চলমান সংবাদ

পর্তুগাল: শ্রম শোষণের শিকার ‘ট্যাক্সি’ সেক্টরে কর্মরত অভিবাসীরা

পর্তুগালের ট্যাক্সি খাতে বেড়েছে শ্রম শোষণের ঘটনা। ছবি: লিসবোয়া পরিবহন সার্ভিস।

কয়েক বছর ধরে পর্তুগালে বেড়েছে পেশাদার ট্যাক্সি চালকের সংখ্যা। ইউরোপে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যাত্রী পরিবহন করতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াও আলাদা পরীক্ষা দিয়ে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু দেশটিতে এসব সেক্টরে কর্মরত অভিবাসীরা শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বেশ কয়েক বছরে বিভিন্ন আইনের আওতায় কাজের মাধ্যমে বৈধতা পেতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা পর্তুগালে ভিড় করছেন। যার ফলে অন্যান্য সেক্টরের মতো ট্যাক্সি চালকদের মধ্যেও অভিবাসীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পেশাদার লাইসেন্সকে দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। পর্তুগালে এটিকে টিভিডিই এবং ফ্রান্সে ভিটিসি বলা হয়। এটি পেতে একজন ব্যক্তিকে বৈধ অভিবাসী ছাড়াও নানা শর্ত পূরণ করতে হয়।

কিন্তু অভিবাসীদের বৃদ্ধিকে অপব্যবহার করছেন একদল অসাধু লোক। পাচারকারীদের জালে ধরা পড়ে শোষিত হচ্ছেন অনেক অভিবাসী। এমন ঘটনা ইউরোপের অন্যান্য দেশে থাকলেও পর্তুগালে এই হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। পাচারকারীরা বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ ট্যাক্সি লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে অনিয়মিত অভিবাসীদের এসব কাজে নিয়োজিত করছেন। তারা অভিবাসীদের উপার্জিত অর্থ থেকে একটি অংশ কেটে রাখেন

অভিবাসীদের সাহায্যকারী কর্তৃপক্ষ এবং সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করে বার্তা দিয়েছে।

৭ অক্টোবর মধ্যরাতে রাজধানী লিসবনের পাশ্ববর্তী একটি শহরতলিতে পুলিশের রুটিন তল্লাশির আওতায় পড়েন একজন ট্যাক্সি চালক। গাড়িটির হেডলাইট ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তাকে থামানো হয়েছিল।

গাড়ির চালক একজন নেপালী অভিবাসী। এক পর্যায়ে গাড়ির ভেতরে তল্লাশির সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। গাড়ির ট্রাংক খোলা হলে সেখানে আরেকজন ৩০ বছর বয়সি নেপালি নাগরিককে খুঁজে পায় পুলিশ। তিনি একটি বালিশ ও কম্বল নিয়ে আধো ঘুমে ঠান্ডায় কাঁপছিলেন। ওই সময় আতঙ্কিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় চালককে।

চালক এবং উক্ত অভিবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তারা জানায়, গাড়ির ট্রাঙ্কে থাকা ব্যক্তিটিও একজন অভিবাসী চালক। উভয়ই পাচারকারীদের দেয়া একই লাইসেন্স ভাগ করে শিফট ভিত্তিতে গাড়ি চালান। লাইসেন্সটি তাদের নয়।

এই দুই অভিবাসীর মধ্যে একজন গাড়ি চালানোর সময় অন্যজন গাড়ির পিছনে বিশ্রাম নেন। এভাবে পুরো রাতজুড়ে সময় ভাগ করে ট্যাক্সি চালান তারা।

ভুক্তভোগী দুইজন কর্তৃপক্ষকে জানান, প্রায় ছয় মাস আগে তারা একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পর্তুগালে এসেছেন। তারা স্পেনের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট করে পর্তুগালে পৌঁছেছিলেন।

জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বে থাকা লিসবন অঞ্চলের পুলিশ সদস্য লুইস এস ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “তারা আমাদের কাছে তাদের পাসপোর্ট দেখাতে পারেননি। কারণ পাসপোর্ট পাচার চক্রের কাছে রাখা। চুক্তির টাকা ও অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের পর সেগুলো অভিবাসীদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।”

তিনি আরও বলেন, “এটি পাচারকারীদের ব্যবহৃত একটি পুরনো পরিচিত পদ্ধতি। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ এই লোকেদের নিয়মিত অভিবাসীদের মতো কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই। তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করেন এবং তাদের তথাকথিত বসদের জিম্মিতে থাকেন। এটি একটি ক্রমবর্ধমান ঘটনা।”
কর্মরত দুই থেকে আড়াই হাজার অভিবাসী

এই সেক্টরে বর্তমানে লিসবনে দুই হাজার থেকে আড়ায় হাজার অভিবাসী কর্মরত আছেন বলে জানিয়েছে একটি বেসরকারি সূত্র। চালকেরা প্রধানত ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের নাগরিক। এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মলদোভা, সেনেগাল ও গিনি থেকে আসা অভিবাসীরাও আছেন তালিকায়।

বিভিন্ন এনজিও ও অভিবাসন সংস্থার মতে, “বর্তমানে বৃহত্তর লিসবন অঞ্চল এবং এর আশেপাশে দুই হাজার থেকে আড়ায় হাজার অভিবাসী এই পেশায় কাজ করছেন। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোর্তোতে আছেন ৭০০ থেকে ৮০০ লোক।”

লিসবন শহরে কর্মরত সোশ্যাল ওয়ার্কার বা সমাজকর্মী আন্তোনিও সিলভা বলেন, “প্রতি সপ্তাহে অসুবিধায় থাকা প্রায় ২০ থেকে ৩০ অভিবাসী আমাদের কাছে তাদের সমস্যার কথা জানান। যাদের অনেককেই খুব কম বেতন দেওয়া হয় এবং দীর্ঘ ঘন্টা কাজ করতে হয়। এটি খুবই উদ্বেগজনক। আমরা কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত এসব সমস্যা রিপোর্ট করি। অনেক সময় আমরা অসহায় বোধ করি।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন ,

ভুক্তভোগীদের মধ্যে বড় একটি সংখ্যক অভিবাসীর ঘটনা প্রায়ই একই। তাদের পাচারকারীরা তাদের পাসপোর্ট জব্দ করে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবৈধভাবে স্পেন অথবা ফ্রান্স হয়ে পর্তুগালে নিয়ে আসে। তাদেরকে অন্যান্য অভিবাসীদের সাথে অস্বাস্থ্যকর অ্যাপার্টমেন্টে রাখা হয়।

আন্তোনিও সিলভা বলেন, “আমাদের কাছে এমন অনেক লোক আসেন যারা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন চিকিৎসার সুযোগ পায় না। এমনকি তারা পাচারকারীদের দেনা শোধ করতে দিয়ে সারাবছর কাজ করতে থাকেন। বছরের খুব কম দিনই তারা ছুটি কাটাতে পারেন।”
পাচারকারীদের হাতে জিম্মি অভিবাসীরা

ভারত থেকে এসেছেন অভিবাসী অনিল (ছদ্মনাম*)। বয়স ত্রিশের কোঠায়। তিনি দেশ থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি নিয়ে ১৮ মাস আগে ইউরোপে এসেছিলেন।

প্রথমে ইটালিতে পাঁচ মাস ছিলেন পরে পাচারচক্রের মাধ্যমে পর্তুগালে আসেন। দেশটিতে আসার আগেই চক্রটি তাকে লিসবনে ট্যাক্সি বা ভিটিসি ড্রাইভার হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

কিন্তু তরুণ ভারতীয়র এই স্বপ্ন দ্রুত মোহভঙ্গে হয়। তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আমি খুব উৎসাহী ছিলাম। ইউরোপে আসতে আমি প্রায় ১০ হাজার ইউরো এবং পর্তুগালে আসতে আরো অতিরিক্ত দুই হাজার ইউরোর ঋণ করেছিলাম।”

অনিল আরো যোগ করেন,

আমি ইটালিতে বেশ কষ্টে ছিলাম। আমি রোম অঞ্চলে থাকতাম। যে ব্যক্তি আমাকে ইউরোপে আসতে সাহায্য করেছিল সে একদিন আমাকে দেখতে এসে জানায় ‘আমার কাছে আপনার জন্য একটি সমাধান আছে। তবে আমাদেরকে এখান থেকে পর্তুগালে যেতে হবে।’ আমি তখনই তার প্রস্তাবে হ্যাঁ বলেছিলাম। আমি খুব খুশী হয়েছিলা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে আমি বুঝতে পারি যে আমি প্রতারিত হয়েছি।

প্রকৃতপক্ষে, আরো নয় জন ট্যাক্সি চালকের সাথে অনিলকে একটি অস্বাস্থ্যকর অ্যাপার্টমেন্ট রাখা হয়। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন তার বেতন প্রসিশ্রুত অর্থের চেয়ে অনে কম। দালালেরা তার পাসপোর্ট জব্দ করে।

এক পর্যায়ে নিজেকে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন অনিল। লিসবনে আসার পর পাচারকারীদের দেয়া ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। তিনি অনিয়মিত অভিবাসীতে পরিণত হন। বর্তমানে হতাশাগ্রস্ত এই যুবক ভুয়া লাইসেন্সের কারণে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা করছেন।

অনিল বলেন, “ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো খুবই বিপজ্জনক। এটি একটি বিশাল চাপ, কারণ আমরা খুব কম দিনই ছুটি নিতে পারি। যে ব্যক্তি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে আমরা তার করুণার উপর নির্ভর করে বাস করছি। কারণ লাইসেন্স না থাকলে কাজ করতে পারব না।”

আরও পড়ুন: পর্তুগালে মানবপাচারের অভিযোগে আটক ২৮

ইতিমধ্যে অনেক অভিবাসী চালকেরা গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। কারণ চালকেরা ক্লান্ত থাকেন এবং অনেক সময় গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন।

ভারতীয় অভিবাসী অনিল স্মরণ করে বলেন, “একদিন আমি হঠাৎ এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে লিসবন বিমানবন্দর থেকে যাত্রী নিয়ে আসার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। এক পর্যায়ে গাড়ির যাত্রী আমাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করেন। আমি তাকে সব খুলে বললে তিনি প্রায় দুই মাস আগে আমাকে একটি অভিবাসন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন।

সংস্থাটির নাম তোদোস পর আম বা সকলের জন্য। এখানে কাজ করছেন সমাজকর্মী জোসে আন্তোনিও রোসা। তারা অনিলকে বিভিন্ন পরামর্শ ও মানসিক সহায়তা প্রদান করছে। পাশাপাশি তাকে পর্তুগিজ ভাষা শেখার কোর্সও দেয়া হয়েছে। যাদের করে অনিল দ্রুত তার অবস্থার পরিবর্তন করে নিজের অধিকার বুঝে আদায় করে নিতে পারেন।
বিচার বিভাগ ও পুলিশে জনবল সংকট

জোসে আন্তোনিও রোসা বলেন,

এই মুহুর্তে আমরা দুটি কারণে পুলিশের কাছে যাইনি। প্রথমত, পর্তুগালের পুলিশের কাছে বর্তমানে এমন বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। তারা আসলে বুঝতে পারছে না এই ধরনের পরিস্থিতি কীভাবে দ্রুত সমাধান করা যাবে। দ্বিতীয়ত, অনিয়মিত অভিবাসী হওয়ায় ও আরেকজনের লাইসেন্স দিয়ে কাজ করায় অনিলকে গ্রেপ্তার করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার ঝুঁকি আছে।

তিনি বলেন, “এসব কারণে আমরা ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করি। আমরা তার আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অবশ্যই তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে এটি পুলিশ এবং দালালদের সাথে তার নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি না হয়। পাচারকারী নেটওয়ার্কগুলো শক্তিশালী। তারা জানে কীভাবে অভিবাসীদের পরিবারগুলোকে চাপ দিয়ে আক্রমণ করতে হয়। অনিল আর নতুন সমস্যা চায় না। ইতিমধ্যে সে অনেক ঋণে আছে।”

আরও পড়ুন: পর্তুগালে অভিবাসীদের কৃষি খাতে শোষণের হার বাড়ছে

অপরদিকে লিসবনের পুলিশ সদস্য লুইস এস এর মতে, এই ইস্যুতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা মাফিয়া নেটওয়ার্কগুলোর জন্য একটি অনুকূল প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে। আমরা একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আছি। কারণ পুলিশ এবং বিচার বিভাগ অত্যন্ত দুর্বল। এসব প্রতিষ্টানের লোকবল ও বাজেট ঘাটতি প্রকট।”

পর্তুগালের এমন প্রেক্ষাপট অপরাধী গোষ্ঠী এবং পাচারকারীদের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তারা জানে এই প্রক্রিয়াগুলি আদালতের সামনে আনা বেশ সময়সাপেক্ষ।

লুইস এস বলেন, “এ কারণে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। পর্তুগাল পাচারকারীদের কাছে একটি লোভনীয় জায়গা হয়ে উঠছে।”

# মিকায়েল দা কস্তা