প্রান্তিকতা, বিশ্বাস ও বাম রাজনীতির সংকট: অতীত থেকে বর্তমানের পাঠ -অধ্যাপক কানাই দাশ
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে একজন পীরের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় মঞ্চে নিজস্ব বিশ্বাসের কথা প্রচার করতে দেয়াকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে এক ছাত্র নেতা কবিয়াল রমেশ শীলের প্রসঙ্গ টেনে বলতে চেয়েছেন যে মাইজভান্ডার তরিকার অনুসারী হবার কারণে তিনি নাকি পার্টিতে “আইকন” হয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কিছুদিন আগে তিনিই শাহাদাতসহ সত্তরের দশক থেকে আজতক অসংখ্য নিরপরাধ ছাত্র হত্যাকারী, শিবিরের সাথে রাজনীতি করা সহজ বলে ফতোয়া দিয়ে ছিলেন, তিনি জানেন না রমেশ শীলকে রমেশ শীল হিসাবে গড়ে তুলেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টিতে “আইকন ” হবার ধারণাটিই হলো পেটি বুর্জোয়া মানসিকতার প্রকাশ। কমরেড মণি সিং দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে ও আত্মগোপনের কারণে অনেকের কাছে রূপকথার রাজপুত্র হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু পার্টি নেতা কর্মীদের কাছে ছিলেন গভীর শ্রদ্ধার সকলের বড় ভাই। যাই হোক সেকালে টেলিভিশন এমনকি রেডিও’র অনুপস্থিতিতে গ্রাম বাংলার মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল কবি গান জারীগান পালা কীর্তন ইত্যাদি। রমেশ শীল দারিদ্র্যের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই পারিবারিক নিয়মে ক্ষৌরকর্মকে জীবিকা হিসাবে বেছে নেন। কিন্তু রাত হলেই চলে যেতেন কখনো যাত্রা পালা কখনো কীর্তন বা পালা গানের আসরে। অন্তর্গত ধী, স্মৃতি শক্তি ও কৌতুহলের কারণে তিনি সহজে কবি গান গাওয়া রপ্ত করতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম শহরের পাথর ঘাটা এলাকায় এক আসরে একজন কবির না আসায় তাঁর পরিচিত লোকজন তাঁকে তুলে দেন এবং জীবনের প্রথম আসরে তিনি সসম্মানে উতরে যান।সেই থেকে তাঁর কবিয়াল হিসাবে পরিচিতির শুরু। কবি গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা পার্টির মনোযোগ কাড়ে। কিন্তু তখন কবি গানের বিষয় থাকত সাধারণত পৌরাণিক দেব-দেবীর কল্পকাহিনি ও তাদের লীলাশ্রিত শ্লীল -অশ্লীল আখ্যান। পার্টির পক্ষ থেকে সে সময়ের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য জনপ্রিয় নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে কবিয়ালদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। গড়ে উঠে কবিয়াল সমিতি। তাঁরই প্রচেষ্টায় রমেশ শীল ও ফণী বড়ুয়াসহ প্রথম সারির কবিয়ালরা সমিতিতে যোগ দেন। আলাপে- পরামর্শে তিনি ক্রমে পাল্টে দেন কবি গানের বিষয়বস্তু। কবিয়া দের ও সাধারণ মেহনতী মানুষের যাপিত জীবনের সমস্যা, যুদ্ধ ও শান্তি ইত্যাদি গণসম্পৃক্ত বিষয় ধীরে ধীরে কবি গানের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন।‘৫৪’যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাঁর রমেশ শীল দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে গান করে মানুষকে যুক্ত ফ্রন্টের প্রার্থীর পক্ষে প্রাণিত করেন। ইতোপূর্বে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য গ্রেফতার হন। এ সময়েই চট্টগ্রামে তিনি,ফণী বড়ুয়া ও রাই গোপাল দাশ এ তিনজন প্রথম সারির কবিয়াল পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স ৭২এর কাছাকাছি। কমরেড শরদিন্দু দস্তিদার তখন চট্টগ্রাম পার্টি সম্পাদক। একই সাথে মাইজ ভান্ডার শরীফে তাঁর আসা -যাওয়া চলছে। রচনা করছিলেন অসংখ্য মাইজভান্ডারি গান।পার্টি তাঁর বিশ্বাসকে সম্মান করেছে যথাসম্ভব। তিনিও পার্টি সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত ছিলেন। পার্টি তখন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় ৮৮ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। এর আগে ১৯৬৩ সালে আত্মগোপনরত পার্টির উদ্যোগে সাহিত্যিক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সার্বিক ভাবে তাঁর বয়স, পরিবেশ, ব্যক্তিজীবন মিলিয়ে নিষিদ্ধ পার্টির কথিত আইকন হয়ে উঠার বা মাইজভান্ডার শরীফের শিষ্য হবার জন্য পার্টিতে আইকন হয়ে উঠতে পারেননি মর্মে এ সব বিষয়ে খবর না রাখা উর্বর কচি মস্তিষ্কের বাক্যালাপ বা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা মাত্র।
তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে সেই পাকিস্তান আমলে কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদার “কবিয়াল রমেশ শীল ” নামে তাঁর উপর একমাত্র গ্রন্থ লিখেন। ‘৬৯সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হিসাবে স্কুলে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় আমি বইটি পুরষ্কার পাই। সে বইটি হারিয়ে গেছে মুক্তি যুদ্ধের দূর্বিপাকে।৷ বর্তমানে এটি দুষ্প্রাপ্য। বিপ্লবী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ উভয় বাংলার প্রগতিশীল কবি বুদ্ধিজীবী –সুফিয়া কামাল, পল্লী কবি জসীমউদ্দিনসহ অনেকেই দূর্গম পথ পেরিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। পার্টির প্রচার ও তত্পরতা কারণে তা সম্ভব হয়েছে।
‘৬৬সালে পার্টি ভাঙ্গার পর মাওবাদীরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দূরের কথা উল্টো অপপ্রচার করেছে যদিও সেই বিভক্তির ভেদরেখা আজকে মুছে গেছে বলে আমরা জোর গলায় বলছি কিন্তু ইতিহাস তো আর মুছে যায় না। আজ হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান বা আহমদিয়ারা কি প্রান্তিক অবস্থানে নেই? গতকাল আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বিএনপিসহ প্রধান ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো। এরা কি সবাই মেইন স্ট্রিমে রয়েছে? তাই যদি না হয় তাদের কেন ডাকা হল না?
হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়েছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর পরে। এরা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করে বলে দাবি করে। ঐ সংশোধনী বাতিল হলে ঐ সংগঠন থাকবে না বলে তারা। সিপিবি মঞ্চে বক্তৃতা দেয়া পীর সাহেব নিশ্চয়ই সেকুলারিজমে বিশ্বাস করেন না সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। প্রয়োজন নির্যাতিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সক্রিয় ভাবে পাশে দাঁড়ানো। তাদের আলাদা একটি বাম প্রভাবিত মঞ্চে সমবেত করা, পার্টি মঞ্চে নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শ্রেণী অবস্থান পার্টির বিবেচনা বাইরে থাকতে পারে না। সিপিবি কি শ্রেণি নিরপেক্ষ পার্টি। এদের এখনো কোন সাংগঠনিক কাঠামোয় আনা গেল না অথচ পার্টির জাতীয় সমাবেশে বক্তা হয়ে গেল। সবেমাত্র কংগ্রেসের মাধ্যমে বর্তমান নেতৃত্ব আসল। নতুন নেতৃত্বের নব অভিষেকের গৌরবের দিনে আসুন সবাই পেছন ফিরে বলি “ভুল সবি ভুল” কেননা “বিশুদ্ধ ” পথে আগাতে হলে নীতি বহির্ভূত অভিনব কিছু তো করতেই হয়। দেখি, অপেক্ষা করি। মনে মনে এই ভেবে আশ্বস্ত হই ” Time is the best healer”
(লেখকঃ সিপিবি চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক)
