মতামত

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ বিপ্লবের দুই ক্ষণজন্মা ভ্যানগার্ড

-রবি শংকর সেন নিশান

-এক-
“বাস্তববাদী হও, অসম্ভবকে দাবী করো…” বিশ্বব্যাপী তারুণ্য আর যৌবনকে এভাবে আর কেউ চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে কিনা জানা নেই। যিনি পেরেছিলেন তাঁকে ১৯৬৭ সালে আজকের দিনে বলিভিয়ার জঙ্গলে গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। হত্যার পর হাত দুটো কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছিলো তাঁর মৃত্যুর প্রমাণ হিসেবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হর্তাকর্তাদের হৃদয়ে এতোটাই ত্রাসের সঞ্চার করতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর নাম ডা. আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। চে নামেই বেশি পরিচিত। তিনি জন্মেছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার রোসারিও-তে। চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্র ছিলেন। জন্ম আর্জেন্টিনাতে হলেও মার্কসবাদের বিশ্বদীক্ষার আলোকে আদর্শিত হয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বময়। মেক্সিকো, কিউবা, আফ্রিকা অতঃপর বলিভিয়া। নিজেকে সমর্পিত করেছেন শোষিত- নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কাফেলায়। অস্ত্র হাতে যেমন যুদ্ধ করেছেন, তেমনি কলম হাতে নিজের দর্শনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্বও পালন করেছেন দক্ষতা ও সফলতার সাথে। বিপ্লবী মানেই সর্বগুণে গুণান্বিত হতে হয়। যেকোনো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ থাকেনা। চে গুয়েভারা এমনই এক উদাহরণ। চে বলতেন, “বিশ্বের যেকোন প্রান্তে যখনই তুমি কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করো, জেনে রেখো, তুমি আমারই একজন কমরেড..।” এই কথাটাই যেন বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টদের একসুতোয় গেঁথে রেখেছে। আন্তর্জাতিকতাবাদের এমন সহজবোধ্য প্রকাশ আর কোন কমিউনিস্ট নেতা করেননি। হত্যার পর অন্যান্য বিপ্লবীদের মতোই চে আরো শক্তিশালী হয়েছে। চে’র নিজের লেখা বলিভিয়ার ডায়েরী, কঙ্গোর ডায়েরী, দ্য মোটর সাইকেল ডায়েরী পৃথিবীর সমস্ত ভাষায় অনুদিত হয়েছে। গত শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিটি চে গুয়েভারা-ই। যুগ যুগ ধরে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল প্রান্তে সংঘটিত অন্যায়-অত্যাচার, নিপিড়ীত – শোষিত – বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি আজো যেন জ্বলন্ত অগ্নি মশাল। আমাদের বুকে সবসময় জ্বলতে থাকা সেই আদর্শিক অগ্নি মশালের নাম ডা. আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। আমাদের প্রিয় কমানদান্তে..
-দুই-
কমিউনিস্ট আন্দোলন সমাজকে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান ও প্রগতিমুখী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। এই সুস্থ সমাজ গঠিত হয় সমাজের প্রতিটি মানুষের বৈষম্যহীন অংশীদারত্বের শর্তে সমৃদ্ধ অর্থনীতির উপর। পুরোদস্তুর বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিতের মাধ্যমেই বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব বলে সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করে। এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। আবার কোনো বিমূর্ত কিছু নয়। কোনো দেশে বা অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলন সততা এবং নিষ্ঠার সাথে চলতে থাকলে ১০/১২ বছরেই তার দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেখানে রাষ্ট্র, সমাজ বা অর্থনীতির অবস্থা যাই হবে হোক। যে স্তরেই থাকবে থাকুক। এটি একটি কঠিনতম চ্যালেঞ্জিং রাজনীতি বটে। এই চ্যালেঞ্জ কমরেড ফরহাদ গ্রহণ করেছিলেন। এই বাংলাদেশেই সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতার সাথে রাজনৈতিক শক্তির মোবিলাইজেশন-রেজিমেন্টশনের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন তিনি। আশির দশকে হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় রাজনীতির প্রাণপুরুষ। ১৯৩৮ সালের ৫ই জুলাই দিনাজপুর জেলার ক্ষেত্রীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র জীবনে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন “বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন”-এ যুক্ত হন। একেবারে তৃণমূল হতে রাজনীতি শুরু করে অল্পদিনেই যোগ্যতার পরিচয় দেন। পঞ্চাশ দশকে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। এর ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ৬৬ সালে ছাত্র সমাজের ১১ দফা সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। নেপথ্যে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ। ১৯৬৯ সালে ঘটে আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থান। সেই গনঅভ্যুত্থানেরও অন্যতম নেপথ্য নায়ক কমরেড ফরহাদ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল শক্তিকে নূন্যতম ইস্যুতে একত্রিত করে রাজপথে নামিয়ে তিনি শক্তি সমাবেশ কিংবা মোবিলাইজেশনের কাজ করেছেন। আবার নিজের পার্টি-গণসংগঠন সমূহকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে এক শিলা রেজিমেন্টেড পার্টিতে পরিণত করেছিলেন। একের পর এক ধারালো রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে এরশাদ সরকারকে রীতিমতো নাজেহাল করে দিয়েছিলেন। এরশাদ পতন ত্বরান্বিত করেছিলেন। অনেকেই বলেন – বলতেন এদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব নয়, কমরেড ফরহাদ সেখানে প্রতিনিয়ত বলতে থাকতেন, “Socialist Bangladesh… POSSIBLE”. এই সাহসী উচ্চারণ তিনি প্রবাহিত করগে পেরেছিলেন লাখো তরুণ প্রাণের মধ্যে। প্রজন্মের সেই দুঃসাহসিক উচ্চারণের উত্তরাধিকার এখন আমরা। আজও দেশের আনাচে-কানাচেতে সেই সাহসী কন্ঠস্বরকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে যাচ্ছে লাখো প্রাণ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কমান্ডার কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ঠিক একারনেই আজো প্রাসঙ্গিক। ১৯৮৭ সালের ৯ই অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে মস্কোতে আকস্মিক মৃত্যু বরণ করেন। ৪৯ বছর বয়স ছিল সেসময়। অর্ধশত বছরে শতবর্ষের ন্যায় কর্ম সম্পাদন করে গেলেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। ৩. বিশ্বের দুই প্রান্তের দুই কমিউনিস্ট নেতার সাদৃশ্য অনেক। দুইজনেই ক্ষণজন্মা, দুইজনেই বীর গেরিলা কমান্ডার, দুই জনেই বুক ভরা সাহস, অমিত তেজ, চোখেমুখে স্বপ্ন নিয়ে এই বৈষম্যের সমাজ পাল্টানোর কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং সেসকল উদ্যোগ বিমূর্ত ছিলো না। এখনকার কমিউনিস্ট নেতাদের মতো তারুণ্যের সময়, শক্তি ও মেধার অপচয় দুজনের কেউ করেননি। তাঁরা ভালবাসতে জানতেন। নিজের পরিবার, প্রিয়জন, দেশকে তো বটেই। পুরো বিশ্বকে ভালোবাসার মন্ত্র তাঁরা জানতেন। সেই ভালোবাসা থেকেই নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করে আমৃত্যু সেই পথেই লড়েই গেছেন। দুইজনেরই আজ মৃত্যুবার্ষিকী। দুই ক্ষণজন্মা বীরের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা Hasta Siempre, commandante… লাল সালাম, কমরেডস
লেখকঃ যুব ও শিশু-কিশোর সংগঠক