি। যদি এ রকম সেল থাকে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী এসব চালনা করেন না, করে সেনাবাহিনীর বা গোয়েন্দা সংস্থার একটি অংশ। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষ থাকে। এরা তো সবাই পালায়নি। তাহলে এ নিয়ে আর কথা হচ্ছে না কেন? দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ সরকারকে এ ব্যাপারে চাপ দিয়ে সত্য উন্মোচন করা। সত্যকে গোপন রেখে বা অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

ফেসবুকে অনেককেই দেখি জামাত শিবিরকে দ্বিচারিতার জন্য গালমন্দ করতে। কিন্তু এরাই স্বৈরাচার হঠানোর বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে জামাত শিবিরের ক্ষমতায় আসার পথ কন্টকমুক্ত করেছে। সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, প্রগতি এসবের নামাবলী গায়ে দিয়ে মৌলবাদী শক্তির উত্থানে সহযোগিতা করা কি দ্বিচারিতা নয়? হলে আত্মসমালোচনা কোথায়? কোথায় অনুশোচনা? যারা এই অভিযোগ আনছে তাদের অনেকেই বাম ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পরীক্ষিত নেতা। যদি তারা বুঝে এসব করে থাকে তাহলে সেটা আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা আর না বুঝে করলে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। তাহলে কি তাদের অধিকার আছে নেতার আসনে বসে থাকার? নিজের কাছে সৎ হোন, রাজনীতি জঞ্জাল মুক্ত করুন। একই কথা বলা যায় তথাকথিত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। যদি রাজনীতি ত্যাগ করতে না চান, যদি সত্যিই নিজেদের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মানবতার সেবক বলে মনে করেন তাহলে জুলাই আগস্টের ঘটনায় সমস্ত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান, বিচারের দাবি জানান সেই সব লোকের যারা বিপ্লবের আগে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পোশাকে বিভিন্ন অসামাজিক কাজের সাথে যুক্ত ছিল। সময় মত দল বদল করে নির্দোষ হওয়া যায় না আর রাষ্ট্রীয় না হলেও নৈতিক ভাবে অপরাধীরা কখনোই সুখী সমৃদ্ধ সমাজ উপহার দিতে পারে না। ভ্যাট নয়, মানুষ ভাত চায়। মানুষের জন্য ভাত কাপড়ের লড়াই জোরদার করুন, যদি তাতে আপনাদের কিছুটা পাপস্খলন হয়।

 

সুখের বিষয় আদিবাসীদের উপর আক্রমণের পরে অনেকেই রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছে। আমার মনে হয় সেটা অনেক আগেই দেয়া উচিৎ ছিল যখন হিন্দুদের উপর, বাউলদের উপর, মাজারের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। প্রতিবাদ করতে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যত বিলম্ব করবেন স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি তত শক্তিশালী হবে। স্বৈরাচার বিরোধী আনদোলনে বিজয়ের ফসল যে হাতছাড়া হয়ে গেছে, তা যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির হাতে উঠেছে তাতে আর সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বাদ দিয়ে সংবিধানের প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। এমনকি দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের কথাও বলা হচ্ছে। দেখবেন ময়লা জলের সাথে বাচ্চাকে ফেলে দেবার মত স্বৈরাচারের সাথে দেশকেও জলে ভাসিয়ে দেবেন না যেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী মস্কোর উপকণ্ঠে এসে পৌঁছুলে রুশ সেনারা স্লোগান দিয়েছিল, পিছু হটার জায়গা নেই, পেছনে মস্কো। আমাদের অবস্থাও তাই। পিছু হটার জায়গা নেই, পেছনে বাংলাদেশ।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো