বিজন ভাবনা (১৮): বিপ্লব প্রতিবিপ্লব – বিজন সাহা

১৯৪৫ সালের ৯ মে (পশ্চিম ইউরোপে ৮) জার্মানির আত্মসমর্পণের পর ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আমেরিকার অনুরোধে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাজি হয় ও মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল জাপানী সেনা মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী জাপানের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার। তারপরেও আমেরিকা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। পৃথিবী এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এই আক্রমণ যুদ্ধ জয়ের জন্য যতটা না তারচেয়ে বেশি দরকার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে ত্রাস সৃষ্টি করতে। তবে সোভিয়েত নেতৃত্ব ভয়কে জয় করেছে নিজেরা পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। যদি আমেরিকা সে সময় পারমানবিক বোমা ব্যবহার না করত আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে পারমানবিক বোমার ভয় না দেখাত এমনও হয়তো হতে পারত যে এখনও পর্যন্ত আমেরিকাই থাকত একমাত্র পারমানবিক অস্ত্রধারী দেশ আর সে ক্ষেত্রে পারমানবিক বোমা ব্যবহার না করা তার ব্যবহার করার চেয়ে অনেক বেশি ইফেক্টিভ হত। হয়তো বলছি এজন্যে যে নতুন ডিসক্লোস করা ডকুমেন্ট অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শেষের আগেই, তবে হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনা সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। কারণ মানুষ অজানাকে সবসময়ই অনেক বেশি সমীহ করে, অনেক বেশি ভয় পায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এমনকি সাধারণ অস্ত্র ব্যবহারে ড্রেসডেন বা টোকিওতে হিরোশিমা ও নাগাসাকির চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা গেছিল। তবে পারমানবিক অস্ত্রের তাৎক্ষণিক ধ্বংস ক্ষমতা আর পরবর্তী তেজস্ক্রিয়তা তার ভয়াবহ ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে আশি বছর আগে কিন্তু সেই সময়ে ব্যবহৃত অনেক কৌশল আজও প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে সেটা যতটা না যুদ্ধের ময়দানে তারচেয়ে বেশি রাজনীতির মাঠে বা সঠিক ভাবে বললে অপরাজনীতিতে। বাংলাদেশের আগে শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভের মুখে সরকার পতন হয়। বেশ কিছু দিন প্রচন্ড তান্ডব চললেও সেখানকার রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ নিয়মতান্ত্রিক পথে ফিরে আসতে সফল হয় কোন রকম নোবেলজয়ী অধ্যাপক ছাড়াই। বাংলাদেশের পরে গণবিক্ষোভের মুখে নেপালের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। সেখানেও সহিংসতা এড়ানো যায়নি। তবে কোন নোবেলজয়ী অধ্যাপকের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নেপালের মানুষ দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কা ও নেপালের রাজনীতিবিদরা বুঝেছেন যে সব কিছুর পরেও দেশটা তাদের সবার, সবাই মিলেই দেশটাকে গড়তে হবে, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হবে। আমরা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ও আমেরিকার বিভিন্ন প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ করেও শান্তি আনতে পারিনি। কেন? কারণ যে দেশী বা বিদেশী শক্তি এদের নিয়োগ দিয়েছে তাদের কেউই বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা মানুষ নিয়ে ভাবেনি, ভাবেনা। তারা কাজ করেছে ও করছে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তাছাড়া যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য তারা আরও বড় দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতালোভী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। ফলে প্রায় দেড় বছর পরেও দেশ আজ ঝড়ের রাতে উন্মত্ত নদীর মাঝখানে টালমাটাল নৌকার মত লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে।
১৯৯০ সালে যখন রিগায় সোভিয়েত বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখন হঠাৎ করেই মিছিলে গুলি চলে, কয়েকজন লোক মারা যায়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গর্বাচেভ বাধ্য হন পিছু হটতে। অনেক পরে সিআইএর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের কেউ কেউ স্বীকার করে যে এটা আসলে তাদের কাজ, তারাই নিজেদের লোক দিয়ে মিছিলে গুলি চালায় পরিস্থিতি সোভিয়েত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনার জন্য। এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বিভিন্ন মার্কিন পরিকল্পনার একটি। এর পরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে কিছু লোককে গণতন্ত্রের জন্য বলি দেওয়া হয়েছে। এখন এটা ওপেন সিক্রেট যে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ময়দানে একই ভাবে বিরোধী পক্ষ মিছিলে গুলি চালায়। বাংলাদেশ ও নেপালেও পুলিশের পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে গুলি চালিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যার অভিযোগ উঠেছে আর বাংলাদেশে পুলিশ হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যেই, যেমন নেপালে হত্যা করা হয়েছে সরকারের উচ্চপদস্থ লোকদের। মিছিলে নিজেরা গুলি করে পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাড়ে দোষ চাপানো অনেকটা ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিসেবটা এই যে এ ধরণের মিছিলে শুধুমাত্র পুলিশের কাছে অস্ত্র থাকে, তাই গুলিতে যদি কেউ মারা যায় সে দায়িত্ব পুলিশের। আর পুলিশ যেহেতু সরকারের প্রতিনিধি ফলে সব দোষ সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া যায়। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে হয় সরকারের কাছ থেকে অনেক দাবি দাওয়া আদায় করে নেওয়া যায় অথবা সরকারের পতন ঘটানো যায়। তবে সব ক্ষেত্রেই যে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে হবে তার কোন মানে নেই। অনেক সময় অন্য কোন কারণে মৃত্যুর ঘটনাকেও ব্যবহার করা যায় নিজেদের কাজে। সেরকম উদাহরণ বর্তমান রাজনীতিতে একেবারে কম নেই। স্তালিন বলেছিলেন, জনগণ কীভাবে ভোট দিল সেটা মূল কথা হয়, মূল কথা হচ্ছে কে কীভাবে সেই ভোট গণনা করছে। আজকাল একই ভাবে বলা চলে কী ঘটলো সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল কে কীভাবে সেই ঘটনা সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করে বা করছে। এমনকি যদি পরে সেটা মিথ্যা প্রমানিত হয়ও তারপরেও প্রথম দিকে যে ক্ষতি হয় সেটা পূরণের নয়। তাই পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম যারা বিশ্বের তথ্য বাজারের বলতে গেলে একচ্ছত্র অধিকারী তারা সাক্ষ্য প্রমাণের অপেক্ষা না করেই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কোন খবর বা বলা চলে গুজব ছড়িয়ে দেয়। যদি সেটা মিথ্যা হয় ও তারা ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সেটাও তারা এমনভাবে করে যে তা লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় আর ক্ষতি যা হবার ইতিমধ্যেই হয়ে যায়। ফলে আজকাল এসব বিপ্লব হয় দ্রুত গতিতে প্রায় আলোর বেগে, গুজবের রেশ থাকতে থাকতেই। তাই আমরা দেখব কী আরব বসন্ত, কী রঙিন বিপ্লব সবই হয়েছে খুব অল্প সময়ে এবং আগুনে ঘি ঢালার মত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জনমনে আতঙ্ক, ক্রোধ ও ঘৃণা ছড়িয়ে ঘটনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তার মানে এই নয় যে এক দিনেই বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে দেশে এক ধরণের পঞ্চম বাহিনী তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর সেটাকে গণভিত্তি দেবার জন্য ডান বাম বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে এক প্ল্যাটফর্মে দাড় করায় কোন এক সাধারণ ইস্যুতে। আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক বা কোটা আন্দোলন ছিল এই ধরণের কমন ইস্যু। কথায় বলে যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে ইস্যু বের করা কোন সমস্যা নয়।
বিপ্লব বলতে আমরা সাধারণত সমাজের আমুল পরিবর্তন শুধু বুঝি না, বুঝি সেই পরিবর্তন যা সব দিক থেকেই আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু চব্বিশ আমাদের অনেক দিক থেকেই পেছনে নিয়ে গেছে – তা সেটা সংস্কৃতি হোক, মুক্তচিন্তা হোক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক হোক, বিচার ব্যবস্থা হোক বা মানবতা হোক। তাই চব্বিশকে যদি বিপ্লব বলতেই হয় তবে তাকে প্রতিবিপ্লব বলাই শ্রেয় কারণ যে পাকিস্তান, যে দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল, এই ঘটনা বাংলাদেশকে আবার সেই খোয়ারেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তাই বর্তমান সরকারকে, তার কাজকর্মকে বৈধতা দেবার যেকোনো প্রয়াস হবে প্রতিবিপ্লবে অংশগ্রহণ করা। যদি ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে তথাকথিত সমন্বয়করা ছিল মুখোসের আড়ালে এবং তার ফলে ভুল করার সুযোগ ছিল, বর্তমানে যখন সমস্ত পর্দা উঠে গেছে, খুলে গেছে সব মুখোস তখন আর ভুল করার অবকাশ নেই। দেখলাম দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। সিপিবি সহ বামদলগুলো ৩০০ আসন প্রার্থী দেবার কথা ভাবছে। শুধু তাই নয় সিপিবির অনেক নেতারা ইতিমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারে নেমে গেছে – অন্তত ফেসবুকে ক্যাম্পেইন চলছে বেশ জোরেশোরেই। বিগত দুই নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি এই অজুহাতে যে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে সেই নির্বাচন প্রতিনিধিত্বমূলক হবে না। এখন যখন আওয়ামী লীগকে অগণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হচ্ছে তারা নিশ্চুপ। প্রশ্ন – তারা কি চান? – গণতন্ত্র, প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন নাকি আওয়ামী লীগ বিহীন বাংলাদেশ? সেই বাংলাদেশে যে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা জীবন লাভ করবে সেটা কি তারা জানে? এখন তো সব কিছুই হচ্ছে সেই প্রেতাত্মাকে জ্যান্ত করে তোলার জন্য। আগে সিপিবি যখন প্রায় সব ইস্যুতেই আওয়ামী বিরোধিতা করত তখন এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে সিপিবির রাজনৈতিক কার্যক্রম পারতপক্ষে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ইস্যু প্রমোট করছে। এখন অনেক সময় মনে হয় সেটা তাদের রাজনীতির বাইপ্রোডাক্ট ছিল না, ছিল মূল লক্ষ্য। এই যে গণভোট – সেটা কিসের জন্য? যদি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই লক্ষ্য হয় তবে তাদের মূল দাবি হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে মৌলবাদী শক্তিকে পরাজিত করা। এর জন্যে যদি বিএনপি সহ অন্যদের সাথে আঁতাত করতেও হয়।
দেশের অনেক প্রথিতযশা মানুষ সিপিবির নেতৃত্বে শক্তিশালী বাম মোর্চা গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন। যেকোনো নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য নিজের রাজনীতি, লক্ষ্য ও শত্রু মিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আর এজন্য দরকার সঠিক ভাবে রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করা। আবেগের বশে পরিভাষার ভুল ব্যবহার দিনের শেষে শত্রু মিত্র চিনতে বাধার সৃষ্টি করে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সিপিবির নেতাদের রাজনৈতিক পরিভাষার অপব্যবহার তাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখান থেকে বেরুনো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় তাদের নেতৃত্বে কোন জোট গঠন করা কতদূর সম্ভব সেটাই প্রশ্ন। অবশ্য এসব ভুল না করলেও যে তারা বৃহত্তর বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্ব দিতে পারত সেটাই বা বলি কীভাবে? তবে এটা ঠিক যে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগে নিজেদের রাজনীতির নির্মোহ পর্যালোচনা ও নেতৃত্বের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন আবশ্যক। কারণ পপুলিস্টিক স্লোগান ও কর্মসূচী দিয়ে সাময়িক সাফল্য লাভ করা যায় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের জন্য প্রয়োজন আদর্শিক রাজনীতি। কয়েকদিন আগে এক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম যে নিজের কুকুরের বাচ্চার মত নিজের স্বৈরাচার অন্যের স্বৈরাচারের চেয়ে ভাল। একই ভাবে বলা চলে জনসমর্থনহীন স্বৈরাচারের থেকে যে স্বৈরাচারের পেছনে বিপুল জনসমর্থন আছে সেটা ভাল। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র এটাও স্বৈরাচার, তবে অল্প মানুষের উপর বেশিরভাগ মানুষের স্বৈরাচার। সিপিবি কি এখনও এতে আস্থা রাখে?
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
