বিজন ভাবনা (১৬): ডিভাইড অ্যান্ড রুল -বিজন সাহা

গতকাল এক বন্ধু তার টাইম লাইনে সেজান মাহমুদ নামে একজনের স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিল। সেখানে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখলাম। মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানি প্রগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমে বিশ্বাসী। মামদানির নির্বাচনী ইস্তেহার তাই সমাজের শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথাই বলছে। কিন্তু সমস্যা হল ভদ্রলোক জন্মসূত্রে একই সাথে হিন্দু ও মুসলমান। তার বাবা উগান্ডা থেকে আগত একজন একাডেমিসিয়ান যিনি জন্মসূত্রে মুসলিম আর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মীরা নায়ার ভারতীয় হিন্দু। ফলে এখন হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় তাকে নিজের বলে দাবি করছে এবং তাকে নিউ ইয়র্কের প্রথম হিন্দু বা মুসলিম মেয়র বলে ঘোষণা করতে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। অথচ তিনি হতে পারতেন শুধু হিন্দু বা মুসলমান নয় নিউ ইয়র্কের সব প্রান্তিক মানুষের মেয়র – যিনি ধর্ম নয় মানবতার জন্য লড়াই করবেন। আমি মাঝে মধ্যে একই সাথে গরু ও শুয়োরের মাংস দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ খিচুড়ি রান্না করি। মামদানির অবস্থা সেই অর্থে আমার খিচুড়ির চেয়েও করুণ। জানি না মামদানি নিজে ভোট পাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছেন কিনা, যদি করে থাকেন সেটা হবে দুঃখজনক, যদিও আজকাল ধর্ম ভোট যুদ্ধে এক মোক্ষম হাতিয়ার যেমন বেহেশতের হুরীদের কামনাময় অদৃশ্য দৃষ্টি মানুষকে ধর্মীয় উন্মাদনায় উন্মত্ত করার এক অব্যর্থ অস্ত্র।
নিউ ইয়র্ক, লন্ডন বা অন্যান্য ইউরোপিয়ান শহরে রাজনীতিতে আজ যে ধর্মের জয়জয়কার সেটা কি নতুন কিছু? মানবাধিকারের নামে অনেক আগেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকে পত্রপত্রিকায় এরকম খবর দেখেছি। হয়তো কোথাও কোথাও সেই আন্দোলন জয়লাভ করেছে। হ্যাঁ, বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপ আমেরিকায় লাখ লাখ মানুষ এসেছে ভাগ্যের সন্ধানে। তাদের এক বিশাল অংশ এসব দেশে এসেছে শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য। এদের খুব ক্ষুদ্র অংশই স্থানীয় সংস্কৃতি নিজেদের করে নিয়েছে। এই সংস্কৃতি শুধু নাচ গান নয় (সত্যি বলতে এটা হয়তো অনেকেই গ্রহণ করেছে), এটা শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, এটা নারী ও শিশুর প্রতি, আইনের প্রতি মানুষের মনোভাব। ঘুষ দুর্নীতির প্রতি মনোভাব। আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে বর্ণবাদ আগের মত প্রকট না হলেও সম্পূর্ণ দূর হয়নি তবে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় সহনশীলতা মনে হয় অনেক বেশি, অন্তত ছিল। তাহলে কি দেশে দেশে “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” তত্ত্ব ব্যবহার করে শাসনের ফল মামদানিকে ঘিরে আজকের এই হিন্দু মুসলমান প্রশ্ন? জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব তো “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” এর ভারতীয় সংস্করণ। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে নতুন জীবনের সন্ধানে মানুষ যখন পশ্চিমা বিশ্বে যায় তারা শুধু ধর্ম নিয়েই যায় না, ধর্ম বিদ্বেষও সাথে করে নিয়ে যায়। আর সেটাই দেখা যায় খেলার মাঠে, বিশেষ করে এসব দেশে যখন ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট খেলে। এখন সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এখনও হয়তো সেটা ডিসিসিভ রূপ ধারণ করেনি, তবে যেভাবে ডেমোগ্রাফির পরিবর্তন হচ্ছে এসব দেশে তাতে যদি অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশে ধর্ম যদি রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়, যেমনটা হচ্ছে উপমহাদেশে, তাতে অবাক হবার কিছুই থাকবে না।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন, বাল্টিক ও অন্যান্য রিপাবলিকে অতি সুক্ষ ভাবে রুশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে পশ্চিমা বিশ্ব। এতে তারা সফলও হয়। যার ফলশ্রুতি আজ ইউক্রেন যুদ্ধ, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। কিন্তু যেসব দেশ এখনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি তাদের অনেকেই এখন যুদ্ধের উন্মাদনায় অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া। বাল্টিকের দেশগুলো মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দানের উপর নির্ভরশীল আর অর্থের ফ্লো বজায় রাখতে তারা বাধ্য রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে। এটা কি ইউরোপ আমেরিকার মানুষের মানসিক শান্তির জন্য ক্ষতিকর নয়? তাছাড়া এসব দেশের অনেক মানুষ বিভিন্ন সময় ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস শুরু করেছে, সেসব দেশের নাগরিক হয়েছে। এখন এরাই নিজ নিজ শিকড়ের ভিত্তিতে একে অন্যের বিরোধিতা করছে।
অনেক দিন আগে এক গল্প শুনেছিলাম। এক লোকের এক দুষ্ট গরু ছিল। গরুর দুষ্টুমিতে অস্থির হয়ে সে তা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে হাটের দিকে যাত্রা করল। পথে সে ভাবল যদি গরুর প্রশংসা না করে তাহলে কেউ তাকে কিনবে না। তাই পথে যেতে যেতে সে গরুর জন্য বিভিন্ন প্রশংসা বাক্য বানাতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সে যখন হাটে এসে পৌঁছুল আর গরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল, কে একজন বলল,
– ভাই এত গুণী গরু আপনি বিক্রি করবেন কেন?
তাই তো? সে মনে মনে ভাবল। নিজের বানানো মিথ্যায় সে এতটাই অভিভূত হল যে গরু নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল।
নিজেদের জনগণকে ধোঁকা দিতে গিয়ে ইউরোপের এলিট শ্রেণী রুশদের এমন এক ভয়ঙ্কর মূর্তি তৈরি করেছে যে এখন নিজেরাই ভয় পেয়ে গেছে। আর সেখান থেকেই নিজেদের অর্থনীতি ধ্বংস করেও ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তারা। এই একই ঘটনা ঘটছে ডিভাইড অ্যান্ড রুলের ক্ষেত্রেও। কলোনির লোকজন যখন এসব দেশে আসছে নতুন জীবনের খোঁজে তারা শুধু শিক্ষাই নয় অপশিক্ষার বিশাল থলেটাও সাথে করে নিয়ে আসছে। সমস্যা হল তারা এখন আর ভারতীয় বা এশিয়ান বা আফ্রিকান নয়, তারা ইউরোপ আমেরিকার নাগরিক। আর এই তারাই এসব দেশের অন্য নাগরিকদের উপর সেই অপশিক্ষা প্রয়োগ করছে। আসলে পৃথিবীটা খুবই ছোট। কোথাও কোন আগাছা ছড়ালে তার বীজ আজ হোক আর কাল হোক একদিন নিজের দেশে এসে পড়বেই এবং ধীরে ধীরে দেশের জনজীবন বিপন্ন করে তুলবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে এর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক বা লন্ডনের মেয়র সাদিক খানকে নিয়ে বা মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে নিয়ে এরকম উল্লাস করার চেষ্টা হয়েছে, যেমন হয়েছে তুলসি গ্যাব্বারডকে নিয়ে। এমনকি এরা যদি এদের ধর্মীয় সত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ও তারপরেও এরা দায়বদ্ধ সেই এলিট শ্রেণীর প্রতি যারা তাদের এসব পদে মনোনয়ন দিয়েছে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার লাফালাফি।
ভালোবাসা সাধারণত স্বল্পস্থায়ী কিন্তু ঘৃণা তেজস্ক্রিয় পদার্থের মত দীর্ঘস্থায়ী – প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার দুঃস্বপ্ন বিকিরণ করে যায়। আজ নিউ ইয়র্কে মেয়রকে নিয়ে এই যে হিন্দু মুসলমান বিতর্ক এর মূল অনেক গভীরে আর সেটা রোপণ করেছে ইউরোপের সাদা মানুষেরা যারা একদিন আমেরিকা দখল করে এবং আমেরিকাকে আমেরিকার রূপ দেয়। আমাদের মনে হতেই পারে যে এসব দেশ থেকে আসা একদল অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাজ। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে দেখব আমরা সবাই এমন কি দীর্ঘ কাল বিদেশে থাকার পরেও কিছুটা বাংলাদেশী, ভারতীয় বা পাকিস্তানি রয়ে গেছি আর এ রকম ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে আমাদের সেই সত্তাটাই সামনে চলে আসে। সেটাই আমাদের হিন্দু বা মুসলমান বানায়। এর জন্য আমরা নিশ্চয়ই দায়ী তবে তারচেয়েও বেশী দায়ী তারা যারা একদিন আমাদের দেশে “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” ব্যবহার করে দ্বিজাতিতত্ত্বের গোড়াপত্তন করেছিল। কথায় বলে পাপে ছাড়ে না বাপেরে। তবে আমরা যত তাড়াতাড়ি এই সত্য বুঝতে পারব তত মঙ্গল। কারণ বিদেশে আমরা গেছি দেশি দুঃশাসন ফিরে পেতে নয়, সুশাসনের সন্ধানে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
