চলমান সংবাদ

আসামে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘মিঞাঁ মিউজিয়াম’ সিলগালা করে দিল সরকার

গোয়ালপাড়া জেলার মিঞাঁ মিউজিয়ামটি সিলগালা করা হয়েছে
গোয়ালপাড়া জেলার মিঞাঁ মিউজিয়ামটি সিলগালা করা হয়েছে

ভারতের আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের একটি সংগ্রহশালা বন্ধ করে দিয়েছে সেরাজ্যের সরকার। মাত্র দুদিন আগে খোলা হয়েছিল ‘মিঞাঁ মিউজিয়াম’ নামে ওই সংগ্রহশালাটি।

সরকার বলছে সরকারী প্রকল্পে বাসস্থানের জন্য দেওয়া একটি বাড়িতে ওই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই সেটি সিল করে দেওয়া হয়েছে এবং তিনজন উদ্যোক্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে বাংলাভাষী মুসলমানরা বলছেন তাদের জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার জন্যই ওই মিউজিয়ামটি গড়া হয়েছিল।

আসামের মিঞাঁ কারা?

গোয়ালপাড়ার ‘মিঞাঁ মিউজিয়াম’ নিয়ে আসামের রাজনীতি এখন সরগরম। ডাপকারভিটা গ্রামের একতলা বাড়িটি মোহর আলির। সেখানেই চালু হয়েছিল ওই মিউজিয়ামটি।

পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা বাংলাভাষী মুসলমানদেরই তাচ্ছিল্য করে মিঞাঁ বলা হয় আসামে
পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা বাংলাভাষী মুসলমানদেরই তাচ্ছিল্য করে মিঞাঁ বলা হয় আসামে

পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা, বিশেষ করে ময়মনসিংহ, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চল থেকে যে বাংলাভাষী মুসলমান কৃষকরা আসামে বসতি গড়েছিলেন সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, তাদের মিঞাঁ বলে ডাকে আসামের একটা বড় অংশের মানুষ।

“মিঞাঁটা কোনও কমিউনিটি না। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাংলাভাষী মুসলমানদেরই তাচ্ছিল্য করে মিঞাঁ বলে আসামের মানুষ। বহু বছর ধরেই এটা চলে আসছে। তার ফলে আমাদের মধ্যেও একটা অংশ এখন নিজেদের মিঞাঁ বলে ভাবতে শুরু করেছে,” জানাচ্ছিলেন মিঞাঁ কবি ফারহাদ ভুঁইঞ্যা।

কী কী ছিল ‘মিঞাঁ মিউজিয়ামে?

বাংলাভাষী মুসলমানদের ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রদর্শিত হচ্ছিল মিঞাঁ মিউজিয়ামে
বাংলাভাষী মুসলমানদের ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রদর্শিত হচ্ছিল মিঞাঁ মিউজিয়ামে

ওই মিউজিয়ামে লাঙল, হাল, মাছ ধরার সরঞ্জাম, গামছা, লুঙ্গি ইত্যাদি যেসব দ্রব্য মূলত বাংলাভাষী মুসলমান কৃষকরা ব্যবহার করেন, সেগুলোই প্রদর্শিত হয়েছিল।

কিন্তু বাড়িটি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস প্রকল্পের অধীনে দেওয়া হয়েছিল, তাই সেই বাড়ি বসবাস করা ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না, এই যুক্তি দেখিয়ে সরকার মিউজিয়ামটি বন্ধ করে দিয়েছে।

এই কারণ উল্লেখ করে গোয়ালপাড়ার ডেপুটি কমিশনারের একটি লিখিত নির্দেশ মিউজিয়ামের দরজায় আটকিয়ে ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে প্রশাসন।

কেন মিঞাঁ মিউজিয়াম: প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর

তবে মিঞাঁ মিউজিয়ামটির আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন তুলেছেন খোদ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

“লাঙ্গলটি শুধু মিঞাঁরা ব্যবহার করে? অসমীয়া মানুষও তো লাঙ্গল ব্যবহার করে। মাছ ধরার যে সরঞ্জামটা রাখা হয়েছে, সেটাও তো তপশীলী জাতির মানুষ ব্যবহার করে!গামুসাও ছিল দেখা গেছে – সেটা তো আসামের গামছা। শুধুমাত্র লুঙ্গিটাই ওরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না,” সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মি. বিশ্বশর্মা।

মিঞাঁ মিউজিয়ামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার
মিঞাঁ মিউজিয়ামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সরকারের কাছে তারা এটা প্রমাণ করুক যে লাঙল শুধুমাত্র মিঞাঁরাই ব্যবহার করে, অসমীয়ারা করে না। অসমীয়াদের ব্যবহার্য জিনিষপত্র নিয়ে গিয়ে মিঞাঁ মিউজিয়াম খুলেছে!”

এই মিউজিয়ামের অর্থায়ন কীভাবে হল, সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

‘লুঙ্গি নিয়েই মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার করবে বিজেপি’

কবি ফারহাদ ভুঁইঞ্যা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত নন।

“যদি কেউ নিজেদের কমিউনিটির সামগ্রী সংরক্ষণ করতে চায়, তাকে আমি খারাপ মনে করি না। কিন্তু বিষয়টার রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। কিছু রাজনীতিবিদ আমাদের এই বাংলাভাষী মুসলমানদের ব্যবহার করছে ব্যক্তিগত রাজনীতির স্বার্থে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানরাই আসলে ভুক্তভোগী হচ্ছে আর লাভবান হবে বিজেপি,” মন্তব্য মি. ভুঁইঞ্যার।

'লুঙ্গিটাই ওরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না': মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা
‘লুঙ্গিটা ওরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না’: মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা

তার ব্যাখ্যা, বাংলাভাষী মুসলমানদের পরিধান লুঙ্গি ওই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছিল। লুঙ্গির কথা মি. বিশ্বশর্মাও বলেছেন। আর এই লুঙ্গির প্রসঙ্গ তুলেই বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে শুরু করেছে বিজেপি।

মি. বিশ্বশর্মা মাঝে মাঝেই বাংলাভাষী মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন।

মিঞাঁ কবিতা, স্কুলের পরে মিউজিয়াম

কয়েক বছর আগে মিঞাঁ কবিতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আসামে, আর মি. বিশ্বশর্মা সেই কবিতাগুলি আর তাদের রচয়িতাদের কটাক্ষ করেছিলেন।

সেই প্রসঙ্গ তুলে এনে মি. বিশ্বশর্মা এদিন বলেন, “আমি এর আগে যখন মিঞাঁ কবিতার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, তখন আসামের বুদ্ধিজীবীরা তার সমালোচনা করেছিলেন যে সেটা নাকি সাম্প্রদায়িক কথা ছিল। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে যে প্রথমে মিঞাঁ কবিতা, তারপরে মিঞাঁ স্কুল হল, এখন মিঞাঁ মিউজিয়ামও হয়েছে!”

হিন্দুত্ববাদী এবং অসমীয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো বলে থাকে যে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। যদিও সেই প্রমাণ কখনই সামনে আসে নি।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা