বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (১৪): ভাব ও ভাবনা 

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে বই পড়া নিয়ে কথা বলেছি। বলেছি যে সেখানে কী লেখা আছে মানুষ তা বোঝে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আর তার প্রতিফলন ঘটায় জীবনের লক্ষ্য দিয়ে। এখানে ফেসবুকে দেখা একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যায় – তিনি বললেন ঘুষ নেয়া অন্যায়, মানুষ বুঝল ঘুষ নেয়া অন্য আয়। অর্থাৎ মানুষ নিজে ঠিক করে নেয় কোনটা সে গ্রহণ করবে ও কীভাবে করবে। ২০২৪ এ মানুষ স্বৈরশাসনের অবসান চেয়েছিল কিন্তু আন্দোলনের নেতারা চেয়েছিল হাসিনার পতন। মানুষ চায় শাসন বদলাতে, রাজনৈতিক দল চায় শাসক বদলাতে। শাসন শোষণে নেতাদের যত না আপত্তি তার চেয়ে বেশি আপত্তি শাসকে যদি না সে নিজে শাসক হয়। তাই জনগণের স্বার্থের কথা মুখে যতই বলুক আসল লক্ষ্য নিজে শাসক ও শোষক হওয়া।
২০২৪ এর জুলাই আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে – সেটা হল কিভাবে জনগণকে সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে ধোঁকা দেয়া যায়। মনে পড়ে বাংলাদেশের পতাকা মাথায় বেঁধে বা দেশাত্মবধক গান গাইতে গাইতে ঢাকার রাস্তায় মিছিলের কথা। পরবর্তী পরিস্থিতি বলে যারা মাথায় লাল সবুজ পতাকা বেঁধেছিল ও দেশাত্মবোধক গান গেয়েছিল তাদের অনেকেই, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় অংশ এই পতাকা ও গান কোনটাই ধারণ করে না। মনে পড়ে কীভাবে কোটা বিরোধী আন্দোলন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হল। মজার ব্যাপার হল বৈষম্য বিরোধী হলেও সেটা কখনও সাম্যের জন্য আন্দোলন হল না। এই এক ধাঁধা। আমরা বৈষম্য বিরোধী কিন্তু সাম্যের পক্ষে নই। কেনরে ভাই? বিষয়টি কি শুধুই নামে নাকি এর ভেতরে রয়েছে গভীর রহস্য। আর সে কারণেই আন্দোলনের আগের সমস্ত স্লোগান বদলে গেছে। সাম্য আসেনি, বৈষম্যও কমেনি, উল্টো সেটা বেড়েছে বহু গুণ।
ছোটবেলায় কারোও সাথে ঝগড়া হলে আমরা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করতাম। কখনও একঘরে করতাম। আর সেটা হত এই বলে যে “আমার সাথে কথা বললে নাক কাটা।” এর পর যদি পড়ার সময় বইয়ে এসব নাম থাকত তবে তা কায়দা করে ভাসুরের নাম না নেয়ার মত সেটা এড়িয়ে যেতাম। কথাটা মনে পড়ছে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন বক্তব্য শুনে ও লেখা পড়ে। যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা যাবে কিন্তু জয় বাংলা বলা যাবে না। জয় বাংলা বললেই আপনি স্বৈরাচারের দোসর হয়ে যাবেন। কেনরে বাবা? জয় বাংলা স্লোগান তো সব মুক্তিযোদ্ধারাই দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায় যে “জয় বাংলা” স্লোগান “দুনিয়ার মজদুর এক হও” এর সাথে মোটেই যায় না। একই ভাবে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষে কথা বলব, সেটা বলতে গিয়ে ঘোষণাপত্রে জনগণের জন্য গণতন্ত্র, সাম্য (সমাজতন্ত্র), সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলব, এমনকি চার মূলনীতির প্রতি অবিচল থাকার কথা বলব অথচ এই চার মূলনীতির নাম মানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এই শব্দগুলো মুখে আনব না। আচ্ছা, আপনারা ভূত নাকি যে রাম নামের মত এই শব্দগুলো বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার নাম মুখে নিতে ভয় পান? বলতে পারেন কথা তো একই। না এক নয়। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন যেমন সাম্যের জন্য আন্দোলনে পরিণত হয়নি বরং বৈষম্য হাজার গুণে বাড়িয়েছে, একইভাবে চোরাগলি দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাইলে সেটা পলপটের সমাজতন্ত্র হবে, অন্য কিছু না। সব দেখে মনে হয় আমরা যতটা না আদর্শ রক্ষার জন্য লড়াই করছি তারচেয়ে বেশি জামায়াত শিবির বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন রক্ষা করে চলতে চাইছি। যেন আমরা তাদের আমন্ত্রণে এ দেশে রাজনীতি করতে এসেছি আর জান প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছি তাদের মন রেখে চলতে, তাদের না রাগাতে, পাছে হালুয়া রুটির ভাগ না দেয়। এমন কি কেউ কেউ বলেই বসেন যদি এভাবে না চলতাম বা না চলি আমাদের অবস্থা হবে মেনন, শাজাহান সিরাজদের মত – মানে আমাদেরও ধরে ধরে জেলে ভরবে। ভয় নেই। ভরবে। তবে তার আগে আমাদের দিয়ে অন্যদের হাত পা ভাঙ্গাবে যাতে আমাদের ডাক যখন আসে তখন পাশে দাঁড়ানোর কেউ না থাকে। মনে নেই সেই বিখ্যাত কবিতা?
একসময়ে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা ও একতার সম্পাদক মতিউর রহমান প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রগতিশীল মানুষদের সেদিকে টানেন অতীতের ক্লিন ইমেজ দিয়ে। আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগে – শুধু সম্পাদক হিসেবে দক্ষতার জন্যই নাকি অতীত ইমেজকে ব্যবহার করার জন্যেও তাকে এই পত্রিকার সম্পাদক করা হয়েছিল? পরিবর্তনের যে স্লোগান সেখান থেকে আসে তা যে উল্টো স্রোতে বদলে যাওয়া সেটা কি সবাই বুঝতে পেরেছিল? মতিউর রহমান যে প্রথম আলোর মুখ নয় মুখোশ – সেটা কি আমরা বুঝতাম বা বুঝি? আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবৎ তাবৎ বিশেষজ্ঞরা স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদী শাসন এসব নিয়ে দীর্ঘ ও গুরুগম্ভীর ওয়াজ করে যে মৌলবাদকে প্রমোট করত সেটা কি আমরা অনুধাবন করতাম? প্রথম আলোয় লিখে ও প্রথমা থেকে নিজেদের প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা সম্বলিত বই প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেরাই কি দেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছি না?

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (১৩): বই পড়া- বিজন সাহা

ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব দল আত্মগোপনে ছিল তাদের অন্যতম কমিউনিস্ট পার্টি। পাকিস্তান আমলে তো এরা সবসময় আত্মগোপনে ছিল আর সেখান থেকেই দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৩ সালের পরে আত্মগোপনে চলে যাবার পরে জামায়াত শিবির যে বসে থাকবে না, উল্টো আরোও বেশি শক্তি নিয়ে লড়াইয়ে নামবে সেটা তো নতুন কিছু নয়। তাই প্রশ্নটা থেকেই যায় – সিপিবি কি দেশের রাজনীতি পড়তে ভুল করেছিল? সিপিবির কি বুঝতে ভুল হয়েছিল যে ঐ সময় তারা যেমন ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ইত্যাদি দলে নিজেদের লোকজন পুশ করে রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে, জামাত শিবির একই ভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমন কি সিপিবিতে (?) নিজেদের লোকজন পুশ করে এদের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে?

আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের নামে নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম করা ও দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করা। বর্তমান সরকার তার ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু এরা জনবিচ্ছিন্ন ও জনগণের কাছে কোন ভাবেই দায়বদ্ধ নয় তাই একমাত্র নিজেদের ও নিজেদের দেশি-বিদেশি মালিকদের স্বার্থ রক্ষা ব্যতীত এদের অন্য কোন দায়বদ্ধতা নেই কারো কাছে। এদের সমস্ত কাজকর্ম পর্যালোচনা করলে একটি সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় – “পরের ধনে পোদ্দারি” – এটাই এই সরকারের ফিলোসফি।
গণভোট ও জুলাই সনদ নিয়েও পার্টির ভেতরে মতৈক্য নেই বলেই মনে হয়। যতদূর জানি বর্তমান সংবিধানে গণভোটের সুযোগ নেই। তাই এ ব্যাপারে নবনির্বাচিত সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই কি ঠিক নয়? মনে পড়ে এর আগে আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের রায় পেয়েও সে পথে হাঁটে নি বিধায় বামপন্থী সহ বিভিন্ন মহলের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে সেই সুযোগ হাতছাড়া করায় শুধু আওয়ামী লীগ আজ রাজনীতির কানা গলিতে হারিয়ে যাচ্ছে না, দেশও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আজ আশু ফলের চিন্তায় গণভোটের পক্ষে এমনকি মৌখিক সমর্থন জানানো মানে হবে বাহাত্তরের সংবিধান তথা মুক্তিযুদ্ধের সাথে বেইমানি করা। জুলাই সনদ হল ব্যাংকের ঋণের চুক্তির মত, যেখানে বড় অক্ষরে শুধু কিছু ভালো পয়েন্ট লেখা থাকে আর প্রায় পড়ার অযোগ্য ছোট ছোট হরফে লেখা থাকে সেই সব শর্ত যার নাগপাশে চাপা পড়ে অচিরেই ক্লায়েন্ট সর্বশান্ত হয়। দেখবেন পার্টির অবস্থা যেন তেমনটি না হয়।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নে পার্টির সাবেক ও বর্তমান নেতাদের বক্তব্য শুনে আমরা আশাবাদী হতে পারি না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের দেখি পার্টি পক্ষ থেকে বলতে, নিজে কী ভাবছে সেটা কেউ খোলসা করে বলছে না। যেন পার্টি পার্টির মত আর তারা তাদের মত চলছে। এসব কর্মী ও সমর্থকদের ভুল সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। ফেসবুকে বিভিন্ন লেখা ও কমেন্ট থেকে যেটা বুঝতে পারি তাতে মনে হয় বাহাত্তরের সংবিধান, গণভোট এসব সংবেদনশীল বিষয়ে পার্টির সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা সিপিবির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, বর্ষীয়ান নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সহ অন্যান্য নেতাদের ব্যক্তিগত অভিমত জানতে চায়। জনগণ কখনোই পার্টিকে খুব একটা বিশ্বাস করে না, আমরা যারা করি তারাও দিন দিন হতাশ হচ্ছি। নেতাদের নীরবতা বজায় থাকলে মনে হয় এক সময় আমাদের নিজেদেরও জনগণের কাতারে দাঁড়াতে হবে পার্টিকে বিশ্বাসের প্রশ্নে।
শেষ খবর অনুযায়ী জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। আশা করব এখন থেকে সিপিবি নেতৃত্ব বর্তমান সরকারের (জামায়াত শিবির) সাথে যেকোনো বিষয়ে সমঝোতার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হবে। তবে শুধু সনদে স্বাক্ষর না করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। জনগণকে বোঝাতে হবে কেন বাহাত্তরের সংবিধান মানুষের মুক্তির সনদ, কেন এর উপর ভিত্তি করেই সোনার বাংলা গড়তে হবে। এই প্রথমবারের মত বিএনপি’র ভেতরের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সরব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা আপাতত পরাজয় বরণ করেছে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রায়। তাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে হবে সিপিবি সহ অন্যান্য বাম দলগুলোকে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন ও নব্বইয়ের দশকের রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দ্বিধাবিভক্ত, পরস্পর বিরোধী। এই সুযোগে জামায়াত শিবির নিজেদের শক্তিশালী করেছে। আজকের বাংলাদেশ তার প্রমাণ। তাই সিপিবিকে শুধু বাম ঐক্যের কথা ভাবলেই চলবে না, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের ও বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষে অবস্থানকারীদের নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। একমাত্র এই সম্মিলিত শক্তিই পারবে দেশকে মৌলবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো