মতামত

মূল টার্গেট লাভজনক নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনা, আমেরিকার নৌ-বাহিনীর ঘনিষ্ট কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড এর হাতে তুলে দেয়া

-ডা. এ. কে. এম. আরিফ উদ্দিন আহমেদ

গত সোমবার (১৭ নভেম্বর ২০২৫) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তি সই হয়েছে,  যা ইউরোপীয় কোনো দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো খাতে একক সর্ববৃহৎ প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। এই চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে, চট্টগ্রাম বন্দরের একটি নতুন টার্মিনাল নির্মান করা হবে ও ৩০ বছরের জন্য টার্মিনালটি পরিচালনা করবে ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস এবং কন্টেইনার প্রতি আয়ের একটা অংশ বাংলাদেশ পাবে। এছাড়াও প্রথমে তিন বছর অবকাঠামো নির্মানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়াও ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল আগামী ২২ বছর পরিচালনার জন্য সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক একটি প্রখ্যাত লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান, মেডলগ এর সাথে পিপিপি কনসেশন চুক্তি করা হয়েছে।

এই দুটি চুক্তি প্রসংগে সরকারের বক্তব্য ও আমাদের বক্তব্য ও কিছু প্রশ্নঃ-

ক্রমিক নং সরকারের বক্তব্য আমাদের বক্তব্য ও প্রশ্ন সমূহ
০১ সরকারের বক্তব্য হল, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নিকটস্থ স্থানে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত পানগাঁও টার্মিনাল। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সরকার। মেডলগ কোম্পানি তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় টার্মিনালের বার্ষিক পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা এক লাখ ৬০ হাজার টিইইউ কনটেইনারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে যা গড়ে বার্ষিক এক লাখ ১৬ হাজার টিইইউ। প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ও নৌ যোগাযোগের উন্নয়ন না করে, পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ না করে, কাস্টমস প্রক্রিয়ার দ্রুততর না করে,  পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা, বিদেশী কোম্পানির হাতে দিয়ে কি পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা গড়ে বার্ষিক এক লাখ ১৬ হাজার টিইইউ থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টিইইউ কনটেইনারে উন্নীত করা কি সম্ভব?
০২ সরকার বলছে, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ, পানগাঁও টার্মিনালে মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি আনতে বার্জ, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বিশেষায়িত যানবাহন ব্যবহার করবে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পরিবহণে সময় সাশ্রয় হবে এবং সরবরাহ শৃঙ্খল আরো শক্তিশালী হবে। ঢাকা- চট্টগ্রাম সড়ক ও নৌ যোগাযোগ আধুনিকীকরণ না করে, যানজট নিরসনের বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে কি ভাবে পণ্যের পরিবহণে সময় সাশ্রয় হবে?
০৩ পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের সরঞ্জাম ও সুবিধার মধ্যে থাকবে দুটি মোবাইল হারবার ক্রেন, রিফার কানেকশন এবং ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি একটি খালি কনটেইনার স্টোরেজ, মেরামত ইয়ার্ড এবং স্টাফিং ও স্ট্রিপিংয়ের জন্য ১০ হাজার বর্গমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন। টার্মিনালসংলগ্ন জমিতে তুলা গুদামজাতকরণ এবং ড্রাই স্টোরেজ ডিস্ট্রিবিউশনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে, যা আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক হবে। উল্লেখিত কাজ সমূহ বাংলাদেশ সরকার কেন করতে পারবেনা?

 

পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করার কারণে মেডলগ কোম্পানি কন্টেইনার প্রতি ফি পাবে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ পাচ্ছে। কেন বিদেশী বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিঊর) তৈরী করে এই টার্মিনাল পরিচালনা বাংলাদেশের কতৃপক্ষ নিজেরাই করছেনা?

কেন আমরা শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছি।

০৪ পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করার  জন্য সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক মেডলগ কোম্পানির সাথে যে পিপিপি কনসেশন চুক্তি করা হয়েছে তা গোপনীয় থাকবে। বন্দরের যেকোনো পরিচালনাসংক্রান্ত চুক্তি কেবল একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও পরিণত হয়।  ফলে চুক্তিতে থাকা সংবেদনশীল ধারা যাচাই-বাছাইসহ অংশীজনদের মতামত ও বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করার পিপিপি কনসেশন চুক্তি করতে অংশীজনদের মতামত নেয়া হয়নি কেন?

 

খুব অল্প সময় (মাত্র দুই সপ্তাহ) এর মধ্যে উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাব, আর্থিক প্রস্তাব, বন্দর বোর্ড সভার অনুমোদন, নৌপরিবহন ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় অনুমোদন, প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদন, নেয়া হল কেন?

০৫ চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে, চট্টগ্রাম বন্দরের একটি নতুন টার্মিনাল নির্মান করা ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসের সাথে ৩০ বছরের জন্য পিপিপি চুক্তির প্রসংগে সরকারের বক্তব্য হল, বাংলাদেশের বন্দরে মূল চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি এবং দীর্ঘ ওয়েটিং টাইম। প্রতিযোগী দেশগুলো, যেমন ভিয়েতনাম, বৈশ্বিক অপারেটর দ্বারা প্রযুক্তি–নির্ভর বন্দর ব্যবস্থাপনা চালু করে তাদের কাই মেপ বন্দরকে বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে সপ্তম অবস্থানে নিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে ৩৩৪তম স্থানে। এমন অপারেটর প্রয়োজন, যারা নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফলাফল নিশ্চিত করতে পারে। তরুণ জনশক্তি তাদের কাছ থেকে পোর্ট পরিচালনা শিখে ভবিষ্যতে দেশে–বিদেশে নেতৃত্ব দিতে পারবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো একটি দুর্নীতিমুক্ত বন্দর পাওয়ার সম্ভাবনা। চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে, তো এখন কোন টার্মিনালই নাই, সেখানে কি দূর্নীতি প্রতিরোধ করার কথা বলা হচ্ছে?

বন্দরে দূর্নীতি করতে পারে কারা? বন্দর প্রশাসন বা কতৃপক্ষ, তাহলে কি বিদেশী পরিলানাকারিদের উপর বন্দর কতৃপক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবেনা? আর যদি নিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে তো যে লাউ সেই কদুই থাকলো কিনা? এটা কি শুভঙ্করের ফাঁকি নয়?

তাছাড়া এতো তাড়াহুড়ো করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় একটি বিদেশী কোম্পানির সাথে ৩০ বছরের পিপিপি চুক্তি করতে যে শত কোটি টাকার দূর্নীতি হয়নাই তা কি ভাবে নিশ্চিত হব?

বর্তমানে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল তো বিদেশিরা চালাচ্ছে এতেও কেন চাঁদাবাজি বন্ধ হলনা?

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) নিজস্ব তহবিল থেকে ১,২৩০ কোটি টাকায় নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় আরও পাঁচ লাখ টিইইউ [টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট] যুক্ত করার কথা ছিল।

টার্মিনালটি দুই বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মাণ করা হলেও এটির বিদেশি অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) সরঞ্জামের অভাবে টার্মিনালের সক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশেরও কম ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত রিটার্নের চেয়ে অনেক কম রিটার্ন এসেছে এবং ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং থেকে মাত্র ১৮ ডলার আয় করে, যা চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যান্য টার্মিনালগুলোর চার্জ করা ৮০-৯০ ডলারের তুলনায় অনেক কম। তাই প্রশ্ন জাগে, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর কেন একটি বিদেশি অপারেটরের কাছে গেল?

 

ভিয়েতনামে সমূদ্র বন্দরই আছে ২৯ টা, তার মধ্যে অল্প কিছু বিদেশীদের দ্বারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত। ভিয়েতনামেও তাদের এতগুলো সমূদ্র বন্দর থাকা স্বত্বেও তারা তাদের মূল বন্দর গুলো পরিচালনার জন্য কোন বিদেশী কোম্পানিকে লিজ দেয়নি। তাহলে আমাদের দেশের আছে মূল একটিই বন্দর এবং এই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় সবগুলো টার্মিনাল বিদেশীদেরকে পরিচালনার জন্য দেয়া হলে তা কি দেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবেনা?

০৬ সরকার বলছে মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকছে। লালদিয়া চরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস একটি নতুন টার্মিনাল নকশা ও নির্মাণ করবে। নির্মিত বিশ্বমানের এই টার্মিনালের মালিক হবে বাংলাদেশ। নির্মাণকাল তিন বছর। এরপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে এপিএম–এর হাতে। সময় শেষ হলে তারা সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

 

সরকার আরো বলছে, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল একটি পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প। প্রাইভেট পার্টনার এপিএম সাইনিং মানি হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে মোট প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সরকার কোনো অর্থায়ন বা গ্যারান্টি দিচ্ছে না। নির্মাণ শেষে ৩০ বছরের জন্য চুক্তি থাকবে এবং শর্ত মানলে মেয়াদ বাড়ানো যাবে। যত বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেল হবে, তত বেশি আয় হবে সরকারের। কনটেইনার হ্যান্ডেল না করতে পারলেও নির্দিষ্ট ন্যূনতম ভলিউম ধরে পেমেন্ট দিতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ রেগুলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

প্রশ্নটা হল বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল করা হয়েছিলো, যা এখন লাভজনক ও সক্ষমতার চেয়েও বেশী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মানের জন্য নিজেরাই বিনিয়োগ করছেনা?

 

কেন এত তাড়াহুড়ো করে মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যে সকল যাচাই বাছাই আলোচনা, পর্যালোচনা করে এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদী পিপিপি চুক্তি করা হলো?

দেখা যাছে এই বছরেই (২০২৫ ইং) মাত্র ২ সপ্তাহে সব কিছু করা হয়েছেঃ

৪ নভেম্বর: এপিএম টার্মিনালসের প্রস্তাব দাখিল।

৫ নভেম্বর: কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন।

৬ নভেম্বর: আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন।

৯ নভেম্বর: বন্দর ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে নেগোসিয়েশন। (৭–৮ নভেম্বর ছুটির দিনে নেগোসিয়েশন হয়েছে বলে অভিযোগ)

৯ নভেম্বর: বন্দর বোর্ড সভায় অনুমোদন।

১০–১১ নভেম্বর: নৌপরিবহন ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন।

১২ নভেম্বর: অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় অনুমোদনের সুপারিশ।

১৬ নভেম্বর: প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদন।

১৬ নভেম্বর: এপিএম টার্মিনালসকে লেটার অব অ্যাওয়ার্ড প্রদান

১৭ নভেম্বর: চুক্তির দিন।

 

পিপিপি চুক্তি করার জন্য এই সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া কেন স্বচ্ছ ও দূর্নীতি মুক্ত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে?

 

তাছাড়াও গত ১২ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ৩৭তম সভায় লালদিয়া টার্মিনাল প্রকল্পটিকে শর্তসাপেক্ষে ‘নীতিগতভাবে অনুমোদনযোগ্য’ বলা হয়। শর্তটি ছিল লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং পাওয়া সাপেক্ষে। কিন্তু ১৬ নভেম্বর স্বাক্ষরিত ভেটিং রিপোর্টে ছয় দফায় আইনি ও কারিগরি অসংগতি চিহ্নিত হয়েছে। লেজিসলেটিভ বিভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরে এসব বাস্তবায়নের পর চুক্তি চূড়ান্ত করার অনুরোধ জানালেও, সেই শর্তগুলো পরিপূর্ণ না করেই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

 

ভেটিং রিপোর্টে চিহ্নিত প্রধান ত্রুটিগুলোর মধ্যে ছিল—চুক্তির খসড়ায় মূল অনুমোদনের তারিখ ফাঁকা রাখা, কর-শুল্ক-রাজস্ব সংক্রান্ত আর্টিকেলে (১১.১ (বি), ১৩.৫, ৫২.২ (সি), ৬২.২ ইত্যাদি) স্পষ্টতার অভাব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতামত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করা।

এক্ষেত্রে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)-এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে এনবিআরের ভেটিং না থাকায় আরএসজিটি কর্তৃক দীর্ঘদিন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া প্রিমিয়াম, ইন্স্যুরেন্স ও পেমেন্ট কাঠামোতে আর্থিক ধারার অস্পষ্টতা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরামর্শ নেওয়ার আবশ্যকতা পরীক্ষার কথা বলা হয়।

কমপেনসেশন ইভেন্ট (আর্টিকেল ৪৭) এবং ইভেন্ট অব ডিফল্ট চুক্তির জরুরি ধারাগুলোও পুনরায় পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়। পিপিপি আইন, ২০১৫ এবং পিপিপি ক্রয় বিধিমালা, ২০১৮-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন কেবল একটি নীতিগত সম্মতি, যা শর্ত পূরণ ছাড়া চুক্তিকে বৈধতা দেয় না।

শর্ত পূরণ না করেই চুক্তি করলে ভবিষ্যতের পিপিপি প্রকল্পগুলোর শৃঙ্খলা কি ভেঙে পড়বেনা?

 

এই আইনি কাঠামো উপেক্ষা করার ফলে ভবিষ্যতে চুক্তির বৈধতা আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে কিনা এবং দীর্ঘমেয়াদে পিপিপি কাঠামোর প্রতি আস্থা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে কিনা?

০৭ সরকারের বক্তব্য হল,

পিপিপি কাঠামোয় ৩০ বছরকে মাঝারি মেয়াদ ধরা হয়। অন্যান্য দেশে একই ধরনের চুক্তি আরও দীর্ঘ মেয়াদে হয়ে থাকে। যেমন ভারতের মুম্বাই পোর্টে ৬০ বছর, চীনের সাংহাই পোর্টে ৫০ বছর এবং ভিয়েতনামের কাই মেপ পোর্টে ৫০ বছর মেয়াদে চুক্তি হয়েছে।

 

এপিএম টার্মিনালস এপি মোলার–মেয়ার্স্ক গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের শীর্ষ ২০টি বন্দরের ১০টি তারা পরিচালনা করে। ৩৩টি দেশে ৬০টির বেশি টার্মিনাল পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। ইউরোপ, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও চীনে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এই সব দেশে কি বাংলাদেশের মত মূল বন্দর একটাই?

কোন দেশ কি তাদের সবগুলো বন্দরের টার্মিনাল বিদেশীদেরকে দিয়ে পরিচালনা করায়?

কিছু দেশ এই ধরণের দীর্ঘমেয়দী চুক্তি করে বিপদে পড়েছে তা কি আমাদের জানা নেই?

এপিএম টার্মিনালস এপি মোলার–মেয়ার্স্ক গ্রুপের মতো বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দিলে বাংলাদেশের বন্দর প্রশাসন, শ্রমিক অংশগ্রহণ, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সীমিত হয়ে যাবে।

 

বিশ্বের কিছু কিছু দেশ কৌশলগত অবকাঠামো বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দিয়ে পরবর্তীতে ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কারনে তার দেশে ৩৬০ টা সমূদ্র বন্দর/টারমিনাল থাকা সত্ত্বেও চায়নার COSCO কোম্পানি যখন পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনায়  স্বয়ংক্রিয় ও AI-ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে, তখন মার্কিন কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল যে চীন সাইবার স্পাইয়িং বা অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। তখন উক্ত পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনা  থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয় চীনের COSCO কোম্পানিকে, তাই COSCO তার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয় ২০২২ সালে। আর তাদের তাবেদার কিছু মানুষ বাংলাদেশে বলছে সমূদ্র বন্দর পরিচালনা করতে দিলে জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কোন কারন নাই।

 

জিবুতি ২০০৬ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দেয়। শুরুতে উন্নয়নের আশ্বাস থাকলেও, সময়ের সঙ্গে দেখা যায়—বিদেশি কোম্পানি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছে। অবশেষে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার চুক্তি বাতিল করে।

 

কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দর চীনা কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার পর দেখা যায়, স্থানীয় শ্রমিকদের সুযোগ কমে গেছে, কারণ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করছিল।

শ্রীলঙ্কা তার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে দিয়ে এখন “ঋণফাঁদে” পড়েছে—যা আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত এক সতর্কবার্তা।

 

বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, পিপিপি বা বেসরকারীকৃত বন্দরের ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত আর্থিক দায় বহন করতে হয়েছে। ফলে বিদেশি ইজারা কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি করে।

 

জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি

চট্টগ্রাম বন্দর কেবল অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, এটি একটি কৌশলগত সামরিক এলাকা। এখানেই রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, ইস্টার্ন রিফাইনারি, যমুনা-পদ্মা-মেঘনা অয়েল কোম্পানির তেল সংরক্ষণাগারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

 

এমন এলাকায় বিদেশি অপারেটরের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে। বন্দর তথ্য, চলাচল ও পণ্য তদারকির মাধ্যমে একটি বিদেশি কোম্পানি সহজেই জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য জানার সুযোগ পেতে পারে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে তা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটে রূপ নিতে পারে।

০৮ সরকার বলছেঃ

পিপিপি চুক্তির দলিল সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা কোনো দেশেই প্রচলিত নয় আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। ভবিষ্যৎ দরপত্র প্রক্রিয়া ও দরকষাকষি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য মূল দলিল প্রকাশ করা যায় না। চুক্তিতে ব্যবসায়িক তথ্য, অপারেশনাল কৌশল ও গোপনীয় উপাদান থাকে। বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি–ও পূর্ণ দলিল প্রকাশ না করে সারাংশ প্রকাশের পরামর্শ দেয়। লালদিয়ার ক্ষেত্রেও সেই নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে মালিকানা ও আয় কাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে।

 

ভারতের আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট) সই হয়। চুক্তিটি দীর্ঘদিন গোপন ছিল এবং এতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বহু শর্ত রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপিডিবি কর্মকর্তাদের দিয়ে চুক্তিটি করানো হয়, যেখানে আদানির পক্ষে এককভাবে সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো কার্যকর আইনি সুযোগ বিপিডিবির নেই।

 

চুক্তিতে বাংলাদেশকে আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে, যেমনটা অন্য কোনো বিদ্যুৎ চুক্তিতে নেই। কয়লার দাম নির্ধারণেও আদানির হাতে সুবিধা। কয়লার মূল্য নিয়ে বিরোধের কারণে আদানির ২৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিল নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিপিডিবির।

 

আদানি পাওয়ারের এ নেতিবাচক অভিজ্ঞতা চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালগুলোয় বিদেশী অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া উচিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার তা করেনি। আদানির মতো চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নকে ঘিরেও একই ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।

 

বন্দরের যেকোনো পরিচালনাসংক্রান্ত চুক্তি কেবল একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও পরিণত হয়।  ফলে চুক্তিতে থাকা সংবেদনশীল ধারা যাচাই-বাছাইসহ অংশীজনদের মতামত ও বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করার পিপিপি কনসেশন চুক্তি করতে অংশীজনদের মতামত নেয়া হয়নি কেন?

 

খুব অল্প সময় (মাত্র দুই সপ্তাহ) এর মধ্যে উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাব, আর্থিক প্রস্তাব, বন্দর বোর্ড সভার অনুমোদন, নৌপরিবহন ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় অনুমোদন, প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদন, নেয়া হল কেন?

 

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশী অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করাকে ঘিরে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনুমোদন, বন্দর বোর্ডে সদস্য সংখ্যা সংকটের মতো প্রশ্ন উঠেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) একই দিনে তাড়াহুড়ো করে দুটি চুক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।

 

একই সময় দুই ভিন্ন বিদেশী বিনিয়োগকারীর সঙ্গে দুটি পিপিপি নেগোসিয়েশন অসম্ভব ও নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। পিপিপি চুক্তি অত্যন্ত জটিল। প্রতিটি লাইন, আইনগত বিষয়, কনসেশন শর্ত সবকিছুই পুরো কমিটিকে বসে বিশদভাবে পর্যালোচনা করতে হয়। এত দ্রুততার সঙ্গে, তাও একই টিম দিয়ে এভাবে কাজ করানো—এটি দেশের স্বার্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

 

বোর্ড সভায়ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, সভায় প্রয়োজন ছিল চারজন সদস্যের, ছিলেন মাত্র দুজন। চবক আইনে বোর্ডে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে তিন-চার সদস্যের ভোট প্রয়োজন। কিন্তু এ দুই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এমন এক বোর্ড সভায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুই সদস্য। তাদের সম্মতি নিয়েই বিষয়গুলো অনুমোদন করা হয়।

 

তাই এই দুটি পিপিপি চুক্তি গুলোকে কেন অস্বচ্ছ বলা হবে না ও কেন বাতিল করা হবেনা?

০৯ সরকার এর বক্তব্য হল, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর চীনা ঋণে নির্মিত হয়েছিল এবং ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ৯৯ বছরের জন্য ইকুইটি হস্তান্তর করতে হয়। লালদিয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি; সম্পূর্ণ বিনিয়োগ এপিএম–এর। মালিকানা রাষ্ট্রের। চুক্তিতে ঝুঁকি বণ্টন, মুদ্রা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও স্টেপ–ইন রাইট স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যা কাঠামোকে টেকসই করে। এপিএম এর ৬,৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের বিনিময়ে বাংলাদেশ ৩০ বছরের জন্য লালদিয়া চরে তাদের দ্বারা নির্মিত টার্মিনালে তাদেরকে কি কি সূযোগ সুবিধা দেয়া হবে  তা সুস্পষ্ট নয়। এতে দেশের জন্য ঝুঁকি রয়েই যায়। বাংলাদেশ রাজস্ব কম পাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। চুক্তিতে আমাদের দেশের শ্রমিকদের ব্যাপারে কি আছে তার কোন কিছু প্রকাশ করা হলো না কেন?
১০ সরকার বলছে-

চুক্তিতে পারফরম্যান্স–ভিত্তিক সূচক, রেমেডি ও পেনাল্টি, স্টেপ–ইন রাইট, টার্মিনেশন ও হ্যান্ড–ব্যাকের ধারা রয়েছে। অপারেটর ব্যর্থ হলে সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারে।

 

 

অপারেটর ব্যর্থ হলে কি করা হবে তা আমরা বর্তমানে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে বিদেশী কোম্পানি আরএসজিটি’র ব্যর্থতা দেখে বুঝতে পারছি। সরকার তাদের ব্যপারে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি, তাদের সাথেও পিপিপি চুক্তিই করা আছে।
১১ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে কিনা এই প্রসংগে সরকারের বক্তব্য

 

নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিরাপত্তা প্রটোকল অপরিবর্তিত থাকবে। টার্মিনালের পুরো প্রযুক্তিগত ও অপারেশনাল প্রক্রিয়ায় ডেটা লোকালাইজেশন, সাইবার নিরাপত্তা, ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই ও অ্যাক্সেস কন্ট্রোল নিশ্চিত করা হবে। সবকিছু সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সম্পন্ন হবে।

 

বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টার লিংক এর অনুমোদনের পর টার্মিনালের পুরো প্রযুক্তিগত ও অপারেশনাল প্রক্রিয়ায় ডেটা লোকালাইজেশন, সাইবার নিরাপত্তা, ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই ও অ্যাক্সেস কন্ট্রোল নিশ্চিত করা সহ সবকিছু সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে কিভাবে থাকবে?
১২ লালদিয়ার চরে টার্মিনাল হলে দেশের কী লাভ হবে এই প্রসংগে সরকার বলছে-

 

অতিরিক্ত আট লাখ টিইইউ ধারণক্ষমতা যুক্ত হবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে এবং আমদানি–রপ্তানি দ্রুততর হবে। দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে। বিশ্বের দূরবর্তী দেশের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ সংযোগ তৈরি হবে। নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে ৫০০–৭০০ জনের সরাসরি এবং আরও বহুজনের পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকেরা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পাবেন। ডিজিটাল অপারেশন সিস্টেম ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়বে। এটি দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব গ্রিন পোর্ট হবে।

 

এই সব সূযোগ সুবিধা কেন বাংলাদেশ নিজে বিনোয়োগ করে করবেনা?

নিউমুরিং টার্মিনাল নিজেরা বিনিয়োগ করে লাভজনক থাকার উদাহরণ তো আমাদের আছে।

১০,৬৮৯ কোটি টাকা দিয়ে অনর্থক টানেল বানাতে পারলে কেন ৬,৭০০ কোটি টাকা দিয়ে আমরা নিজেরাই এই টার্মিনাল তৈরি করবোনা?

 

অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় যে বর্তমান সরকার প্রথমে লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনাল, আমেরিকার নৌবাহিনীর জাহাজ ভিড়তে পারার চুক্তি আছে এমন “বন্দর অপারেটর কোম্পানি” ডিপি ওয়ার্ল্ড কে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার চেষ্টা করার পর সকলের নানাবিধ বাধার কারণে ব্যর্থ হয়ে এখন প্রথমে গ্রিন ফিল্ড লালদিয়ার চরে টার্মিনাল তৈরি করা ও পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেয়ার চেষ্টা করছে ও এরপর লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা ডিপি ওয়ার্ল্ড কে দেয়ার টার্গেট নিয়েছে।

 

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল সমূহের বর্তমান অবস্থাঃ

১) জেনারেল কার্গো বার্থস (GCB) এর টার্মিনাল সমূহঃ

ক) কর্ণফুলি কন্টেইনার টার্মিনাল (KCT), পরিচালনাকারী: কর্ণফুলি গ্রুপ – বেসরকারি কোম্পানি

খ) চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান টার্মিনাল (CET), পরিচালনাকারী: এশিয়ান টার্মিনালস লিমিটেড – বেসরকারি অপারেটর

গ) মাইনর বার্থ টার্মিনাল, সি-বার্থ টার্মিনাল

ঘ) এজিআই টার্মিনাল:  এশিয়ান গ্রানাইট ইন্ডাস্ট্রিজ দ্বারা পরিচালিত

২) চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (CCT), ক্ষমতা: ১.৭ মিলিয়ন TEU, জেটি দৈর্ঘ্য: ৭৪৩ মিটার, প্রধান ব্যবহার: গভীর সমুদ্রগামী জাহাজ, পরিচালনাকারী: ডব্লিউআরইএ (Worldwide Readymade Enterprise Association) – বেসরকারি কনসোর্টিয়াম ও চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি (CPA) – তত্ত্বাবধানে।

৩) নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (NCT), ক্ষমতা: ১.৫ মিলিয়ন TEU (প্রতি বছর), (চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৫% কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয় এই টার্মিনালে) জেটি দৈর্ঘ্য: ৬০০ মিটার, প্রধান ব্যবহার: আন্তর্জাতিক কন্টেইনার বাণিজ্য, বর্তমান পরিচালনাকারী: চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি (CPA) – সরকারি তত্ত্বাবধানে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর ২০২৫ এ এই টার্মিনাল পরিচালনার জন্য আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড কোম্পানির সাথে ২৫ বছরের চুক্তি করার।

৪) পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (PCT), ক্ষমতা: ৪৫০,০০০ TEU, জেটি দৈর্ঘ্য: ৪০০ মিটার, প্রধান ব্যবহার: স্থানীয় ও আঞ্চলিক জাহাজ, পরিচালনাকারী: সিনহা কন্টেইনার সার্ভিসেস লিমিটেড – বেসরকারি অপারেটর।

 চট্টগ্রাম বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থস (GCB), চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (CCT), নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (NCT)

পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (PCT)

সৌদি আরবের অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে টার্মিনালটিতে অপারেশনাল কার্যক্রম চালানোর কথা থাকলেও এ জন্য তেমন বড় বিনিয়োগও নেই তাদের। হ্যান্ডলিং সরঞ্জামের অভাবে টার্মিনালটির সক্ষমতার ৮ শতাংশের কম ব্যবহার করতে পেরেছে রেড সি গেটওয়ে। শুধু তা-ই নয়, টার্মিনালটিতে এখনো আমদানি পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। শুধু রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয় সেখানে।

২০২৪ সালের ১১ জুন পিসিটি পরিচালনার জন্য আরএসজিটিআইকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু স্ক্যানার, গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রত্যাশিত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারছে না বিদেশি অপারেটরটি।

তাই এই কথা বলা যায় যে বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার জন্য দিলেই যে টার্মিনাল লাভজনক হবে তা সঠিক নয়।

চট্টগ্রাম পোর্ট লালদিয়া টার্মিনালঃ তৈরি ও পরিচালনা ডেনমার্কের এপিএম কোম্পানির সাথে ৩০ বছরের পিপিপি চুক্তি করা হয়েছে ১৭ই নভেম্বর ২০২৫।

 চট্টগ্রাম পোর্ট বে টার্মিনাল-১ প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনাকারী: সিংগাপুর এর পোর্ট অফ সিংগাপুর অথরিটি (পিএসএ) কোম্পানি ।

বে টার্মিনাল-২ প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনাকারী: আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড কোম্পানি।

  মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর জাইকার অর্থায়নে নির্মাণাধীন আছে, (২০২৬ সালের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে)।  এই গভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়তে পারবে ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ।

 পানগাঁও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনাল

এটি ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত। এটি ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্প ও বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্গো বন্দর হিসেবে কাজ করে। কার্যকারিতা: এই টার্মিনালের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথে কন্টেইনার পরিবহন করা হয়, যা সড়কপথে যানবাহনের চাপ কমাতে সাহায্য করে। বর্তমান পরিচালনাকারী: বিআইডব্লিউটিএ এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এটি পরিচালনা করছে। গত ১৭ই নভেম্বর ২০২৫ এ, এই টার্মিনাল পরিচালনার জন্য সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ এর সাথে ২২ বছরের জন্য পিপিপি চুক্তি করা হয়েছে। 

 বঙ্গোপসাগরের সমূদ্র বন্দর সমূহ

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর দেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর। এটি কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এবং বাংলাদেশের ৯০% আমদানি এই বন্দর দিয়ে হয়। বছরে ৩ মিলিয়ন কন্টেইনার (TEU) পরিচালনা করে। এই বন্দর দক্ষিণ এশিয়ায় ৩য় ব্যস্ততম বন্দর (কলম্বো ও মুম্বাইয়ের পরে)। দৈনিক ২০-৩০টি বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালিত হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর। এটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলি নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন।পরে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে । ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেলওয়ে সংযোগ সাধিত হয়। ১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-এ পরিণত করা হয়, বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-কে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটিতে পরিণত করা হয়। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা।

উজান থেকে আসা পলি, নগরবাসীর ফেলে দেয়া বর্জ্যে প্রতিনিয়ত ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। প্রতিনিয়ত ড্রেজিং করেও জোয়ারের সময় সবোর্চ্চ সাড়ে ৯মিটার গভীরতার বেশি জাহাজ এই বন্দরে ভেড়ানো যায় না। ভাটায় গভীরতা নেমে আসে ৬ থেকে ৭মিটারে।

কিন্তু বিশ্ব নৌ বানিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন ব্যবসায়ীরা ছোট জাহাজের পরিবর্তে ১০/২০ হাজার কন্টেইনার পরিবহণ করতে পারে এমন জাহাজ ব্যবহার করছেন।

অথচ শ্রীলংকার কলম্বো বন্দের ১৮ মিটার, ভিয়েতনামের সায়গন বন্দরে সাড়ে ১১ মিটার, সিঙ্গাপুর বন্দরে ১৬ মিটার জাহাজ আনায়েসে ভিড়তে পারে জেটিতে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল গুলোতে বড় জাহাজ ভেড়ার কোন সম্ভবনা নাই। ফলে ছোট ছোট জাহাজ দিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে বন্দরে পণ্য আনা নেয়া করতে হয়।

বড়বড় যেসব মাদার ভ্যাসেলে পন্য নিয়ে বাংলাদেশের জল সীমানায় আসে সেগুলিকে কতুবদিয়ায় বহি: নোঙগরে পন্য খালাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। এক থেকে দেড় হাজার টনের ছোট ছোট লাইটার জাহাজ দিয়ে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সেগুলিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো হয়।

কর্ণফুলীর নাব্যতা ধীরে ধীরে কমছে। শুধু নাব্যত নয়, কমেছে নদীর প্রশস্থতাও। নদীর দুপাড় দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে ক্রমশ ছোট হয়ে পড়েছে কর্ণফুলী নদীও।

বন্দর বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর তেমন একটা সুযোগ নেই। কয়েকটি বিদেশী অপারেটর, কিংবা কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে এখনো মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি গড়ে তোলা হয়নি।

বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হলে পণ্যে শুল্কায়নেরও আধুনিকায়ন করতে হবে। কাষ্টমস হাউজে গতিশীলতা বাড়াতে হবে। পণ্যে শুল্কায়ন যত সহজীকরণ হবে, যত দ্রুত হবে তত দ্রুত বন্দরে পন্য হ্যান্ডেলিং বেড়ে যাবে।

চট্টগ্রাম বন্দরকে যদি বিশ্বমানের বন্দর হিসাবে গড়ে তুলতে হয় তাহলে সবার আগে প্রয়োজন দ্রুত মাতারবাড়িতে ডীপ সী পোর্টের কাজ শেষ করা। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর উপকূলে বে-টার্মিনাল নামে নতুন বন্দর গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা দ্রুত শেষ করা । সেই সাথে কানেক্টিভিটি বাড়ানো এবং সেই সাথে নৌপথ সচল করা ।

সম্প্রতি গত ১৭ই নভেম্বর ২০২৫ সরকার চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে একটি কন্টেনার টার্মিনাল তৈরী ও পরিচালনার জন্য ৩০ বছরের জন্য, এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও ইনল্যান্ড টার্মিনাল পরিচালনার জন্য ২২ বছরের জন্য বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে পিপিপি চুক্তি করেছে। এছাড়াও আগামী ডিসেম্বর ২০২৫ এ চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য, ৩০ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পিপিপি চুক্তি করতে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও পূর্ববর্তী সরকারের মতোই জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার পথে হাঁটছে। মনে হচ্ছে, এই সরকারকে বিদেশিদের তাঁবেদারি করার জন্যই ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের ইজারা দিতেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসেছে।

সরকার এই চুক্তি সমূহ গোপন রেখেছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে এই সকল চুক্তি প্রকাশ করা হোক। না হয় আমরা ধরে নিবো এই গোপন চুক্তি সমূহ গণ বিরোধী। এই চুক্তি সমূহ অবিলম্বে বাতিল করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।

গোপন চুক্তির মাধ্যমে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল সমূহ ২২-৩০ বছরের ইজারা চুক্তি করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা অবৈধ ও দেশের সার্বভৌমত্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই জাতীয় স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা নয়, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকা চাই।

এর মধ্যে গত ৯ অক্টোবর ২০২৫ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে—বারেক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা, ৩ নম্বর জেটি গেট, কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা ক্রসিংসহ এলাকায় যেকোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল বা মানববন্ধন ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “বন্দরের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে”।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সিদ্ধান্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করার অপচেষ্টা। শ্রমিক-কর্মচারী ঐকয় পরিষদসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বহুদিন ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে এই ইজারার বিরোধিতা করে আসছে। সরকারের এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ২০২৪ সালের গণজাগরণের মূল্যবোধের পরিপন্থী কারণ এটি জনগণের সংবিধানস্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে।

এনসিটি: জাতীয় বিনিয়োগে গড়া আধুনিক টার্মিনাল

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং দেশীয় ব্যবস্থাপনায় লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

সরকারের দাবি—বিদেশি অপারেটর এলে “দক্ষতা ও রাজস্ব” বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এনসিটি ইতিমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও লাভজনক। গত কয়েক বছরে এই টার্মিনালের মাধ্যমে রাজস্ব আয় ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি অপারেটর আনার মানে হলো জাতীয় সম্পদকে বিদেশি কোম্পানির মুনাফার জন্য ছেড়ে দেয়া।

ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দিলে বাংলাদেশের বন্দর প্রশাসন, শ্রমিক অংশগ্রহণ, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সীমিত হয়ে যাবে।

বিদেশি ইজারার বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা: সতর্কবার্তা

বিশ্বের বহু দেশই কৌশলগত অবকাঠামো বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দিয়ে পরবর্তীতে ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কারনে তার দেশে ৩৬০ টা সমূদ্র বন্দর/টারমিনাল থাকা সত্ত্বেও চায়নার COSCO কোম্পানি যখন পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনায়  স্বয়ংক্রিয় ও AI-ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে, তখন মার্কিন কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল যে চীন সাইবার স্পাইয়িং বা অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। তখন উক্ত পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনা  থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয় চীনের COSCO কোম্পানিকে, তাই COSCO তার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয় ২০২২ সালে। আর তাদের তাবেদার কিছু মানুষ বাংলাদেশে বলছে সমূদ্র বন্দর পরিচালনা করতে দিলে জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কোন কারন নাই।

ভিয়েতনামে সমূদ্র বন্দরই আছে ২৯ টা, তার মধ্যে অল্প কিছু বিদেশীদের দ্বারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত। ভিয়েতনামেও তাদের এতগুলো সমূদ্র বন্দর থাকা স্বত্বেও তারা তাদের মূল বন্দর গুলো পরিচালনার জন্য কোন বিদেশী কোম্পানিকে লিজ দেয়নি।

মালয়েশিয়ায়ও ৭ টা সমূদ্র বন্দরের মূল গুলো ছাড়া দুই তিনটা বিদেশী কোম্পানি দ্বারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত।

জিবুতি ২০০৬ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দেয়। শুরুতে উন্নয়নের আশ্বাস থাকলেও, সময়ের সঙ্গে দেখা যায়—বিদেশি কোম্পানি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছে। অবশেষে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার চুক্তি বাতিল করে।

কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দর চীনা কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার পর দেখা যায়, স্থানীয় শ্রমিকদের সুযোগ কমে গেছে, কারণ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করছিল।

শ্রীলঙ্কা তার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে দিয়ে এখন “ঋণফাঁদে” পড়েছে—যা আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত এক সতর্কবার্তা।

বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, পিপিপি বা বেসরকারীকৃত বন্দরের ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত আর্থিক দায় বহন করতে হয়েছে। ফলে বিদেশি ইজারা কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি করে।

জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি

চট্টগ্রাম বন্দর কেবল অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, এটি একটি কৌশলগত সামরিক এলাকা। এখানেই রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, ইস্টার্ন রিফাইনারি, যমুনা-পদ্মা-মেঘনা অয়েল কোম্পানির তেল সংরক্ষণাগারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

এমন এলাকায় বিদেশি অপারেটরের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে। বন্দর তথ্য, চলাচল ও পণ্য তদারকির মাধ্যমে একটি বিদেশি কোম্পানি সহজেই জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য জানার সুযোগ পেতে পারে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে তা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটে রূপ নিতে পারে।

শ্রমিক ও জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি খরচ বাড়বে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত মারাত্মক সংকটে পড়বে। আমদানি ব্যয় বাড়লে জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে যাবে। নিত্যপণ্য, ওষুধ, কাঁচামাল সব কিছুর দাম প্রভাবিত হবে। অর্থাৎ ট্যারিফ বৃদ্ধির চাপ সরাসরি সাধারণ মানুষের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে।

এই ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এনসিটি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার আগেই নেওয়া হয়েছে, যা প্রমাণ করে—ভবিষ্যতে যদি এনসিটির নিয়ন্ত্রণ ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে যায়, তাহলে আরও অনেক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যেও গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, বিদেশি অপারেটরের মুনাফার স্বার্থে জাতীয় অর্থনীতি ও উৎপাদন খাত আরও বিপর্যস্ত হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের জীবনে।

 বিকল্প পথ: দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক অংশগ্রহণ

বাংলাদেশে বন্দর পরিচালনায় কোনো দক্ষতার ঘাটতি নেই। নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত ও কার্যকর বন্দর।

বিদেশি ইজারার পরিবর্তে রাষ্ট্র চাইলে-

আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি,

শ্রমিকদের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত,

দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি-

কনটেইনার পরিবহন ও মহাসড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন করা,

এই চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব, বিদেশি অপারেটর ছাড়াই।

জনগণের দায়বদ্ধতা ও সরকারের দায়িত্ব

চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ কেবল সরকারের নয়, সমগ্র জাতির প্রশ্ন। এই বন্দর আমাদের জাতীয় সম্পদ, আমাদের শ্রম, ঘাম ও বিনিয়োগে গড়া।

একটি অনির্বাচিত ও অনর্বর্তী সরকারের পক্ষে এমন কৌশলগত সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া কোনোভাবেই নৈতিক নয়। এটি হবে জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সূচনা।

সরকার যদি সত্যিই দেশের স্বার্থে কাজ করতে চায়, তবে অবিলম্বে-

১. ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে এনসিটি ইজারার সিদ্ধান্ত বাতিল করা সহ লালদিয়া টার্মিনাল, পানগাঁও ইনল্যান্ড টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের কাছে দেয়ার পিপিপি চুক্তি বাতিল করতে হবে।

২. চট্টগ্রাম বন্দরের সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করতে হবে।

৩. বিদেশি অপারেটরদের সাথে বন্দর সংক্রান্ত যে কোন ধরণের চুক্তি প্রকাশ করে, দেশের সচেতন মানুষ এবং শ্রমিকদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বন্দর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

৪. যেহেতু আমাদের দেশের বিকল্প আর কোন বন্দর নেই, তাই জাতীয় স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা নয়, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে।

নিউমুরিং টার্মিনালের সক্ষমতার অজুহাত দেখিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী পরিচালনা চুক্তির উদ্যোগ আসলে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর নিকট কৌশলে চট্টগ্রাম বন্দরের দখল দিয়ে দেয়ার মতই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

ক্ষমতার জন্য কামড়াকামড়ি করা দলগুলো এটা নিয়ে কোন প্রতিবাদ কর্মসূচী দিচ্ছেনা। তারা সব স্থানে ষড়যন্ত্র খুঁজে পান কিন্তু এখানে কিছু দেখেন না! যারা বলছেন সবার আগে বাংলাদেশ, তারা এখন কোথায়? একেই কি বলে বাংলাদেশ ফাস্ট পলিসি?

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যকে বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত করার চেষ্টার নামই বাংলাদেশকে একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত করা। বাংলাদেশকে সে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মার্কিনীরা, এবং আমাদের দেশের নেতৃত্ব চুপ করে আছে…..

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড কে দেয়ার উদ্যোগ, সিইপিজেডে কাতারের ও তুরষ্কের প্রতিষ্ঠান সমূহকে অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা করতে দেয়ার উদ্যোগ, মায়ানমারের রাখাইন সীমান্তে মানবিক সহায়তা চ্যানেলের নামে করিডোর দেয়ার পরিকল্পনা, বাংলাদেশে  স্যাটেলাইটভিত্তিক বানিজ্যিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়ার জন্য আমেরিকান কোম্পানি স্টার লিংক কে অনুমোদন দেয়া, এই উপমহাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ভূরাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নীল নকশার অংশ বলেই মনে হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে মায়ানমারের রাখাইন সীমান্তে বাংলাদেশ মার্কিনিদের প্রক্সি যুদ্ধে জরিয়ে যেতে পারে।    

 এই প্রক্সি যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নানাবিধ কার্যক্রম শুরু করেছেঃ

‘টাইগার শার্ক’ নামে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন

২ আগস্ট: যৌথ সামরিক মহড়া ‘টাইগার শার্ক’ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। মহড়াটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি, পারস্পরিক সমন্বয় এবং উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী অঙ্গীকারের প্রতিফলন হলো টাইগার শার্ক মহড়া। এই মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা একসাথে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, টহল, লক্ষ্যভেদ অনুশীলন, সাঁতার ও ডুবসাঁতার, এবং ক্লোজ কোয়ার্টারস কমব্যাটসহ বিভিন্ন সমন্বিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে।

চট্টগ্রামে ‘অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩’ নামে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্নঃ

চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর যৌথ মহড়া শুরু হয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ‘২৫। আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনীর সাত দিনব্যাপী যৌথ মহড়া ‘অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩’ শুরু হয়েছে। মহড়ায় দুই দেশের মোট ২৪২ সদস্য অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৫০ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৯২ জন। ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই যৌথ অনুশীলন চলেছে।

১৯৭১ সালের পর প্রথম মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডেস্ট্রয়ার চট্টগ্রামে আসেঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৪ বছর পর এই প্রথম মার্কিন নৌবাহিনীর একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডেস্ট্রয়ার চট্টগ্রামে নোঙর করেছে। ইউএসএস ফিটজেরাল্ড নামের এই যুদ্ধজাহাজটি গত ৮ই অক্টো ’২৫ থেকে ১৩ই অক্টো ‘২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাথে তিন দিনের একটি বিশেষ যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশা

১) চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কন্টেইনার টার্মিনাল যেটি তার সক্ষমতার শতভাগ কাজ করছে এখন। এই টার্মিনালকে সম্প্রসারণ করার সুযোগ নেই কারণ এর পাশেই আছে বাংলাদেশের নৌঘাঁটি। এই টার্মিনালে বিনিয়োগের সুযোগও সীমিত। বরং অন্য যে টার্মিনাল গুলো আছে সেগুলোতে সেই সুযোগ বিদ্যমান। এই নিউমুরিং টার্মিনাল গত বছর থেকেই সক্ষমতার শতভাগ দিয়ে কাজ করছে, তাই এই টার্মিনালটিকে পরিচালনার জন্য কেন বিদেশী কোম্পানিকে দিতে হবে?

“পেলে পুষে বড় করে, সক্ষম করে নিজের ছেলেকে অন্যের কাছে কেন বর্গা দেয়া লাগছে আমাদের?”

তাছাড়া আমরাই যে টার্মিনালের শতভাগ কাজ করাতে পারি সেটা পরিচালনার জন্য বিদেশী কোম্পানি কেন? তাও আবার ঐ কোম্পানিকে টার্মিনালটি লিজ দেয়া হবে, অনেকটা বিক্রি করে দেয়ার মত।

২) আমাদের মূল বন্দর আছে একটা, এবং এর যে নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশী কোম্পানি কে দিতে চাইছে তার সক্ষমতার শত ভাগ কার্যক্রম এখন চলছে, সেখানে এর চেয়ে বেশী উনারা কি করাতে চায় তা সুস্পস্ট না, বরং উক্ত বন্দর কন্ট্রোলে নেয়া, রাখাইন করিডোর দেয়া, কাতার ও তুরস্ককে অস্ত্রের কারখানা করতে দেয়া ও স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট স্টার লিংক কে অনুমোদন দেয়ার পেছনে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মিকে সরাসরি সহায়তার পথ তৈরীর পরিকল্পনাই মনে হচ্ছে, এতে মিয়ানমার আর্মি কি চুপ করে থাকবে? কিংবা আরাকান রাজ্যে চীন ও ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যঘাত হওয়াও এর সাথে যুক্ত এবং বাংলাদেশ আমেরিকাকে ঐ অঞ্চলে প্রবেশের পথ করে দিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক প্রক্সি যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃস্টি হতে পারে।

 লেখকঃ

ডা. এ. কে. এম. আরিফ উদ্দিন আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক