মতামত

এক সাহসী বিপ্লবীর বিদায়: কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ইতিহাসে কিছু নাম থাকে, যারা কেবল রাজনীতিবিদ নন—তাঁরা হয়ে ওঠেন এক একটি যুগের প্রতীক, সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, সাহসিকতার প্রতিমূর্তি। কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। ৯০ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণে আমরা হারালাম কেবল একজন রাজনৈতিক নেতাকে নয়, বরং এক অনন্য সংগ্রামী চেতনাকে, এক নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা মননকে, যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার সংগ্রামে।

১৯৩৬ সালে নোয়াখালীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবী পরবর্তীতে মিরসরাইয়ে স্থানান্তরিত হন এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীপ্ত পথচলা। পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, কারা-নির্যাতন সহ্য করা কিংবা  পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বারবার কারাবরণ—সবই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সংগ্রামের অনিবার্য অংশ।

৯০-এর দশকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব যখন বিলুপ্তির হুমকিতে, সেই সময়ে তিনি বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বলিষ্ঠ এক স্তম্ভ হয়ে। তাঁর নেতৃত্বেই চট্টগ্রাম জেলা কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করে, পথে ফেরে। তাঁর দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক নিষ্ঠা এবং ত্যাগ কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সেই দুর্যোগময় সময়েও বাঁচিয়ে রাখে।

কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরীর শ্রমজীবী মানুষের প্রতি ছিল নিখাদ ভালোবাসা। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে, তিনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে আপোষহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। চট্টগ্রাম বন্দর সিবিএ-র সভাপতি হিসেবে তিনি শুধু শ্রমিকদের আন্দোলনের কাজে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং বন্দর হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন—তিনি একজন সংগঠক, একজন নির্মাতা, একজন দূরদর্শী নেতা।

রাজনীতিতে তাঁর দৃঢ় অবস্থান এবং নীতিনিষ্ঠতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। যেখানে অধিকাংশ মানুষ ক্ষমতার মোহে আত্মসমর্পণ করে, সেখানে কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী অটল থাকেন তাঁর আদর্শে। ক্ষমতা নয়, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই ছিল তাঁর চালিকাশক্তি।

তাঁর মৃত্যু আমাদের শোকাহত করেছে, কিন্তু তাঁর জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এ মৃত্যু শুধুমাত্র একজন মানুষকে হারানো নয়, বরং একটি সংগ্রামী অধ্যায়ের ইতি, এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি। তবুও, তিনি থাকবেন আমাদের চেতনাতে, শ্রমিকের মুষ্টিবদ্ধ হাতে, রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণের চোখে, এবং সেই প্রতিটি হৃদয়ে, যেখানে ন্যায় ও সমতার স্বপ্ন লালিত হয়।

কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী, আপনাকে লাল সালাম।
আপনার স্বপ্ন আমরা বয়ে নিয়ে যাবো, যতদিন না এক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের সংগ্রামে, আমাদের চেতনায়, আমাদের হৃদয়ে।

– লাল পতাকা আপনাকে কুর্নিশ জানায়।

(লেখকঃ প্রগতির যাত্রী’র সাধারন সম্পাদক এবং সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র)